শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ১০:৪৮
Home / অনুসন্ধান / উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির : ঠাণ্ডায় কাবু নারী-শিশুরা
ঘরের আয়তন মাত্র ১২ ফুট। এর মধ্যেই গাদাগাদি করে থাকছে ৩৪ জন নারী ও শিশু। বেশির ভাগ শিশুর গায়ে নেই গরম কাপড়। ছবিটি ৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের ‘এফ’ ব্লক থেকে তোলা l প্রথম আলো

উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির : ঠাণ্ডায় কাবু নারী-শিশুরা

আব্দুল কুদ্দুস, উখিয়া সীমান্ত থেকে : গৃহবধূ আয়েশা খাতুনের (২২) কোলে সাত মাসের কন্যাশিশু তৈয়ুবা। সর্দি-কাশির প্রভাবে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। বিরামহীনভাবে কেঁদে চলেছে। পাশে থাকা অপর দুই মেয়ে কিছমত আরা (৩) ও হাসিনার (২) গায়েও গরম কাপড়চোপড় নেই। গুটিসুটি মেরে আছে মায়ের পাশে।
আয়েশা খাতুন জানান, এক কাপড়ে তাঁরা মিয়ানমার ছেড়েছেন। গরম কাপড় তো দূরে, প্রাণ নিয়ে আসাটাও ছিল দুরূহ। এখন অনাহারে দিন কাটছে। শীতে কষ্ট পাচ্ছে সন্তানেরা। তৈয়ুবা অসুস্থ হলেও তাকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
৮ ডিসেম্বর সকালে কক্সবাজার-টেকনাফ আঞ্চলিক মহাসড়কের উখিয়া উপজেলার টেলিভিশন উপসম্প্রচারকেন্দ্রের উত্তর পাশে কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আয়েশার নিজেরও গরম কোনো কাপড় নেই। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডুর খেয়ারিপ্রাং গ্রামে।
দেখা যায়, শিবিরের ই-ব্লকের বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত ১৮ ফুট লম্বা একটি ঝুপড়িঘরে গাদাগাদি করে থাকছেন আয়েশাসহ ৫৫ জন নারী ও শিশু। নারীদের সঙ্গে আছে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ২৩ জন শিশু। ঠান্ডায় (শীতে) বেশির ভাগ শিশু সর্দি-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত। কিছু শিশুর গায়ে কাপড়ও নেই। একইভাবে এফ ব্লকের আরেকটি ১২ ফুটের ঘরে থাকছে ৩৪ জন নারী ও শিশু।
কথা হয় ই–ব্লকের ঘরে আশ্রয় নেওয়া খেয়ারিপ্রাং গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা নারী তৈয়বা খাতুনের (৪৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ ইচ্ছা করে এখানে পালিয়ে আসিনি। আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি-সহায়সম্বল সবকিছু হারিয়েছি। সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা ফিরে যাব।’
তৈয়বার ভাষ্যমতে, গত ২২ নভেম্বর বিকেলে কয়েক শ সেনা ও পুলিশ খেয়ারিপ্রাং গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এরপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘরবাড়ি ছেড়ে রোহিঙ্গারা পালাতে থাকে। এ সময় রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের গুলিতে সেদিন নিহত হন তাঁর স্বামী আবুল বশরসহ অন্তত ২৪ জন। ছেলে মো. ছৈয়দসহ নিখোঁজ হয় গ্রামের অনেকে। এরপর কিশোরী মেয়ে আরেফা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি উখিয়ায় পালিয়ে আসেন। এখানে খুব কষ্টে দিন কাটছে তাঁদের।
এই শিবিরে আগে থেকে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। সম্প্রতি ঢুকে পড়েছে আরও প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। নতুন আসা রোহিঙ্গারা পুরোনোদের ঝুপড়ি ঘরেই আশ্রয় নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছে।
রোহিঙ্গা নারীরা বলেন, শিশুদের কান্নাকাটি আর হইচইয়ের জন্য এই ঝুপড়িঘরে কারও ঘুম হয় না। রাতে ঝুপড়িঘরের বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে। একটা কম্বল কিংবা গরম কাপড় দিয়ে শিশুদের শীত নিবারণেরও কোনো জো নেই। খাবারের সংকটও চলছে। বড়রা শাকসবজি দিয়ে কোনোমতে এক বেলা-দুই বেলা খেতে পারলেও শিশুদের জন্য খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
১৮ ফুটের যে ঘরটিতে রোহিঙ্গা নারী-শিশুরা থাকেন তার মালিক আবুল ফয়েজ। তিনিও রোহিঙ্গা। কয়েক বছর আগে তিনি মংডু থেকে সপরিবার কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। বন বিভাগের এক খণ্ড ভূমিতে তৈরি করেন দুই কক্ষের একটি ঝুপড়িঘর। একটি কক্ষ তিনি ছেড়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের জন্য।
আবুল ফয়েজ (৪০) বলেন, শুরুতে এই কক্ষে আশ্রয় দিয়েছিলাম ৩২ জন রোহিঙ্গাকে। পরে সেখানে যোগ দেয় আরও ২৩ জন। নারীদের স্বামী ও বড় ছেলেরা থাকে শিবিরের মসজিদে। বিপুলসংখ্যক নারী-শিশু ও কিশোরী ছোট্ট এই কক্ষে গাদাগাদি করে থাকলেও খাওয়াদাওয়া, গোসল আর শৌচকর্ম নিয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। চারদিকে দুর্গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না।
এ শিবিরের কয়েকটি ব্লক ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব রোহিঙ্গা নারীর রয়েছে একাধিক শিশু। অনেকটা বন্দিজীবন কাটছে এসব রোহিঙ্গার।
কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু সিদ্দিক বলেন, এই শিবিরের প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার পুরুষ কক্সবাজার শহর ও উপকূলে দিনমজুরি, রিকশা ও টমটম চালানো, চিংড়ি পোনা আহরণসহ নানা কাজে নিয়োজিত। অন্যরা বেকার। অভাব–অনটনের মধ্যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দিন কাটালেও ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। কারণ ওপারে (রাখাইন রাজ্যে) চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতা। আর এপারে হাহাকার।
এদিকে গত ২৬ নভেম্বর টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে মারা যায় জ্বরে আক্রান্ত শিশু জানে আলম (৬)। ওই দিন বিকেলে তাকে লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শিশুর মা নুর বেগম (২২) বলেন, ওই দিন ভোরে তিনি নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ পালিয়ে আসেন। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গজরবিল গ্রামে। ২৩ নভেম্বর বিকেলে সেনা ও পুলিশ গজরবিল গ্রামে গুলি চালায়। আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ৫০টির বেশি ঘরবাড়ি।
গুলিতে তাঁর স্বামী জামাল হোসেন নিহত হন। দুই শিশুসন্তান মো. হাশেম (৪) ও জাফর আলম (৩) আগুনে পুড়ে মারা গেছে। জানে আলমকে নিয়ে তিনি টেকনাফ পালিয়ে আসেন। কিন্তু রক্ষা করা গেল না। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল সে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. পু চ নু প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালে দুর্গম পাহাড় ও সমুদ্র উপকূলে শিশুরা নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-জ্বর ও কাশিতে আক্রান্ত হয়। রোহিঙ্গা শিশুরাও ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি নিবন্ধিত শিবিরের ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলেও অনিবন্ধিত শিবিরে বসবাসকারী কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জন্য তেমন কিছু নেই।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...