বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:৫৩
Home / আকাবির-আসলাফ / আল্লামা সুলতান যওক নদভী দা.বা. : জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারা

আল্লামা সুলতান যওক নদভী দা.বা. : জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারা

মুহাম্মদ রুকন উদ্দিন :

১. ভূমিকা:
الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله….. وبعد
মহান রাব্বুল আলামীনের অসংখ্য অনুগ্রহরাজীর অন্যতম একটি অনুগ্রহ হল, নবী-রাসুলগণের ধারা সমাপ্তির পর যুগে যুগে এমন কিছু ব্যক্তিসত্ত্বার আবির্ভাব তিনি ঘটিয়েছেন যারা দেশ, জাতি ও পৃথিবীর কল্যাণে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন সর্বোপরী “ওরাছাতুল আম্বিয়া” এর উত্তম নমূনা হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে সচেতন উত্তরসূরীদের স্নায়ুতে, স্মৃতিতে, চেতনায় ও ধারণায় তারা বিরাজ করেন নি:শব্দে।

আমাদের দেশের জনসাধারণ ও জেনারেল শিক্ষিতদের একটি বদ্ধমূল ধারণা হলো, আল্লাহর অলী-বুজুর্গ ও ওলামায়ে কেরাম মসজিদ মাদরাসা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দেশ-জাতি ও সমাজ গঠন বিশেষত ক্রমপরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে তারা কোন চিন্তাই করেন না। অথচ এটি অত্যন্ত ভুল একটি ধারণা। অলী-বুজুর্গ ও ওলামায়ে কেরাম ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেমন অবদান রাখেন তেমনি অবদান রাখেন দেশ, জাতি, ও বৈশ্বিক কল্যাণে। কিন্তু তাদের এ অবদানগুলোর বেশিরভাগ লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।
মূলত দুটি কারণে এটা হয়ে থাকে। প্রথমত বিচারের মানদণ্ডের ভিন্নতা। আমাদের জেনারেল শিক্ষিতরা মানবরচিত জ্ঞানের মানদণ্ডে সবকিছু বিচার করে পক্ষান্তরে ওলামায়ে কেরাম খোদাপ্রদত্ত জ্ঞান দ্বারা বিবেচনা করেন। দ্বিতীয় কারণ হল গবেষণা স্বল্পতা। খোলাসা করে বলতে গেলে, তাদের জীবন, কর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণে লেখা-লেখি না হওয়া। বাংলা ভাষায় লেখা-লেখি ও গবেষণার কলম বর্ণচোরাদের হাতে থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আশার কথা হল এ পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছে। ওলামায়ে কেরামের জীবনী নিয়ে গবেষনা শুরু হয়েছে। বলতে গেলে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক। সেই আলোকে জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামীয়ার সাংস্কৃতিক ফোরাম আন-নাদী আস-সাক্বাফী আল-ইসলামীর বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা ১৪৩৬ হি. উপলক্ষ্যে বাংলা প্রবন্ধের বিষয় নির্ধারণ করেছে “আল্লামা সুলতান যওক নদভী : জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারা”।
দীর্ঘ বার বছর যাবত এই মহান মনীষীকে কাছ থেকে দেখছি। তাকে দেখে দেখে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শিখছি। ব্যক্তিগত ডায়রির বহু পাতায় স্থান পেয়েছে তার কথা। কিন্তু প্রবন্ধাকারে এই প্রথম লিখেছি। কলেবরের সীমাবদ্ধতার কারণে তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিতে হয়েছে। সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে বিশদ আলোচনার দাবীদার বহু বিষয়কে। ফলে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিসত্ত্বার মূল্যায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর তাওফীক শামেলে হাল হলে ভবিষ্যতে প্রচেষ্টা চালানোর আশায় থাকতে হচ্ছে। পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা তিনি যাতে প্রবন্ধকারসহ সবাইকে এই মহান মনীষীর জীবন থেকে কিছু আলো সংগ্রহের তাওফীক দেন। আমীন!!

২.জন্ম ও শৈশব:
২.১ বংশ পরিচয়: আল্লামা সুলতান যওক নদভী সাগরকন্যা খ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ মহেশখালীর এক মধ্যবিত্ত দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আলহাজ্ব সূফী আবুল খায়ের। মাতার নাম ছিল রূহ আফজা বেগম। হযরতের নানা মাওলানা মকবুল আহমদ সাহেব রহ. (মৃ.১৯৪৩) ছিলেন হযরত মাওলানা যফর আহমদ সাহেব রহ. এর বিশেষ খালিফা।

২.২. পারিবারিক বৈশিষ্ট্য: আল্লামা সুলতান যওক নদভী এর পারিবারিক পরিবেশ ছিল ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য খুবই উপযুক্ত। হযরতের দীর্ঘদিনের সহকর্মী মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলীল দা.বা. এটিকে তার ব্যক্তিত্ব গঠনের মৌলিক চারটি উপাদানের অন্যতম হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। হযরতের পিতা খুবই ধর্মপরায়ন ও পরহেজগার লোক ছিলেন। ওলামা-মাশায়েখের খুবই কদরদারী করতেন। ফলে লোকেরা তাকে সূফী আবুল খায়ের হিসেবেই চিনতো। তার ঘরে দ্বীনি কথা-বার্তা, ওলামায়ে কেরামের যাতায়াত, যিকির-আযকার, সর্বদা আখেরাতের চিন্তা ও চর্চা এত অধিক হারে হত যে, বৈষয়িক কথা-বার্তা ও চিন্তা-চেতনা তেমন একটা হালে পানি পেত না।

২.৩. জন্ম: আল্লামা সুলতান যওক নদভী মহেশখালীর কেন্দ্রীয় এলাকা বড় মহেশখালীর জাগীরাঘোনা মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। হযরতের জন্মের সালটি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। সম্ভবত তিনি ১৯৩৭/৩৮ কিংবা ১৯৩৯ ঈসায়ী মোতাবেক ১৩৫৬/৫৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। হযরত নিজে শেষোক্তটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তথাপী হযরত তার জীবনকথায় স্বীয় পিতার উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, পটিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার সময় (১৯৫৩ ঈ. মোতাবেক ১৩৭২ হি.) তার বয়স ছিল ১৬ বছর। সে হিসেব মতে জন্মসন হিসেবে ১৯৩৭ ঈ. মোতাবেক ১৩৫৬ হি. সনই প্রাধান্য পায়।

২.৪. মাতৃবিয়োগ: শিশুকালেই হযরত আপন স্নেহময়ী মাতাকে হারান। তার পিতা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) সফর করতেন। হযরতের বয়স যখন তিন/চার বছর তখন স্বপরিবারে তারা বার্মা সফরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যেই তার আম্মার ইন্তেকাল হয়।

২.৫. পিতার বাৎসল্য: স্নেহময়ী মাতার ইন্তেকালের পর হযরতের প্রতি তার পিতার বাৎসল্য অনেক বেড়ে গেল। সন্তানকে মায়ের অভাব বুঝতে দিতেন না। সবসময় আগলে রাখতেন। খাবার-দাবার, পোষাক-পরিচ্ছেদ সর্বক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিতেন। সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় বড় ভাইয়েরাও তাকে খুব স্নেহ করতেন। তবে হযরতের প্রতি তার আব্বাজানের সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে, তিনি হযরতকে বাল্যকাল থেকে একনিষ্ঠ দ্বীনের জন্য ওয়াকফ করে রেখেছিল। এবং এতদুদ্দেশ্যে যুগশ্রেষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের হাতে তাকে সোপর্দ করেছিলেন। এক চিঠিতে তিনি হযরতকে লিখেন, আমি তোমাকে পড়িয়েছি এ জন্য যে, তুমি আমার পরকালে কাজে আসবে। পার্থিব ফায়দা হাসিলের জন্য নয়। মোটকথা আমৃত্যু তিনি হযরতকে পিতৃবাৎসল্যে ধন্য করেছেন।

৩. ছাত্র জীবন:
৩.১ প্রাথমিক শিক্ষা: আল্লামা সুলতান যওক নদভীর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টি প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষার কেন্দ্রও ছিল। এখানে তিনি বাংলা, অংক, সমাজপাঠ, কায়েদা আমপারা ও কোরআনের প্রাথমিক পাঠসমূহ গ্রহণ করেছেন। এছাড়াও তিনি নতুনবাজার জামে মসজিদের অধিনে পরিচালিত ফোকানিয়া মাদরাসা এবং পরবর্তিতে মাদরাসায়ে ইসলামিয়া, গোরকঘাটায় মিযান-মুনশাঈব (৫ম শ্রেণী সমমান) অধ্যয়নের মাধ্যমে তার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন। তবে হযরতের প্রাথমিক শিক্ষার্জনে সবচেয়ে বেশি অবদান যিনি রাখেন তিনি হলেন হযরতের খালু মাওলানা ফযল আহমদ সাহেব রহ.। এছাড়াও মরহুম মাস্টার আবুল খায়ের সাহেব এবং মাওলানা মকবুল আহমদ সাহেব থেকেও তিনি জ্ঞানার্জনে ধন্য হন।

৩.২ মাধ্যমিক : প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর আল্লামা সুলতান যওক নদভী ইমদাদিয়া কাসেমুল উলুম নতুন বাজার মাদরাসায় ভর্তি হলেও সেখানে বেশিদিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। এসময় তিনি হেদায়াতুন্নাহুসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পূর্বোক্ত মাওলানা ফযল আহমদ সাহেব রহ. এর কাছে প্রাইভেটভাবে অধ্যয়ন করেন।

৩.২.১ আশরাফুল উলুম ঝাপুয়া মাদরাসার ভর্তি: অতপর ১৩৬৯ হি. তিনি জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে প্রথমবারের মত ঘরোয়া পরিবেশ ত্যাগ করে মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আশরাফুল উলম ঝাপুয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। খুব অল্প সময়ে হযরত শিক্ষকবৃন্দের সুদৃষ্টি অর্জনে সক্ষম হন। বিশেষভাবে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা মুজাহেরুল হক সাহেব রহ. মাওলানা সাঈদ আহমাদ গহিরাভী রহ. হযরতকে নিজ সন্তানের মত স্নেহ করতেন। এ মাদরাসায় হযরত তিন বৎসর অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া করেন।

৩.২.২ মুফতী আযীযুল হক রহ. এর সুদৃষ্টি: ঝাপুয়া মাদরাসায় অধ্যয়নের তৃতীয় বৎসরে কুতুবে যমান আল্লামা মুফতী আযীযুল হক রহ. এক দাওয়াতী সফরে মহেশখালী আগমন করেন। এ সফরে মুফতী সাহেব রহ. হযরতের পিতার মেহমানদারী কবুল করেন এবং তাদের বাড়ীতেই অবস্থান করেন। হযরতকে পিতা মুফতী সাহেব রহ. কে অভ্যর্থনা থেকে নিয়ে সবকাজে হযরতকে সাথে সাথে রাখেন। তাছাড়া ঝাপুয়া মাদরাসার দায়িত্বশীলগণ তার সম্পর্কে মুফতী সাহেব রহ. এর কাছে বেশ কিছু ইতিবাচক বাক্য বলেন। ফলে মুফতী সাহেব রহ. এর স্নেহদৃষ্টি হযরতের উপর নিবদ্ধ হয়। তিনি হযরতের পিতাকে সম্বোধন করে বললেন, তোমার এ ছেলেকে পটিয়া পাঠিয়ে দাও। পরবর্তীতে একটি চিঠিতেও তিনি এ বিষয়ে জোর তাগিদ দেন। এদিকে হযরতের উপর মুফতী সাহেবের দৃষ্টির ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মুফতী সাহেব সফর শেষে প্রত্যাবর্তন করলে, বিচ্ছেদ বেদনায় হযরত কাতর হয়ে পড়েন।

৩.২.৩ মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়ায় ভর্তি: অবশেষে ১৩৭২ হি. এর শাওয়াল মাসে হযরত মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়ায় ভর্তি হন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি পূর্ণ মার্ক অর্জন করে কাঙ্ক্ষিত শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পান। এখানেই তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ আসাতিযায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে তার সুপ্ত মেধা ও প্রতিভা। পটিয়া মাদরাসায় ভর্তি হওয়াকে হযরত স্বীয় জীবনকথায় জীবনের নতুন মোড় তথা নতুন দিগন্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পটিয়া মাদরাসার তরবিয়ত সেখানকার রূহানী ও নুরানী পরিবেশে ইলম চর্চার সময়কালকে হযরতের ছাত্রজীবনের বসন্তকাল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সে সময়কার বর্ণনা দিয়ে পরবর্তিতে অনেক কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

৩.২.৪ সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ: পটিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালীন পাঠ্যক্রমের নিয়মিত পড়ালেখার সাথে সাথে চলতে থাকে উর্দু, ফারসী ও আরবী সাহিত্যের অনুশীলন। এ ব্যাপারে স্বয়ং মুফতী সাহেব রহ. ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন এবং তত্ত্বাবধান করতেন। হযরতের নিজস্ব অধ্যবসায়, আগ্রহ ও সহজাত প্রতিভার সাথে মুফতী সাহেব রহ. মুফতী ইবরাহীম রহ. সহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে হযরতের মেধার এমন স্ফূরণ ঘটে যে, মাদরাসার বার্ষিক রিপোর্টগুলোতে ছাত্রদের সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্ম হিসেবে প্রকাশিত রচনার মধ্যে তার রচিত উর্দু, ফারসী, আরবী বিভিন্ন কবিতা নিয়মিত স্থান পেত। এমনকি গণ্যমান্য মেহমানের মানপত্র রচনা ও উস্তাদদের বিভিন্ন ইলমি সহায়তা তিনি সূচারুরূপে আঞ্জাম দিতেন। উর্দু সাহিত্যে তো হযরতের পরিপক্কতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, স্বয়ং উর্দুভাষীরাও তার ভাষাগত প্রাঞ্জলতায় বিস্ময় প্রকাশ করতো।

৩.২.৫ অন্যান্য প্রিয় বিষয়: হযরতের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল ভাষা ও সাহিত্য। এরপর অন্যান্য প্রিয় বিষয়ের মধ্যে ছিল হাদীস ও ফিক্বহ। কিন্তু তিনি এ বিষয়গুলোতে ‘তাখাসসুস’ করার সুযোগ পাননি।

৩.৩ দাওরা হাদীস ও প্রাথমিক লেখাপড়ার সমাপ্তি: আল্লামা সুলতান যওক নদভী পটিয়া মাদরাসায় সুদীর্ঘ ছয় বছর লেখাপড়া করে ১৩৭৮ হি. মোতাবেক ১৯৫৯ সালে ইসলামী শরীয়াহ বিভাগ হতে প্রথম শ্রেণীতে ১ম হয়ে দাওরায়ে হাদীসের সনদ অর্জন করেন। দস্তারবন্দী অনুষ্ঠানে হযরতকে পাগড়ী পরিয়ে দেন চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ শাহ আব্দুর রহমান চূড়ামনী রহ.। এরই মাধ্যমে হযরতের প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়ার সমাপ্তি ঘটে।

৩.৪ যাদের পরশে ধন্য তিনি: প্রাথমিক পড়াশুনার ক্ষেত্রে আল্লামা সুলতান যওক নদভী যাদের সানিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন তাদের নাম ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবন্ধের এ পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী দাওরা হাদীস পর্যন্ত যাদের কাছে ইলমের সুধা পানে ধন্য হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম নিম্নে দেয়া হল।
১. আল্লামা মুফতী আযীযুল হক রহ., প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়া।
২. আলহাজ্জ মাওলানা মুহাম্মদ ইউনুছ রহ., সাবেক মুহতামিম।
৩. হযরত মাওলানা ইমাম সাহেব মোহরভী রহ.
৪. হযরত মাওলানা আমীর হোসাইন মীর সাহেব রহ.
৫. হযরত মাওলানা ইছহাক গাজী সাহেব রহ.
৬. হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম সাহেব রহ.
৭. হযরত মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী রহ.
৮. হযরত মাওলানা ইসহাক হ্নীলভী রহ.
৯. হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ রহ.
১০. হযরত মাওলানা ইহসানুল হক সন্দীপী দা. বা. প্রমুখ।

৩.৫ বর্হিবিশ্বের যে সকল মনীষীদের কাছ থেকে হাদীছের সনদ অর্জন করেছেন:
হাদীসের উচ্চতর সনদের প্রত্যাশায় তিনি বিদেশের বহু প্রথিতযশা মুহাদ্দিসদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছেন। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন,
১. তিরমিযী শরীফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ মা‘আরিফুস সুনান এর রচয়িতা আল্লামা সৈয়দ ইউসুফ বিন্নুরি রহ. পাকিস্তান- ১৯৫৮ সাল।
২. হাদীস বিশারদ (হাফেজুল হাদীস) আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রহ. পাকিস্তান- ১৩৯০ হিজরী।
৩. মুয়াত্তা মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওজাজুল মাসালিকের রচয়িতা শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মাদ জাকারিয়া কান্দলভী রহ. পাকিস্তান- ১৯৭৭ সাল।
৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৫. আল্লামা মঞ্জুর নোমানী রহ.- ১৪০১ হিজরী।
৬. দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. – ১৯৭৮ সাল।
৭. হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. প্রধান শিক্ষক দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৮. হযরত মাওলনা মে’রাজুল হক রহ. মুহাদ্দিস দারুল উলুম দেওবন্দ- ১৯৭৮ সাল।
৯. সিরিয়ার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দেস আল্লামা শেখ আব্দুল ফততাহ আবু গুদ্দাহ রহ.- ১৪১৩ হিজরী।
১০. হযরত মাওলানা আশেক ইলাহী আল-বরনী রহ. (মুহাজিরে মদীনা) – ১৪১৮ হিজরী।

৪. কর্মজীবন :
৪.১ শিক্ষকতা : ইলমচর্চা যারা করে তাদের পিপাসা কখনো নিবৃত হয়না। উত্তরোত্তর পিপাসা আরো বাড়তে থাকে। শিক্ষা সমাপনের পর হযরতের ইলমী স্পৃহার মধ্যে কোন ভাটা পড়েনি। তার একান্ত ইচ্ছা যা তিনি সময়ে সময়ে ব্যক্ত করে থাকেন, ইলমচর্চা ও খেদমতে জীবন অতিবাহিত করা। হযরতের পিতার ইচ্ছেও ছিল সেটাই। তাই হযরতের বর্ণাঢ্য জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ফারাগাতের পর থেকে অদ্যবধি অধ্যয়ন ও জ্ঞান বিতরণে হযরত নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছেন।

৪.১.১ মাদরাসা রশিদিয়ায় ও জামিয়া ইমদাদিয়ায়: ফরাগাতের পর বিভিন্ন মাদরাসার পক্ষ থেকে হযরতের জন্য শিক্ষকতার প্রস্তাবনা আসতে থাকে। মাদরাসার জিম্মাদররা মুফতী সাহেব রহ. এর নিকট আবেদন করতে লাগলেন যাতে হযরতকে তাদের প্রতিষ্ঠানের পাঠানো হয়। পরবর্তীতে মুফতী সহেব রহ. এর ইঙ্গিতে হযরত বশরত নগর মাদরাসার শিক্ষকতার দায়িত্বে যোগদান করেন। এখানে হযরতকে গুরুত্বপূর্ণ হাদীগ্রন্থ ‘মিশকাত শরীফ’ ফিক্বহে হানাফীর অন্যতম কিতাব ‘হিদায়া’ (১ম ও ৩য় খন্ড) আরবী সাহিত্যের কিতাব ‘দিওয়ানে মুতানাব্বী’ এর মত গুরুত্বপূর্ণ কিতাব পড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। হযরত তার দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে থাকেন এবং অল্পসময়ের মধ্যে বোদ্ধা মহলের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হন। স্বয়ং মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মফজল আহমদ রহ. (মৃ. ১৩৯২হি.) ও হযরতের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এখানে প্রায় দুই বছর হযরত শিক্ষকতা করেন। পরে ১৯৬০ ঈসায়ীতে নেজামে ইসলামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা হযরত আতহার আলী রহ. এর আহবানে কিশোরগঞ্জের তদানীন্তন বিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়াতে চলে যান। এবং সেখানেও অল্প কিছুদিন (জুমাদাল উখরা ১৩৮০-শাবান ১৩৮০) অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পাঠদান করেন।

৪.১.২ মাদরাসা হুসাইনিয়ায় মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন: ১৩৮০ হিজরীর রমজানের ছুটিতে হযরত বাড়িতে আসেন। এসময় তার শ্বশুর মাদরাসা হুসাইনিয়া ইয়াহইয়াউল উলুম এর মুহতামিম মাও. আলী আহমদ বোয়ালভী রহ. সৌদি আরবে হিজরতের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাই তিনি হযরতকে মাদরারসার দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই হযরত মাদরাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

৪.২ ইলম অর্জনের মাতুলালয়ে: মুফতী আযীযুল হক রহ. এর ইচ্ছে ছিল হযরতকে পটিয়াতে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসবেন। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুর কারণে মুফতী সাহেব এর জীবদ্দশায় আর সেটি সম্ভব হয়নি। তথাপি ১৩৮১ হিজরী এর রমজান মাসে মাদরাসায়ে জমিরিয়ার (পটিয়া মাদরাসা) তৎকালীন মুহতামিম হাজী ইউনুছ রহ. এর আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি ইলম অর্জনের মাতুলালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

৪.২.১ শিক্ষক হিসেবে সুখ্যাতি: মাদরাসা জমিরিয়া পটিয়াতেই মূলত হযরতের শিক্ষকতা প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তার শিক্ষকতার শৈল্পিকগুণে ছাত্র শিক্ষক সকলেই প্রীত হন। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হযরতের প্রমোশন হতে থাকে। হাদীস, ফিক্বহ ও আরবী সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের দায়িত্ব হযরতের কাঁধে আসতে থাকে। তিনি নিজ থেকে বলে কয়ে কখনো উপরের ক্লাসের দায়িত্ব নেন নি। অনেকটা জোর করেই তাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হত। আর তিনি প্রায়শই অপারগতা প্রকাশ করতেন। হযরতের শিক্ষকতার শৈল্পিকগুণে দায়িত্বশীলবৃন্দ এতই সন্তুষ্ট ছিলেন যে, পরবর্তীতে যখন মাদরাসার জন্য ভবিষ্যৎ শায়খুল হাদীস হওয়ার জন্য একজন মুহাদ্দিস এর প্রয়োজন দেখা দিল তখন সকলের দৃষ্টি হযরতের উপর নিবন্ধ হল। এ লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে হযরতকে তিরমিযী শরীফের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

৪.২.২ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ: পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতার সময়ে হযরতের সৃজনশীল মানসিকতার উন্মেষ ঘটে। এসময় সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায় মনোনিবেশ করেন। আরবী ভাষা একাডেমী প্রতিষ্ঠা, এবং গুণীজন সমাদৃত ‘আসসুবহুল জদীদ’ নামক ত্রৈমাসিক আরবী পত্রিকাটি তার উন্নত মানসিকতার পরিচয় বহন করে। সে সময়ে লেখালেখি ও কাব্যচর্চায় পটিয়া মাদরাসার বেশ সুনাম সুখ্যাতি ছিল। হযরতের তত্ত্বাবধানে তা আরো বেগবান হয় এবং মাদরাসা পরিম-লের বাইরেও এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যানুরাগী ছাত্ররা বক্তৃতা, প্রবন্ধ লেখা, কাব্যচর্চা প্রভৃতি ক্ষেত্রে হযরতের কাছে উপকৃত হতে থাকে। হযরতের সান্নিধ্যে উপকৃত হওয়া এসব ছাত্ররা পরবর্তীতে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। আরবী, উর্দু ও ফারসী তিন ভাষাতেই হযরতের দখল ছিল। এসময় তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন আসরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং বোদ্ধা মহলে সুপ্রশংসিত হন।

৪.২.৩ পটিয়া ত্যাগ: পটিয়া মাদরাসা থেকে হযরত দু‘বার নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইস্তফা দিয়েছিলেন। উভয় ইস্তফার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই হলেও পরিস্থিতি ছিল কিছুটা ভিন্ন। মূলত শিক্ষা কারিকুলামের সংস্কার ও উন্নয়নের চিন্তাই ছিল হযরতের ইস্তফার মূল কারণ।

প্রথম ইস্তফা: ১৩৮৫ হি. মোতাবেক ১৯৯৬ ঈসায়ী সালে একটি যুগোপযোগী আদর্শ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মানসে তিনি প্রথমবারের মত পটিয়া ত্যাগ করেন এবং সমমনা বন্ধুবর মাওলানা কামাল উদ্দীন রহ. কে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদে কাসেমুল উলুম নামে একটি আদর্শ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দু‘বছর যেতে না যেতেই কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং মাওলানা হারুন বাবুনগরী রহ. (মৃ. ১৪৩৫ হি.) এর আহবানে সাড়া দিয়ে মাদরাসায়ে আযীযুল উলুমে যোগদান করেন। অতপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে নিজ দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
২য় দফা যোগদান ও ইস্তফা: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পটিয়ার মুরব্বীয়ানে কেরামের আহবানে হযরত দ্বিতীয় দফা (১৩৯২হি.) যোগদান করেন। অতপর প্রায় ১৪ বছর শিক্ষকতার পর ১৪০৫হি. তে ২য় দফা ইস্তফা দেন। হযরত পূর্ব থেকেই একটি আদর্শ যুগোপযোগী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতার এ পর্যায়ে এসে তিনি সে প্রয়োজনকে লিখনীর মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেন। কলমের আগায় ফুটিয়ে তোলেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার বিখ্যাত সেই প্রবন্ধ ‘মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারের ডাক’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হযরতের এই লেখাকে পুঁজি করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। হযরত চাইলে তৎক্ষণাৎ এই ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতে পারতেন। তথাপি তিনি সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে স্বীয় লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ২৬শে শাবান ১৪০৫ হিজরী সনে ২য় বারের মত ইস্তফা দেন।

৪.৩ উল্লেখযোগ্য শিষ্যবৃন্দ:
১. মুহাম্মদ আইয়্যুব রহ. সাবেক শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালক- পটিয়া মাদরাসা।
২. মাওলানা আনোয়ার শাহ, পরিচালক, জামিয়া ইমদাদিয়া, কিশোরগঞ্জ।
৩. মাওলানা আব্দুল হালীম বুখারী, পরিচালক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া।
৪. মাওলানা রফিক আহমদ, মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া।
৫. মাওলানা আব্দুল মালেক হালিম, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, হাইলধর মাদরাসা, আনোয়ারা।
৬. মাওলানা হাফেজ হেলালুদ্দীন, দায়ী, মারকাযুদ্দাওয়াহ, আরব আমিরাত।
৭. মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কলামিস্ট, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মাদরাসাতুল মাদীনা, ঢাকা।
৮. ড. রশীদ রাশেদ, সমাজকর্মী, সিডনী, অস্ট্রেলীয়া।
৯. মাওলানা আবু তাহের, মুহাদ্দিস, জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া।
১০. ড. মাহফুজুর রহমান, অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
১১. মাওলানা জসীমুদ্দীন নদভী, মুহাদ্দিস, জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া।
১২. মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নসীম নদভী, সহ-সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব।
১৩. মাওলানা হাফেজ জুনাইদ শওক (বাবুনগরী), মুহাদ্দিস, হাটহাজারী মাদরাসা।
১৪. মাওলানা মুহাম্মদ আইয়ুব, মুহাদ্দিস, বাবুনগর মাদরাসা।
১৫. মাওলানা ড. মুস্তফা কামিল, সহ-অধ্যাপক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
১৬. মাওলানা আফীফ ফুরকান, দায়ী সৌদি ধর্ম মন্ত্রনালয়। সিনিয়র শিক্ষক জামেয়া দারুল মা‘আরিফ।
১৭. মাওলানা এনামুল হক সিরাজ, দায়ী সৌদি ধর্ম মন্ত্রনালয়। সিনিয়র শিক্ষক জামেয়া দারুল মা‘আরিফ।

৫. সংস্কার:
যুগের বিবর্তনে, প্রজন্মান্তরে মানুষের জীবনে নতুন নতুন সমস্যা ও চাহিদার উদ্ভব হয়। তাই জীবন ঘনিষ্ট বিষয়গুলোতে সময়ের চাহিদার আলোকে সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা একটি চিরন্তন সত্য যা উপেক্ষা করার কোন জো নেই। মহান রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হাতেই সাধিত হয় এ সমস্ত সংস্কার কার্যক্রম। আল্লামা সুলতান যওক নদভী তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব যিনি একজন সংস্কারক হিসেবে নিজেকে নিবেদিত করেছেন।

৫.১ শিক্ষা সংস্কার: আল্লামা সুলতান যওক নদভী এর সংস্কার ধর্মী কার্যক্রমের অন্যতম দিক হল শিক্ষা সংস্কার। এ ক্ষেত্রে হযরত মনে করেন – এবং তা বাস্তবও- বর্তমান দ্বীনী মাদরাসাগুলো বিশুদ্ধ আক্বীদা সংরক্ষণ, ও ইসলামী কৃষ্টি কালচারের দূর্গ হওয়া সত্ত্বেও যুগের চাহিদা মেটাতে পারছে না। একটা সময় ছিল যখন এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইসলামের সেবক বেরিয়ে আসতেন এবং সমাজের সর্বস্তরের এবং সব ধরনের চাহিদা পূরণ করতেন। কিন্তু বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাঝে এত দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে যেন দু‘টোকে সম্পূর্ণ আলাদা সমাজ। ফলে ইসলামের সুমহান উদ্দেশ্য তথা সমাজের সর্বস্তরে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার কাজে ব্যঘাত ঘটছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন: “অত্যন্ত দু:খের বিষয় যে, চিন্তা-চেতনা ও ইলমী অধ:পতনের এই যুগে আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বের ন্যায় ফলাফল দিতে পারছেনা…”। তিনি আরো বলেন, “সৌকর্যমণ্ডিত ঐতিহ্যবাহী এসমস্ত মাদরাসার অধিকাংশই বর্তমানে জড়তা ও স্থবিরতা শিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ সংস্কার ও যুগোপযোগী প্রজন্ম তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।… আমরা বিশ্বাস করি ক্রমবর্ধমান এ রোগের দ্রুত চিকিৎসা সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে…”। অন্য স্থানে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণী ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে”। এসমস্ত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মাদরাসা শিক্ষা কারিক্যুলামে সংস্কার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

৫.১.১ সনাতনী চিন্তাধারা: শিক্ষা সংস্কারের এই চিন্তাধারা নব কল্পনাপ্রসূত কোন চিন্তাধারা নয়। বরং যুগ যুগ ধরে বিদগ্ধ ওলামায়ে কেরাম, আকাবীরে হযরাতগণ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। তবে আল্লামা সুলতান যওক নদভীর সফলতা হল তিনি তার চিন্তাধারাকে কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রায়োগিক রূপে একটি কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।

৫.১.২ যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ণ: উক্ত চিন্তাধারার আলোকে আল্লামা সুলতান যওক নদভী ইসলামের মৌলিক শিক্ষা-দীক্ষা অক্ষুণ্ন রেখে প্রয়োজনীয় আধুনিক বিষয়াদি অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে হযরতের ভাষায়: الجمع بين القديم الصالح والجديد النافع তথা কল্যানকর পুরাতন ও উপকারী নতুনের সমন্বয়ে একটি পরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন।
৫.১.৩ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তথা দারুল মা‘আরিফ প্রতিষ্ঠা: ইতোপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, আল্লামা সুলতান যওক নদভী তার চিন্তাধারা ও পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দান করে একটি কাঠামোর উপর দাঁড় করিয়েছেন। এই কাঠামোই হল আজকের দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়া। বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে তিনি তার প্রস্তাবিত পরিকল্পনার আলোকে বিশ^বরেণ্য আলেমে দ্বীন আল্লামা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর দিকনির্দেশনায় দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামের সাথে পরামর্শপূর্বক ১৯৮৫ ঈসায়ী মোতাবেক ১৪০৫ হি. এর শাওয়াল মাসে এ প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। স্বল্প পরিসরে শুরু হওয়া এ প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়ের মধ্যে মহীরূহে পরিণত হয় এবং দেশ-বিদেশে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। বর্তমানে তার প্রস্তাবিত ক্যারিকুলাম এ বহু মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।

৫.২ সমাজ সংস্কার: সমাজ সংস্কারেও আল্লামা সুলতান যওক নদভী ব্যাপক অবদান রেখে যাচ্ছেন। ইসলামের সুমহান বানীকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে আজো তিনি ছুটে যান টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। মানুষকে গোমরাহী থেকে ফিরিয়ে আল্লাহমূখী করা এবং সমাজ থেকে অন্যায়-পাপাচার দূর করার জন্য তিনি মানুষদেরকে নসীহত করেন। প্রতিবছর এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অসংখ্য মাহফিলে তিনি উপস্থিত হয়ে মানুষের ধর্মীয় পিপাসা নিবারণ করে যাচ্ছেন।

৬. জাতীয় স্বার্থে নি:স্বার্থ অবদান:
৬. জাতীয় স্বার্থে নি:স্বার্থ অবদান : আল্লামা সুলতান যওক নদভী এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সর্বদা ধর্মীয় ও জাতীয় স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি এ মানসিকতার উপর গড়ে ওঠেন। ফলশ্রুতিতে জাতীয় বিভিন্ন স্বার্থে তিনি ব্যপক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

৬.১ ফিতনা মোকাবেলা: জাতীয় স্বার্থে হযরতের অন্যতম অবদান হল সময়ে সময়ে আপতিত বিভিন্ন ফিতনার বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার জন্য তিনি এগিয়ে এসেছেন এবং প্রয়োজনে রাজপথের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

৬.১.১ কাদীয়ানী ফিতনা: মুসলিম উম্মাহ বিশেষভাবে উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি বড় ফিতনা হল কাদিয়ানী ফিতনা ইসলামের মূলে কুঠারাঘাতকারী এ ফিতনা ২০০৪/০৫ ঈ. সনে বাংলাদেশে ব্যাপকহারে মাথাচড়া দিয়ে উঠে। জাতীয় দুর্যোগের এই মুহূর্তে আল্লামা সুলতান যওক নদভী খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট বাংলাদেশের ব্যানারে রাজপথে নেমে আসেন। কাদিয়ানীদেরকে সরকারীভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন করেন ফলশ্রুতিতে এ ফিতনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। এ সময় তিনি খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট বাংলাদেশ এ সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন।

৬.১.২ ফতোয়া বিরোধী হাইকোর্টে রায়: কিছু কিছু মানুষের ফতোয়ার অপব্যবহার ও ইসলামবিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রের কারণে দেশব্যাপী ফতোয়া সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। ফলে হাইকোর্ট কর্তৃক ২০১১ সনে ফতোয়া নিষিদ্ধের রুল জারি করে। ফলে দেশব্যাপি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ইসলামী ফাউ-েশনে এ ব্যাপারে এক জরুরি সভা আয়োজন করা হয়। এ সভায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ২৫ জন আলেম অংশ নেন। এভাবে বিভিন্ন আলোচনা ও পরামর্শের পর হাইকোর্ট রায় প্রত্যাহার করে এবং শর্তসাপেক্ষে ফতোয়া বৈধ ঘোষণা করে। উক্ত সভাসহ এ আন্দোলনে আল্লামা সুলতান যওক নদভী বিশেষ অবদান রাখেন।

৬.১.৩ নারী নীতিমালা: ২০১১ সনেই আরেকটি জাতীয় সমস্যার উদ্ভব হয়। সরকার নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ এর খসড়া প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করে। এ নীতিমালার বেশ কয়েকটি ধারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। ফলে আল্লামা সুলতান যওক নদভীসহ দেশে শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রাস্তায় নেমে আসেন। ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে আল্লামা সুলতান যওক নদভী সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন। ফলে সরকার কিছুটা নমনীয়তা অবলম্বন করেন।

৬.১.৪ নাস্তিকতার ফিতনা: বিগত কয়েক দশকের মধ্যে যে, ফিতনাটি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে তা হল নাস্তিকতার ফিতনা। এটি এমন এক ফিতনা যার অশুভ পরিণাম জাতিকে আজো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নাস্তিকতা যদিও সকল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অধিকন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ফিতনাটি মূলত ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতিসাধনেই ব্যপ্ত রয়েছে। সময়ে সময়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নাল, পত্র-পত্রিকায় ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কার্টুন, লেখা প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়েছে বিশেষভাবে বিগত ২০১৩ সনের সূচনালগ্নে ইসলামবিদ্বেষী এ ফিতনাটি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তখন এদেশের জনগন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ব্যানারে অন্দোলনে রাজপথে নেমে আসে। ইতোপূর্বে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠায় আল্লামা সুলতান যওক নদভীর অগ্রগন্য ভূমিকা থাকলেও কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি সংগঠন থেকে কিছুটা দূরে সরে ছিলেন। অতপর জাতির এই দূর্দিনে তিনি উদারতার পরিচয় দিয়ে হেফজতের ব্যানারে আন্দোলনের প্রথম কাতারে রাজপথে নেমে আসেন।

৬.২ রাজনৈতিক চিন্তাধারা: আল্লামা সুলতান যওক নদভী সরাসরি কোন রাজননৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব ও করেন না। তদুপরি বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ দেয়াকে তিনি দ্বীনী দায়িত্ব মনে করেন। রাজনৈতিক ময়দানে যে বিষয়টি তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে তা হল, ইসলামী রাজনীতির পতাকাবাহী ওলামায়ে কেরামের বহুধা বিভক্তি। তিনি মনে করতেন, এ সকল দলগুলোর আক্বীদা, ভাবধারা, রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যেহেতু এক সেহেতু সবাই ঐক্যমত্য হয়ে একদলে অন্তর্ভূক্ত হওয়া কঠিন কিছু নয়।

৬.২.১ ঐক্য সংহতির প্রচেষ্টা: অবশেষে এই চিন্তায় তাড়িত হয়ে তিনি মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করলেন। শায়খে কৌড়িয়া রহ., আল্লামা আহমদ শফী দা. বা., মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ. প্রমূখের সাথে পরামর্শ করতে লাগলেন। ১৯৯২ এর সূচনালগ্নে আল্লামা আহমদ শফী দা. বা. ও মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী রহ. কে নিয়ে চান্দগাঁও আবাসিকস্থ স্বীয় বাসভবনে পরামর্শ বৈঠক করেন। এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫মে ১৯৯২ সনে ঢাকার মুহাম্মদপুরে অবস্থিত জামেয়া মুহাম্মদিয়ায় জামায়াতে ইসলামী ব্যতীত অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে আল্লামা আহমদ শফী দা. বা. এর সভাপতিত্বে একটি পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সমস্ত খরচ আল্লামা সুলতান যওক নদভী ও মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী যৌথভাবে বহন করেন। এ সভায় শায়খুল হাদীস আযীযুল হক রহ., চরমোনাইর পীর মাওলানা ফজলুল করীম রহ., মুফতী ফজলুল হক আমীনী রহ. ও জমীয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রতিনিধিরা তাশরীফ আনেন। এ সভায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব না হওয়ায় পরবর্তী জুলাই মাসে পুনরায় মিটিং হয়। এই মিটিংয়ে ইসলামী দলগুলোর নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম অংশ নেন।

৬.২.২ প্রচেষ্টার ফল: আল্লামা সুলতান যওক নদভী ও অন্যান্য আয়োজকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ট সত্ত্বেও কিছু মানুষের হঠকারীতা ও অসহযোগীতামূলক আচরনের কারণে সকল দলের সমন্বয়ে একক ইসলামী দল গঠন সম্ভব হয়নি। তবে ২য় বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ প্রদানের জন্য ‘সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন করা হয়। হযরতকে জোরপূর্বক এর সদস্য সচিবের দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিস্থিতির মুখে হযরত এ পদ থেকে ইস্তফা দেন।

৬.৩ কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতি: বাংলাদেশের কওমী মাদরাসার সার্টিফিকেটের সরকারী স্বীকৃতি না থাকায় কওমী পডুয়া ছাত্রদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সমাজের সর্বস্তরে তারা কাজ করার সুযোগ পায়না। লেখা-পড়া শেষ করার পর এদের কর্মক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেক ছাত্রকে হীনমন্যতায় ভুগতে দেখা যায়। অনেকে আবার মাঝপথে ঝরে পড়ে। শেষোক্ত শ্রেণীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে আবার সরকারী সার্টিফিকেটের জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এদের অনেকেই দুদিকের লেখাপড়ার চাপ সামলাতে না পেরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারছে না। তাই কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতি সময়ের অনিবার্য দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের এ দাবী পূরণের লক্ষ্যে আল্লামা সুলতান যওক নদভী স্বীয় অবস্থান থেকে চেষ্টা চালাতে থাকেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৪ সনে সরকার কওমী মাদরাসার দাওরা হাদীসকে মাস্টার্স এর সমমান দেয়ার ঘোষনা দেয়। অবশ্য দেশের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বিষয়টি এখনো কার্যকর হয়নি। বিগত ২০১২ সনে সরকার এ লক্ষ্যে কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। হযরতকে এ কমিশনের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত করা হয়।

৬.৪ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর বাংলাদেশ সফর: বাংলাদেশের জনগনের প্রতি আল্লামা সুলতান যওক নদভীর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে, তিনি বিশ^বরেণ্য ইসলামী চিন্তানায়ক কিংবা শতাব্দীর অন্যতম ইসলামী ব্যক্তিত্ব আল্লামা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর কর্মপরিধির আওতায় এদেশকে সম্পৃক্ত করা। এ প্রসঙ্গে আল্লামা নদভী রহ. নিজেই বলেন, “এদেশে আসা এবং এখানকার মুসলমানদের অবস্থার ব্যাপারে অবগত হওয়া আমার উপর এক নৈতিক দায়িত্ব ছিল যা পালন করতে অনেক বিলম্ব হয়ে গেল।”
যাই হোক ১৯৮৪ সনের ৯মার্চ-২০মার্চ পর্যন্ত আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ. এর এই সফর শুধুমাত্র হযরতের প্রচেষ্টাতেই হয়েছিল। এক চিঠিতে আল্লামা নদভী রহ. হযরতকে লিখেন, “প্রকৃতপক্ষে আমার এ সফর আপনার ভালবাসা ও সম্পর্কের কারণে করা হয়েছিল। আমার কাছে প্রকৃত উদ্যোক্তা, দাওয়াতকারী ও মেজবান আপনিই ছিলেন।”

৬.৪.১ সফরের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব: আল্লামা নদভীর এ সফর বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এর প্রভাব ছিল অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী। আল্লামা নদভীর প্রতিটি ভাষণই এদেশের ইসলামী পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কিশোরগঞ্জের জামেয়া ইমদাদিয়াতে তিনি “আলেম সমাজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লাগাম হাতে নেয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে প্রকৃত ভাষণটির কথা। ইতোপূর্বে ইসলামী পরিমন্ডলে বাংলা সাহিত্যের চর্চা ছিলনা বললেও অত্যুক্তি হবে না। অথচ এ ভাষণের তিন দশক পর আজ অপর্যাপ্ত হলেও বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অঙ্গন বহু আলেমের পদচারণায় মুখরিত।
এ সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল এই যে, আল্লামা নদভী স্বীয় শিষ্য আল্লামা সুলতান যওক নদভীর কাজের জন্য একটি স্বতন্ত্র প্লাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সে অনুযায়ী হযরতকে দিক-নির্দেশনা দেন। আর সেই নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের দারুল মা‘আরিফ। মোট কথা, আল্লামা নদভীর এ সফরের প্রভাব ও সুফল এ জাতি আজো ভোগ করে চলেছে।

৭. সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদান:
৭.১ বাংলাদেশের আরবী সাহিত্যের দিকপাল: আল্লামা সুলতান যওক নদভীকে বলা যায় বাংলাদেশের আরবী সাহিত্যের দিকপাল। এদেশের আরবী সাহিত্য চর্চা, লালন ও পৃষ্ঠপোষকতায় তার অবদান অনস্বীকার্য। ছাত্রজীবনে সাহিত্য প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে কর্মজীবনে এসে এ ময়দানে নিরন্তর সেবা করে যাচ্ছেন। আশির দশকের সূচনালগ্নে তার সুদক্ষ তত্ত্বাবধানে সাহিত্যচর্চায় আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া বিশ্বব্যাপি খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়। ‘আস-সুবহুল জদীদ’, ‘মানারুশ শারক’ এর মত মানসম্পন্ন পত্রিকা তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়। তার রচিত ও সংকলিত আরবী সাহিত্যের বেশ কিছু কিতাব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ১৯৮২ ঈসায়ী সনে লিবিয়ায় ৩৬টি দেশের ৭৪ জন প্রতিযোগীর মধ্যে “الإسلام والمرأة” নামে আরবী প্রবন্ধ লিখে ২য় স্থান অধিকার করেন। অন্যান্য যোগ্যতার পাশাপাশি বিশেষভাবে এ যোগ্যতার কারণে নদওয়াতুল ওলামা থেকে তাকে সম্মানসূচক ‘নদভী’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। আরবী সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি আজো “রাবেতাতুল আদবিল ইসলামী” এর বাংলাদেশ ব্যুরো এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

৭.২ উর্দু ও ফারসী: আরবী সাহিত্যের পাশাপাশি আল্লামা সুলতান যওক নদভী এর উর্দু ও ফারসী সাহিত্যেও যথেষ্ট দখল রয়েছে। উর্দু ভাষায় তার গভীরতায় দিল্লী-লক্ষ্মৌ ওয়ালারাও আশ্চর্যবোধ করে। এ দুটি ভাষায় তার বেশ কয়েকটি কিতাব রয়েছে।

৭.৩ কাব্য প্রতিভা: আল্লামা সুলতান যওক নদভী স্বভাবজাত ভাবেই কাব্যপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আরবী, উর্দুতে তার বেশ কিছু কবিতা সংকলন রয়েছে। তরুণ বয়সে তার একটি আরবী কবিতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক আল্লামা কাশগরী রহ. এর হস্তগত হলে তিনি তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

৭.৪. সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক: সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায়ও আল্লামা সুলতান যওক নদভী এর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। পটিয়া-বাবুনগর শিক্ষকতার সময়ে তিনি ছাত্রদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। আর বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া দারুল মা‘আরিফে তো ‘আন-নাদী আস-সাক্বাফী আল-ইসলামী’ নামক একটি সাংস্কৃতিক ফোরাম রয়েছে যা প্রতিষ্ঠানের প্রাণস্পন্দন হিসেবে বিবেচিত হয়। এ সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত তৎপরতাগুলো এতই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর আলোকে সাংস্কৃতিক ফোরাম তৈরি করেছে।

৮. বহির্বিশ্বের সফর ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত: আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সেমিনার ও দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বহুদেশে সফর করেছেন। নিম্মে সফরগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পেশ করা হল।

১. ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সেমিনারে যোগ দিতে তিনি ভারত গমন করেন। উক্ত সেমিনারে তিনি ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে আরবী সাহিত্য পাঠ নির্বাচন’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বেশ প্রশংসিত হন। সেমিনারে অংশগ্রহষেণর সুবাদে ইসলামী জগতের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিক ও করিদের সাথে তার পরিচিতি ঘটে। এ সফরে আল্লামা সুলতান যওক নদভী রহ, নদওয়ার বিশিষ্ট উস্তাজ মাওলানা রাবে হাসানী নদভী, ড. সাঈদুর রহমান আল-আজমী, মাওলানা ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভী, মাওলানা ওয়াজেহ রশিদ নদভী প্রমূখের মত আন্তর্জতিক ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সাথে বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ লাভ করেন।
২. ১৪০৫ হিজরী নব প্রতিষ্ঠিত আদর্শবিদ্যাপীঠ দারুল মা‘আরিফের পাঠ্যক্রমের উপর মতবিনিময় ও দিকনির্দেশনার জন্য তিনি ভারত গিয়ে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সহ অন্যান্য নদওয়ার শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের সাথে মিলিত হন। এ সফরে তিনি আল্লামা মঞ্জুর নোমানীর সাথে সাক্ষাত করে হাদীস বর্ণনার অনুমতি লাভ করেন।
৩. ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় সমস্যার পর্যালোচনার জন্য রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর আহ্বানে মক্কা মোকাররমায়া অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে যোগদান করেন। এ সফরে সৌদি সরকারের ব্যবস্থাপনায় বায়তুল্লাহ শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশের বিরল সুযোগ লাভ করেন।
৪. ১৪০০ হিজরীতে দারুল উলুম দেওবন্দের শত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে ভারত গমন করেন। সেখানে এক অধিবেশনে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সাথে সাক্ষাত হয়।
৫. ১৪০১ হিজরীতে নদওয়াতুল উলামার দাওয়াতে ‘শিক্ষা কারিকুলাম পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এ সফরে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. তাকে বাংলাদেশে নদওয়া চিন্তাধারার প্রতিনিধি বলে সম্মানিত করেন।
৬. ১৪০২ হিজরী মোতাবেক ১৮৮২ ইংরেজীতে তিনি গবেষণামূলক এক জ্ঞান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য লিবিয়ায় সফর করেন। বিশ্বের ৩৬ টি দেশের ৭৪ জন স্কলারের মধ্যে আল্লামা সুলতান যওক নদভী ‘ইসলাম ও নারী’ বিষয়ক প্রবন্ধের জন্য ২য় স্থান অধিকার করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন।
৭. ১৪০৬ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৬ সালে নদওয়াতুল ওলামা লক্ষ্মৌতে রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে লক্ষ্মৌ গমন করেন। এ সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল ‘ইখতিয়ারুন নুসুস আল আরবিয়্যাহ মিন বিজহাতে নযরিল ইসলামিয়্যাহ’। এ প্রবন্ধটি নদওয়া থেকে প্রকাশিত ‘আল বা‘সুল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
৮. ১৯৯০ সালে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত রাবেতা আল-আদব আল-ইসলামীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং ‘আল ইত্তেজাহাত আল আদবিয়্যা লি মুসতাওয়া আত তিফিল’ বাংলাদেশে শিশু সাহিত্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে প্রবন্ধটি ‘আল আদব আল ইসলামী’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
৯. ১৯৯২ সালে ভারতের রায়বেরেলী অঞ্চলে ‘বাংলাদেশে ইসলামী দাওয়াতের চর্চা’ শিরোনামে প্রবন্ধ নিয়ে এক সম্মেলনে যোগদান করেন।
১০. ১৯৮৪ সালে ‘জময়িয়াতুশ শাবাব,ভারত’ এর ব্যবস্থাপনায় ভারতের মাদ্রাসা সমূহে শিক্ষক্রমের উপর পর্যলোচনা শীর্ষক একটি সেমিনারে যোগ দিতে ভারত গমন করেন এবং সে সেমিনরের এক অধিবেশনে সভাপতির আসন অলংকৃত করার বিরল গৌরব অর্জন করেন।
১১. ১৯৯৯ সালে সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জাতীয় উৎসবে উপস্থিত হন। সেখানে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘দওরুল আরব ফি নশরিল ইসলাম ওয়াস সাকাফাতিল ইসলামিয়া ওয়াল বিলাদিল মুতাখমাহ।
১২. ২০০০ সালে বিয়াদস্থ কিং সউদ ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের শাসনব্যবস্থার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সৌদি রাজধানী রেয়াদে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে গমন করেন।
১৩.২০০০ সালে রাবেতা আল আদব আল ইসলামী’র ট্রাষ্ট বোর্ডের ১৫তম বৈঠকে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে মিশরের রাজধানী কায়রোতে সফর করেন এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালেও ১৬তম বৈঠকে তিনি কায়রোতে গমন করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৪. ২০০১ সালে সৌদি আরবের বাদশা ফাহাদের কর্মময় জীবন উৎসবে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে রাজধানী রিয়াদে উপস্থিত হন।
১৫. ২০০৪ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামী এর ১৭ তম ট্রাষ্ট বোর্ডের মিটিংয়ে অংশগ্রহণের জন্য মরক্কোর অন্যতম শহর ফাসে গমন করেন।
১৬. ২০০৬ সালে রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর ব্যবস্থাপনায় শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত ‘ইসলামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত হন। সেমিনারে তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয় ছিল ‘ইসলামে মানবাধিকার’।
১৭. ২০০৬ সালে কুয়েতস্থ আওকাফ ও ইসলামিক এফিয়ার্স মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় কয়েত গমন। সেখানে শেখ ড. ইফসুফ আল-হাজ্জী ও শেখ নাদের আন নুরী এবং বিশ্ব বরেণ্য ইসলাশী ব্যক্তিত্ব শেখ আব্দুল্লাহ আলী আল মতাওয়া এর সন্তানদের সাথে সৌজন্য সাক্ষতে মিলিত হন। এবং আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামায়’ তার প্রদত্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
১৮. ২০০৭ সালে ইসলামী শিক্ষা কনফারেন্সে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে হিন্দুস্থান সফর করেন। এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন।
১৯. জুন ২০০৮ সনে “সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ অবস্থান” শীর্ষক সেমিনারে যোগদানের জন্য সৌদি আরব সফর করেন এবং সৌদি বাদশাহর সাক্ষাৎ ও উপহার গ্রহণ করেন। এ সফরের বিশেষ আকর্ষণ ছিল হযরতের পবিত্র কাবাঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন।
২০. ২০০৯ সনে “সকল ধর্মের শান্তিপূর্ণ অবস্থান” শীর্ষক সেমিনারে যোগদানের জন্য কাতার সফর করেন।
২১. ২০১০ সনে সৌদি বাদশাহর সৌজন্য সাক্ষাত এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য সৌদি আরব গমণ করেন।
২২. ২০১২ সনে “মা‘হাদুশ শায়খ ইলিয়াছ রহ. ঢাকা” এর উদ্যোগে আরবী ভাষা ও সাহিত্য কর্মশালা সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। এ কর্মশালায় ৬০০০ এর অধিক ছাত্রের সমাবেশ ঘটে।
২৩. ২০১৩ সনে “منظمة التعاون الإسلامي-الايسسكو” কর্তৃক মদীনা মুনাওয়ারাকে ইসলামী সংস্কৃতির রাজধানী করার উপলক্ষ্যে আয়োজিত কনফারেন্সে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব সফর করেন।
এছাড়াও আফগানিস্তান, শ্রীলংকা, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য সেমিনার, কনফারেন্স, সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগদান করে দেশ ও জাতির কথা বিশ্বের গুনীজনদের সামনে তুলে ধরেছেন।

৯. রচনাবলী ও সাক্ষাৎকার: বহু ভাষাবিদ আল্লামা মুহাম্মাদ সুলতান যওক নদভী একজন সুসাহিত্যিক ও লেখক। বিভিন্ন ভাষায় তার অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, রচনা, সাক্ষাৎকার, কবিতা ‘আল বা‘সুল ইসলামী’ ‘আল মুজতামা‘আ’ ‘আল আদাবুল ইসলামী’ ‘আল আলামুল ইসলামী’ ‘আল ওয়াউল ইসলামী’ র মত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। তার রচনা সম্ভার অনেক বিস্তৃত। নিম্মে তার প্রকাশিত কিতাবের উল্লেখযোগ্য কয়েকটির তালিকা দেয়া হল।
১. আত্তরীকু ইলাল ইনশা (আরবী রচনাশৈলী)- ৩খন্ড
২. কাসাসুন নাবীয়্যীন টিকা- টিপ্পনী ও অনুশীলনী সংযোজন- ৩খন্ড
৩. যাদুত ত্বলিবীনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ (উর্দু)
৪. নুখবাতুল আহাদিস (হাদীস পুস্তিকা)
৫. শিক্ষা সংস্কারের ডাক (বাংলা ও আরবী ভাষায় প্রকাশিত)
৬. শিশুদের আরবী ভাষা শিক্ষা সিরিজ (১-৪) ক. ইশরুনা দরসান খ.আল-কিতাবুল আরবিয়্যাহ (২ খন্ড) গ. আল-কিরাতু লিররাশিদিন
৭. মুআল্লিমুল ফারসী
৮. রিহলাতী ইলা আরদিল জিহাদ ( আরবী ও বাংলাভাষায় প্রকাশিত)
৯. রাহবারে উর্দু
১০. আসান কাওয়ায়েদ (উর্দু)
১১. তাজকারয়ে আজিজ (মুফতি আজিজুল হক রহ. এর জীবনী)
১২. তাসলিয়াতুল কুলুব (হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হারুন বাবুনগরী রহ. এর জীবনী
১৩. আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৪. আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী (আরবী)
১৫. সাজারাত মিনান নুসুসিল আদাবিয়্যাহ (আরবী সাহিত্য সংকলন)- ২ খন্ড
১৬. কনদে খামাহ শরহে পন্দে নামাহ (উর্দু ভাষায় প্রকাশিত)
১৭. কুল্লিায়াতে যওক (স্বরচিত আরবী, ফারসী ও উর্দু কবিতা সংকলন)
১৮. আমার জীবনকথা
যে সমস্ত কিতাব প্রকাশের অপেক্ষায়:
১. লাহনুল ফুয়াদ (আরবী, উর্দু ও ফার্সী কবিতা সংকলন)
২. আত তালিকুজ জরুরী আলা মাকামাতে হারিরী
৩. আল জানেবুল বালাগী ফী শেরে মুতানাব্বী
৪. কালিমাতুন মুখতারাহ (স্বরচিত বিভিন্ন আরবী প্রবন্ধ সংকলন)
৫. আল খুতাবুল মিম্বারিয়্যাহ

১০ পারিবারিক জীবন:
১০.১ বিবাহ: হযরত মোট দুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ছাত্র জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কর্ম জীবনের সূচনালগ্নেই হযরতের প্রথম দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়। ফারাগাতের পর হযরতের পিতা ছেলের বিবাহের জন্য পাত্রী খুঁজতে থাকেন। মুফতী আযীযুল হক রহ. এর খলিফা বোয়ালিয়া মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী রহ. এর কন্যার ব্যাপারে তিনি খবর পান। ফলে মুফতী সাহেবের কাছে গিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এদিকে মাওলানা আলী আহমদ সাহেব ও মুফতী সাহেবের কাছে স্বীয় আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেন। অতপর ১৯৫৯ সনে কোন ধরণের আনুষ্ঠানিকতা ও আড়ম্বরতা ছাড়াই সাদাসিধেভাবে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। হযরত মুফতী সাহেব বিবাহ পড়ান এবং হযরত ইমাম সাহেব রহ. মুনাজাত করেন। হযরতের এই স্ত্রী কয়েক বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। তাছাড়া হযরত ১ম স্ত্রীর শেষ সময়ে ২য় বারের মত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১০.২ সন্তান সন্ততি: হযরত সর্বমোট ২ ছেলে ও ৫ কন্যার জনক। তন্মধ্যে ১ম স্ত্রীর পক্ষে ৪ কন্যা ও একপুত্র সন্তান জন্ম লাভ করেন। এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষের ১ পুত্র ও এক কন্যা জন্ম লাভ করে।

১০.৩. অনাড়ম্বর জীবন যাপন: হযরত ব্যক্তিজীবনে খুবই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন। বিশেষভাবে কর্মজীবনের শুরু থেকে নিয়ে দীর্ঘদিন হযরত পরিবার নিয়ে টিনশেড়ের ছোট্ট একটি কুটিরে থাকতেন। সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, “…সেই ঘরের আয়তন ছিল কোন মাদরাসার ছাত্রাবাসের একটি কক্ষ পরিমাণ। … সামান্য তুফান বা ঘুর্ণিঝড়ের আশংকা হলেই আমরা বেড-বিছানা বেঁধে ছেলে-পুলা সহ মাদরাসায় চলে যেতাম। এ হালতের উপর হযরত শুকরিয়া করতেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, আম্বিয়া ও আউলিয়ার আর্থিক অনটনের কিছু নমুনা জীবনের একাংশে দেখার সুযোগ হলো।

শেষকথা: বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা আল্লামা সুলতান যওক নদভীর বর্ণাঢ্য জীবনের উপর সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। কলেবরের সীমাবদ্ধতার কারণে তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিতে হয়েছে। সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে বিশদ আলোচনার দাবীদার বহু বিষয়কে। ফলে প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তার ব্যক্তিসত্ত্বার মূল্যায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আল্লাহর তাওফীক শামেলে হাল হলে ভবিষ্যতে প্রচেষ্টা চালানোর আশায় থাকতে হচ্ছে। পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা তিনি যাতে প্রবন্ধকারসহ সবাইকে এই মহান মনীষীর জীবন থেকে কিছু আলো সংগ্রহের তাওফীক দেন। আমীন!!

গ্রন্থপঞ্জি
১. নদভী, আল্লামা সুলতান যওক, আমার জীবন কথা, আলপনা প্রকাশন- ১৪৩৫ হি
২. মাওলানা জসীম উদ্দীন নদভী ও মাওলানা আলাউদ্দীন, আল্লামা সুলতান যওক নদভী: সংক্ষিপ্ত এক বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্য, প্রকাশকাল-২০০৬।
৩. নদভী, আল্লামা সুলতান যওক, دعوة الإصلاح والتطوير في منهاج التعليم , প্রকাশকাল: ১৯৮৫ ঈসায়ী
৪. হুদহুদ, (জামেয়া দারুল মা‘আরিফ থেকে প্রকাশিত স্মরনিকা) প্রকাশকাল: ২০০৫।
৫. দৈনিক আমারদেশ, দৈনিক ইনকিলাব, অন্যান্য জাতীয় পত্রিকাসমূহ।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...