মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল মুসলমানদের পক্ষ থেকে ভারতবর্ষকে ফিরিঙ্গী আগ্রাসন মুক্ত করার সর্বশেষ সশস্ত্র পদক্ষেপ। এ সময় তিন থেকে চার বছরের ব্যবধানে বৃটিশ বেনিয়ারা ভারতবর্ষের চৌদ্দ হাজার উলামায়ে কেরামকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সাথে সাথে কুরআন শরিফের লক্ষ লক্ষ কপি জ্বালিয়ে দেয়। জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। পরবর্তী প্রজন্মকে আত্মপরিচয় ধর্মীয় মূল্যবোধহীন জাতিতে পরিণত করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু এই পাষবিক নির্যাতনের পরেও ভারতবর্ষের জনগণ বিজাতীয়দের গোলামির জিঞ্জির গলায় পরতে সম্মত হয়নি।
শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকু থাকা পর্যন্ত তারা সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। ফলে উপনিবেশিক শক্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে, মুসলিম জাতি কোন ক্রমেই গোলামির জিন্দিগি বরণ করে নিতে কোনো ভাবেই সম্মত হবে না। তাই তারা কর্মকৌশল পরিবর্তন করল। যে পিঙ্গল বর্ণের নরপিশাচ ভারতবর্ষের মাটিতে লক্ষ মুসলমানের বুকের তাজা রক্তে খুনের দরিয়া রচনা করেছিল, তারাই আবার সর্ব সাধারণের কল্যাণকামীর মুখোশ পরে তাদের সামনে হাজির হল। উদ্দেশ্য ছিল, ভয় ভীতি দেখিয়ে কিংবা গায়ের জোরে যে কওম কে দমন করা যায় না ধীরে ধীরে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মানুষিকতায় আমূল পরিবর্তন আনা। যেন তারা ধর্মীয় অনুশাসন, স্বকীয়-সভ্যতা ও দীপ্তিমান অতীতকে ভুলে গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে নিজেকে স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে মূল্যায়ন করতে না পারে।
এই হীন উদ্দেশ্য সফল করার সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। এর মাধ্যমে তাদের দিল দেমাগে পাশ্চাত্যের চতুর্মূখী প্রভাব বদ্ধমূল করা। যেন এতে প্রভাবিত হয়ে নিজ বিবেক দিয়ে স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দূরদর্শী উলামায়ে কিরাম এই সুদূর প্রসারী চক্রান্তও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে বে-খবর ছিলেন না। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের দীন-ঈমান রক্ষার্থে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে তারা সতন্ত্র জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কয়েক খান্দান পরে হয়তো ইসলাম ও তার মৌলিক বৈশিষ্টাবলী সম্পর্কে সচেতন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তাঁরাও সম্মুখ সময়ে লড়াই পরিহার করত কার্যপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট হলেন। নবউদ্ভুত শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংসের হাত থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষার একটি মাত্র পথ তখন খোলা ছিল। দারুল উলূম প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে তারা সে দিকেই অগ্রসর হয়েছিলেন।
কয়েক খান্দান পরে হয়তো ইসলাম ও তার মৌলিক বৈশিষ্টাবলী সম্পর্কে সচেতন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই তাঁরাও সম্মুখ সময়ে লড়াই পরিহার করত কার্যপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট হলেন।
হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, হাজী আবেদ হুসাইন .রহ, ১৮৫৮ সালের জিহাদে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এমন কি উত্তর প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। একারণে অবশ্য দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁদেরকে ইংরেজ প্রশাসনের কোপানলের শিকার হয়ে থাকতে হয়েছিল। সশস্ত্র সংগ্রাম আপাত ব্যর্থ হলে তাঁরা নিরব ও সফল আন্দোলনের বীজ দেওবন্দের মাটিতে বপন করেন। যা ধীরে ধীরে গোটা ভারতবর্ষে আপন শাখা-প্রশাখা, পত্র পল্লব বিস্তার করে এক মহীরুহের রূপ ধারণ করে। যার সুশিতল ছায়ায় ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বতন্ত্রবোধ লালিত হয়ে আসছে। হ্যাঁ সেই শাজারে তুবা’র নাম দারুল উলূম।
১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরি মোতাবেক ৩০ শে মে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে নিতান্ত অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানে এই নীরব আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ইখলাসের সাথে দীনের খেতমতই যেহেতু প্রতিষ্ঠাতাত্রয়ের এক মাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, তাই কোন বিবৃতি বিজ্ঞাপন কিংবা অন্য কোন প্রচার মাধ্যমের আশ্রয় না নিয়ে দেওবন্দের ছোট্ট পল্লিতে ছাত্তা মসজিদের আঙ্গিনায় একটি ডালিম গাছের ছায়ায় ‘আবে হায়াতের এই নহর তারা রচনা করেন। দুই বুজুর্গের মাধ্যমে কার্যত প্রতিষ্ঠানটির পদযাত্রা শুরু হয়। প্রথমজন শিক্ষক; হযরত মোল্লা মাহমূদ। মিরাঠ থেকে আগত আলেমে দীন দ্বিতীয়জন ছাত্র; দেওবন্দের নওজোয়ান মাহমূদ হাসান। যিনি পরবর্তীতে শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান নামে খ্যাত হন এবং ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বাসিন্দা। একটি দেশ ও জাতির স্বাধীনতা অর্জন কোনো সহজ ব্যাপার নয়। এজন্য বহু ত্যাগ তিতিক্ষা প্রয়োজন পড়ে। ঝরাতে হয় লাখ-সহস্র বুকের তাজা রক্ত। ছেলে হারান জননী, স্বামী হারা হয় জায়া, শিশু হারায় তার বাবা-মা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন জাতির কাছে তাঁরা চির স্মরণীয়, তাঁদের অবদান চির অম্লান।
আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশটির স্বধীনতার দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথমতঃ বৃটিশ বেনিয়াদের ঔপনিবেশিক অপশক্তির হাত থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ। দ্বিতীয়তঃ পণ্ডিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত জুলুম নিপীড়ন প্রতিহত করে দীর্ঘ নয় মাস স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদের মানচিত্র অর্জন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান নামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না হলে স্বাধীন ভূ-খণ্ড হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ছিল কল্পনাতীত। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, ভারত সাম্রাাজ্য থেকে পাকিস্তানের জন্ম এবং সে পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ভারত বিভক্তির পূর্বে কংগ্রেস ও হিন্দু স¤প্রদায় অখণ্ড ভারতের দাবিদার ছিলো। ভারতবর্ষের সংখ্যা গরিষ্ঠ সনাতন ধর্মাবম্বীরা অখণ্ড ভারতে হিন্দুয়ানী রাজত্ব কায়েমের স্বপ্নে বিভোর ছিলো। এরই সাথে সরলমনা কিছু সংখ্যক মুসলিম তাদের দূরভিসন্ধি আঁচ করতে না পেরে অখণ্ড ভারতের পক্ষে তাদের সাথে একাত্বতা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু দূরদর্শী ও বিচক্ষণ মুসলিম নেতৃবৃন্দ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে মুসলমানদের স্বাধীন ভূ-খণ্ড হিসেবে প্রাপ্তির দাবি উত্থাপন করেছিলেন। সেই থেকেই ভারত-বিভক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত।
উলামায়ে কেরাম এই ত্যাগ স্বীকার না করলে মুসলিম লীগের পক্ষে পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে লাভ করা কখনই সম্ভব ছিলো না। এই গতি পথ ধরেই পাকিস্তানের জন্ম। আর কালক্রমে সেই পাকিস্তান থেকেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের উভ্যূদয়।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী, এ. কে. ফজলুল হকসহ আরো অনেকেই ভারত বিভক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরে অভিন্ন চেতনায় ঊজ্জিবিত নেতৃবৃন্দ কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, মীর শওকত আলীসহ আরো অনেককে নিয়ে আন্দোলনের ডাক দেন। গঠিত হয় মুসলিম লীগ। এদিকে হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ., হযরত মাওলানা শাব্বির আহমাদ উসমানী রহ., হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.সহ তদানিন্তনকালের দেওবন্দী উলামায়ে কেরাম কংগ্রেসের দূরভিসন্ধি বুুঝতে পেরে ভারত-বিভক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর ক্রমধারায় কলকাতার মুহাম্মাদ আলী পার্কের বিশাল জনসভায় ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ গঠন করে মুসলিম লীগের সর্বাত্মক সহায়তা করার ঘোষণা দেন। ফলে তদানিন্তন কালের উলামায়ে কেরাম মুসলিম লীগের পক্ষে জনসমর্থন তৈরী করেন। সাথে সাথে নিজেদের জান-মাল কুরবান করে মুসলিম লীগের সর্বিক সহায়তায় আত্মনিয়োগ করেন। উলামায়ে কেরাম এই ত্যাগ স্বীকার না করলে মুসলিম লীগের পক্ষে পাকিস্তানকে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে লাভ করা কখনই সম্ভব ছিলো না। এই গতি পথ ধরেই পাকিস্তানের জন্ম। আর কালক্রমে সেই পাকিস্তান থেকেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের উভ্যূদয়। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে ভারত-বিভক্তি ও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সীমাহীন নির্যাতন নীপিড়নের পরই মূলত আজাদী আন্দোলন তীব্রতর গতি লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের শাসনক্ষমতা মজবুত করতে ইংরেজরা এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরকে নানাভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এদের মাধ্যমে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নানা নির্যাতন নীপিড়ন চালাতে থাকে। ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে দীন-ঈমান, দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ছিলো মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, এটি ছিলো অনেকটা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। তাই মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও সবস্তরের উলামায়ে কেরাম দেশ ও ঈমান রক্ষার এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আজাদী আন্দোলনকে সফল করার উদ্দেশ্যে তদানিন্তনকালে দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে পড়–য়া উলামায়ে কেরাম বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ইতিহাস তাদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, নরাইবাগ ইসলামিয়া মাদরাসা, ডেমরা, ঢাকা।
ইমাম, ডেমরা জামে মসজিদ, ঢাকা।