:
চিন্তা করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। শিক্ষক আমাদের প্রথম নায়ক। আমার কোনো শিক্ষকের মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করছি। কল্পনা করার চেষ্টা করছি, কীভাবে সেই নায়ককে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। কল্পনা করার চেষ্টা করছি, প্রায় পুত্রের বয়সী, ছাত্রের বয়সী পুলিশ আমার বীরদের পেটাচ্ছে। না, আমি ফুলবাড়িয়ার শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ কিংবা ভ্যানচালক সফর আলীকে চিনি না। না, আমি ওই নিহত শিক্ষকের মুখের জায়গায় আমার কোনো শিক্ষকের মুখ বসাতে পারছি না। যেমন পারছি না পুলিশের লাঠির আঘাতে কোনো আপনজনের মৃত্যু কল্পনা করতে—হয়তো সফর আলীর মতো কেউ। কিন্তু সেটাই ঘটেছে। অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ও সফর আলীর পরিবার পুলিশের কাছ থেকে স্বজনের ‘লাশ’ উপহার পেয়েছে।
আমি এ রকম কজন বেসরকারি কলেজশিক্ষককে চিনি, যাঁরা মাসের পর মাস বেতন পান না। তারপরও প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করে ওই শিক্ষকদের হাসিমুখে ছেলেমেয়েদের সামনে দাঁড়াতে হয়। এই আত্মত্যাগের প্রতিদান কম, খেসারত বেশি। সেই খেসারত মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তাঁদের শুধতে হলো। পুলিশের হাতে প্রহৃত শিক্ষক যখন ক্লাস নিতে দাঁড়ান কিংবা ঘরে ফেরেন, কত গ্লানি, কত লজ্জা তাঁকে ঠুকরে খায়, সেই হিসাব কি সরকার মহাশয় করেন?
ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষকেরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে কলেজে ঢুকে শিক্ষকদের ‘গরুর মতো’ পেটায়। আমার প্রথম শিক্ষক অবসরে গরু চরাতেন। গরুটিকে তিনি ভালোবাসতেন। সাহস হয় না জানতে, যে শিক্ষক মারা গেলেন, তিনি কি আমার স্কুলগামী বয়সের হিরো? তিনিই কি আমাকে পড়িয়েছেন ছোটবেলায়? কেমন তাঁর মুখ? সেই শিক্ষক, সেই সাহেবের কুকুরের এক ঠ্যাঙের সমান মূল্যের মানুষটি আমাদের কে হন?
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিতমশাই’ গল্পটি যিনি পড়াতেন, তিনিও গল্পের পণ্ডিতমশাইয়ের মতোই দরিদ্র একজন শিক্ষক। পড়াতে পড়াতে তাঁর মুখে যে ভাঁজ পড়ত, চোখের তারায় যে ঝিলিক আসত, তা কি বেদনার, না ক্রোধের, তা বোঝার বয়স তখন ছিল না। সেই গল্পের এক জায়গায় লেখক বলেন, ‘স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরের পেছনে ব্যয় মাসে ৭৫ টাকা। আর বিদ্যালয়ের পণ্ডিতমশাইয়ের মাসিক বেতন ২৫ টাকা। তাহলে পণ্ডিতমশাইয়ের বেতন ইন্সপেক্টরের কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান?’ ব্রিটিশ আমলের সাহেব স্কুল ইন্সপেক্টরের তিন ঠেঙে কুকুরও এসেছিল সেই পরিদর্শনে। পণ্ডিত মশাই তাঁর ছাত্রদের ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে শিক্ষকের মর্যাদার আর্থিক চেহারাটি বের করতে বলেছিলেন। ছাত্ররা কী বুঝেছিল?
‘মূর্খের মতো একবার পণ্ডিতমশাইয়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে, কেউ বাদ যায়নি, পণ্ডিতমশাই আত্ম-অবমাননার কী নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।’
আমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখেই এ দেশের একজন শিক্ষক পুলিশের হাতে নিহত হলেন। এখন পুলিশ প্রমাণের চেষ্টা করবে, শিক্ষক মানুষটি আপনা-আপনি মারা গেছেন। পথচারী সফর আলীও দৈব-দুর্ঘটনায় নিহত। কক্ষে কক্ষে ঢুকে শিক্ষকদের লাঠিপেটা করলেও পুলিশ নিদায়-নিষ্কলুষ। আমরা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম যে ফুলবাড়িয়ায় নিহত শিক্ষক ও পথচারী ‘জঙ্গি’ বা ‘ডাকাত’ ছিলেন। ‘জঙ্গি’ বা ‘ডাকাত’ হলে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া এখন অবধারিত। বিচারের বালাই নেই। দুই দিন আগেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) সগর্বে বলেছেন, ‘ডাকাত যদি হাতেনাতে পান, তো জলজ্যান্ত ওটাকে পিষে মেরে ফেলেন। …আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনাদের নামে কোনো মামলা হবে না। এই গ্যারান্টি আমার।’ যে পুলিশ শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদেরও কি ঊর্ধ্বতন কেউ গ্যারান্টিযুক্ত নির্দেশ দিয়েছিল? বলেছিল, ‘পিটিয়ে আসেন, কোনো মামলা হবে না। গ্যারান্টি আমার?’
পুলিশের লাঠিতে শিক্ষকের মৃত্যু এই কি প্রথম? ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা দিবসের ঠিক আগের দিন ঢাকার রাজপথে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপরও জলকামান বর্ষণ করা হয়েছিল। তাঁরাও এসেছিলেন চাকরি জাতীয়করণের দাবি নিয়ে। নির্যাতিত একজন শিক্ষক বাড়ি ফিরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। না, সেই মৃত্যুর দায় কেউ নেয়নি। এমন মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না। অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ ও সফর আলীর মৃত্যুর দায়ও পুলিশ নেবে না। দুজন নাগরিকের মৃত্যুতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখ খোলেননি। কেননা, ‘পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না, তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ’ (ন্যায় অন্যায় জানিনে, শঙ্খ ঘোষ)।
গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের উচ্ছেদ ও হত্যার পেছনে স্থানীয় এমপির ইন্ধন ছিল। নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার পেছনেও জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় শিক্ষক নির্যাতনের পেছনেও স্থানীয় সাংসদের ইন্ধনের কথা আসছে। অভিযোগ উঠেছে, সরকার সম্প্রতি ২৩টি কলেজকে জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করে। তাতে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ৫ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীর ফুলবাড়িয়া কলেজকে বাদ দিয়ে এমপিওবিহীন ৩০০ শিক্ষার্থীর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজকে (ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় সাংসদের কারণেই ফুলবাড়িয়া কলেজ বঞ্চিত হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। তাদের কাছে আমরা সত্যটা জানতে চাইব। স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে ফুলবাড়িয়া কলেজের আন্দোলনকারীদের বিরোধ ছিল। পুলিশের বাড়াবাড়ির পেছনেও তাঁর ইন্ধন খতিয়ে দেখা উচিত। কিন্তু সেই কাজ তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশি ‘অ্যাকশনের’ তদন্ত না করে, তাহলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উচিত তার তদন্ত করা।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া কলেজের আন্দোলন এ দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও জরুরি আন্দোলনগুলোর একটি। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই গোড়াপত্তনে সরকারের হাত ছিল না। সামাজিক উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতো। তারপর তদবির চলত সেটাকে জাতীয়করণের। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এ জন্যই বলেছিলেন, শিক্ষা চলবে রাষ্ট্রের খাতে কিন্তু থাকবে সমাজের হাতে। অর্থাৎ, সমাজ চালাবে আর খরচ দেবে সরকার। দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এভাবেই জাতীয়করণ হয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশ শিক্ষায় এগিয়েছে। এভাবেই উন্নয়নের মূল ভিত হিসেবে শিক্ষাকে আমরা পেয়েছি। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের মধ্যে একটা বেছে নিতে বলেন কেউ কেউ। কলেজ জাতীয়করণের আন্দোলন তো উন্নয়নেরই আন্দোলন। তাহলে কি শিক্ষার উন্নয়ন আর সরকারের উন্নয়নের মধ্যে যে বিভেদ আছে, পুলিশ সেটাই বোঝাল?
সরকার প্রতিবছর পাসের রেকর্ড নিয়ে গর্ব করে, অভিভাবকেরা করেন উল্লাস। সাক্ষরতার হার নিয়ে দেশ-বিদেশে কম বড়াই করে না সরকারগুলো। যে শিক্ষক ভাত পান না বলে গরু চরান বা দিনমজুরি করেন বা ইটভাটায় কাজ করেন, তাঁর সামনে এ গর্বের মিষ্টি নিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা হবে না আমাদের? এই মৃত্যু কঠিন ও ট্র্যাজিক। এই ট্র্যাজেডির মধ্যে একমাত্র সুন্দর হলো একটি কান্নার দৃশ্য (ছবি, প্রথম আলো, সোমবার, অনলাইন সংস্করণ)। কলেজ মাঠে দাঁড়ানো কয়েকটি ছাত্র অঝোরে কাঁদছে। তাদের একজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। তারা শুধু কাঁদতে পেরেছে, প্রিয় শিক্ষকের জানাজা পড়ার সুযোগ পায়নি। ১৪৪ ধারা জারি করে অধ্যাপক আজাদের জানাজা ফুলবাড়িয়ার মাটিতে হতে দেয়নি!
আমাদের কাঁধে অনেক অদৃশ্য লাশের ভার। দিন দিন সেই ভার বাড়ছে।