গোলাম মাওলা রনি :
আজকের নিবন্ধের বিষয়বস্তু- সাধারণ মানুষের নিরন্তর জীবনযুদ্ধ। আপনি যদি নিজের জীবনকে একটি যুদ্ধক্ষেত্রের সাথে তুলনা করতে শেখেন এবং সেভাবে কর্মপরিকল্পনা নেন, তবে প্রায় প্রতিদিনই আপনি উপভোগ করতে পারতেন একেকটি যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। অন্য দিকে, কালের গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে যদি একজন অনভিজ্ঞ সৈনিক হিসেবে নিত্যকার যুদ্ধে অবতীর্ণ করান, তবে নির্ঘাত পরাজয় ছাড়া আপনার জীবাত্মা কিছুই পাবে না। পৃথিবীর অনেক নামকরা যুদ্ধজয়ী সৈনিক যেমন জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তেমনি কোনো যুদ্ধের ময়দানে না গিয়েও অনেকে মহাবীর উপাধি নিয়ে ইতিহাসে বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছেন।
আপনি যদি মহাকালের সামরিক যুদ্ধগুলো পর্যালোচনা করতে চান, তবে ভারতবর্ষের মহাভারতের যুদ্ধ, ম্যারাথনের যুদ্ধ, গাওগে মেলার যুদ্ধ এবং ওয়াটার লু যুদ্ধের কাহিনীগুলো নিয়ে বসতে পারেন। প্রতিটি যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল সেনাপতিদের বিচক্ষণতা এবং প্রতিপক্ষকে চমৎকারভাবে মূল্যায়ন করার দক্ষতার ওপর। সর্বোপরি নিজের শক্তিমত্তা, দুর্বলতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে অনুমান করার ধীশক্তির বলে তারা নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন। উল্লিখিত যুদ্ধগুলোর মধ্যে মহাবীর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের স্মৃতিবিজড়িত ওয়াটার লু যুদ্ধের একটি বিশ্লেষণ শোনার পর থেকেই মূলত আজকের নিবন্ধ লেখার তাগিদ অনুভব করি।
ওয়াটার লু যুদ্ধটি হয়েছিল ১৮১৫ সালের জুন মাসের ১৮ তারিখে এবং দিনটি ছিল রোববার। ফ্রান্সের সম্রাট ও সর্বকালের অন্যতম সেরা বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং ব্রিটিশ সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটনের নেতৃত্বে সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনী যে দিন ওয়াটার লু প্রান্তরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সে দিন মানুষের বিচক্ষণতা, শারীরিক দুর্বলতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় একাকার হয়ে যুদ্ধের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যুদ্ধটির জয়-পরাজয় নিয়ে বহু গবেষণা বহু আলোচনা ও বিভিন্ন তর্কবিতর্ক প্রচলিত রয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা সার্বিক বিবেচনায় নেপোলিয়নের পরাজয় এবং ডিউক অব ওয়েলিংটনের বিজয়ের ১০০টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে দু’টি কারণকে আমাদের মতো বেসামরিক জীবনযোদ্ধারা যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, তবে বেশির ভাগ যুদ্ধে জয়লাভের সম্ভাবনা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে।
ওয়াটার লু প্রান্তরে পৌঁছে সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটন সর্বপ্রথমে নিজেদের আত্মরক্ষার কথা চিন্তা করলেন। তিনি যুদ্ধের ছক তৈরি করতে গিয়ে নিজের যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নেপোলিয়নের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করলেন। নিজের জীবনের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে ওয়াটার লু প্রান্তরে বসে জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে চিনলেন। খুঁজে পেলেন এক নতুন ওয়েলিংটনকে। তিনি দেখলেন, জীবনের কোনো যুদ্ধে আমন্ত্রণকারী হিসেবে অর্থাৎ অফেনসিভ হয়ে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। যেসব যুদ্ধে তিনি ধৈর্যসহ্য এবং পরিকল্পনা করে আক্রমণকারীর আক্রমণ প্রতিহত করে নিজেদের প্রতিরক্ষার উপায় বের করতে পেরেছিলেন সেসব যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন।
ওয়েলিংটন আরো একটি বিষয় বিবেচনায় আনলেন। তিনি নেপোলিয়নের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দুটো সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। প্রথমত, নেপোলিয়ন হলেন সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ, কৌশলী ও সফল আক্রমণকারী। তার আক্রমণের সামনে রুখে দাঁড়িয়েছিল অথবা তার আক্রমণকে প্রতিহত করতে পেরেছিল এমন কোনো ইতিহাস নেই। তিনি সমগ্র ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চল, রাশিয়া এবং মিসর আক্রমণের মাধ্যমে যে সামরিক নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, তা মানবজাতির ইতিহাসে অন্য কোনো সেনাপতি দেখাতে পারেননি। অন্য দিকে, প্রকৃতির কাছে নেপোলিয়নকে বারবার পরাজিত হতে হয়েছে। মিসর, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া আক্রমণের সময় তিনি প্রকৃতির কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন।
ওয়েলিংটন তার পর্যবেক্ষণে নেপোলিয়ন সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, প্রকৃতির বিপর্যস্ত নেপোলিয়ন যেমন ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তেমনি তিনি গেরিলা হামলাও মোকাবেলা করতে পারেননি। সুতরাং তিনি নেপোলিয়নের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সর্বাপেক্ষা নিরাপদ আশ্রয়টি বেছে নিলেন। এরপর তিনি সম্ভাব্য দু’টি বিকল্প মাথায় রেখে নেপোলিয়নের আক্রমণ প্রতিহত এবং পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেন। প্রথমত, যদি বৃষ্টি হয় তবে নেপোলিয়নের বাহিনী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। সে ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব নেপোলিয়নকে আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করতে হবে; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাকে আক্রমণ করার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, নেপোলিয়নকে ফাঁদে ফেলে গেরিলা আক্রমণ চালানো।
এবার নেপোলিয়নের পরাজয়ের দ্বিতীয় কারণটি পর্যালোচনা করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। ঐতিহাসিকেরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নেপোলিয়ন মারাত্মকভাবে অর্শ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি নিজে এবং তার ডাক্তাররা তার এই অসুস্থতার খবর গোপন রেখেছিলেন। ওয়াটার লু যুদ্ধের দিন সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিজ দফতরে বসেই আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেন। সাধারণত তিনি আক্রমণের আগে নিজে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে প্রতিটি বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তদারক করতেন। সব কিছু ঠিক থাকলে সম্মুখভাগে থেকে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। ঘটনার দিন বৃষ্টির কারণে নেপোলিয়নের গোলাবারুদ এবং কামান অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। কাদাযুক্ত যুদ্ধের ময়দান তার পদাতিক এবং ঘোড় সওয়ারিদের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত ছিল। অন্য দিকে, অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে শক্ত ঘাঁটির ওপর দাঁড়িয়ে সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনীর যুদ্ধের দামামায় উত্তেজিত হয়ে নেপোলিয়নের বাহিনী আক্রমণের জন্য যে উন্মাদনা দেখাচ্ছিল, সে অবস্থায় নেপোলিয়ন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে অবশ্যই আক্রমণের নির্দেশ দিতেন না।
ওয়াটার লু যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের ১০০টি কারণের মধ্যে উপরিউল্লিখত দুটো কারণ কিভাবে বেসামরিক আমজনতা নিজেদের জীবনে শিক্ষণীয় হিসেবে নিতে পারে, সে ব্যাপারে সংক্ষেপে আলোচনা রেখে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জীবিকা, পদ-পদবির লড়াই, মান-সম্মান-মর্যাদার লড়াই, টিকে থাকার সংগ্রাম, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রেম-পরিণয়, বিরহ, সফলতা-ব্যর্থতা, রোগ-শোক, বালা-মুসিবৎ, বেঁচে থাকার চেষ্টা, আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে উল্লিখিত দুটো কারণের মাধ্যমে প্রভাবিত না হয়ে উপায় থাকে না। কাজ করতে গিয়ে নিজের শক্তি-সামর্থ্য যেমন বিবেচনা করা দরকার, তেমনি প্রতিপক্ষ, প্রতিযোগী অথবা শত্রুদের শক্তিমত্তা বা দুর্বলতার নিখুঁত হিসাব থাকা জরুরি। সর্বোপরি দুর্বল ভগ্নস্বাস্থ্য, রোগাক্রান্ত দেহ এবং ক্লান্ত-অবসন্ন ও বিষণœ মন নিয়ে কেউ কোনো দিন কোনো যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি।
জীবনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে আপনার জেনে নেয়া আবশ্যক যে, মানুষের মধ্যে একই সাথে সমান্তরাল দুটো গুণ সমানভাবে কার্যকর থাকে না। বিশেষ করে যুদ্ধের ময়দানে যারা আক্রমণকারী হন, তারা সচরাচর আত্মরক্ষার নীতিতে পটু হন না। অন্য দিকে, আত্মরক্ষায় দক্ষ যোদ্ধারা আক্রমণকারী হিসেবে সফলতা পান না। ক্রিকেট, ফুটবল, হাডুডু, হকি ইত্যাদি খেলার ক্ষেত্রে আক্রমণকারী এবং আক্রমণ প্রতিহতকারী খেলোয়াড়দের যে দল যত বেশি নৈপুণ্যের সাথে পরিচালনা করতে পারে সেই দলের জয়লাভের সম্ভাবনা তত বেশি। সুতরাং জীবন যুদ্ধের প্রাক্কালে আপনার প্রথম দায়িত্ব সৈনিক হিসেবে নিজের যোগ্যতা নির্ধারণ করা। আপনি কি ডিউক অব ওয়েলিংটন নাকি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অর্থাৎ আক্রমণকারী হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন নাকি প্রতিরক্ষা ব্লকে খেলে অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করার দক্ষতার মাধ্যমে নিজের বিজয় নিশ্চিত করতে বেশি পছন্দ করেন।
সৈনিক হিসেবে নিজের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার পর আপনার উচিত হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলন। একজন দক্ষ সৈনিকের সামরিক প্রশিক্ষণের মতোই আমজনতার জীবন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। সৈনিক যেমন তার দক্ষতা ধরে রাখতে নিয়মিত অনুশীলন করে, তেমনি জীবনযোদ্ধাকেও সমানতালে অনুশীলন করতে হয়। সৈনিকের অস্ত্র-পোশাক, বাহন, খাদ্য তালিকা এবং আচার-আচরণ যেমন তার গুণাগুণের পরিচায়ক, তেমনি জীবনযোদ্ধার শিক্ষা-দীক্ষা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, পোশাক-আশাক, আহার-বিহার এবং আচার-আচরণ তার সফলতার মাত্রা ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। পৃথিবীর তাবৎ সামরিক কৌশল এবং সূত্র যদি অধ্যয়ন করা হয় তবে দেখা যাবে, প্রতিটি বিষয় হুবহু বেসামরিক জীবনের নিত্যকার কার্যে প্রয়োগ করে সফলতা অর্জন সম্ভব।
আপনি জেনে অবাক হবেন, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে চৈনিক সেনাপতি সান ঝু রচিত আর্ট অব ওয়ার নামক গ্রন্থে বর্ণিত সামরিক কৌশলগুলো এখন পর্যন্ত হুবহু বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। মহাবীর হানিবল যে পদ্ধতি অনুসরণ করে রোম আক্রমণ করেছিলেন, সেই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইতালি দখল করেছিলেন। অন্য দিকে, মহাবীর আলেক্সান্ডার পারস্যের গাওগে মেলা যুদ্ধে যে কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন সেই একই কৌশল প্রয়োগ করে মার্কিন বাহিনী বিগত ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে পরাজিত করেছিলেন।
আপনি যদি উপরিউল্লিখিত সামরিক কৌশলগুলো সম্পর্কে বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, মুকেশ আম্বানী, অনিল আম্বানী, রতন টাটা প্রমুখকে জিজ্ঞাসা করেন তবে দেখবেন সান ঝু, জুলিয়াস সিজার, আলেক্সান্ডার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং মহাবীর হানিবলের সব গুপ্তবিদ্যা তারা মুখস্থ করে ফেলেছেন। একইভাবে রাজনীতির অঙ্গনের কিংবদন্তিদের জিজ্ঞাসা করলেও আপনি প্রায় একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। সব ক্ষেত্রের সফল মানুষ তাদের নিত্যকার জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য বলতে গেলে প্রায় একই সূত্র প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। তারা একে অপরের সফলতা অনুসরণ না করে ব্যর্থতা ও গ্লানির অভিজ্ঞতাগুলোকে হুবহু নকল করে মনের সুখে দিব্যি সময় পার করে দিচ্ছে চমৎকার একটি অংশনিসঙ্কেতকে হাসিল করার জন্য।