শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:১৫
Home / নারী-পুরুষ / শিশুর মনন বিকাশে বাবা-মা কে আরো সচেতন হতে হবে

শিশুর মনন বিকাশে বাবা-মা কে আরো সচেতন হতে হবে

অবনি মণি ::

আজকালকার আধুনিক মায়েরা অতিরিক্ত সচেতনতা দেখাতে গিয়ে একটি শিশুর শারিরীক বিকাশে যথাযথ ভূমিকা পালন করে থাকলেও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট অমনোযোগী! গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে জন্মের পরের প্রথম পাঁচ বছর শিশুর শারিরীক এবং মানসিক বিকাশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু দেখা যায় এই অত্যাধুনিক যুগের শিশুরা এই সময়টা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়।

খাবার-দাবারে বাবা-মা’রা যথেষ্ট সচেতন; চাকরিজীবী মায়েরা সব দায়িত্ব কাজের মেয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে যথাযথ সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন। এদিকে কাজের মেয়ে তার খাবারের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখলেও দিনের প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা মা-বাবা ছাড়া একা একা শিশুর সময় কাটানোটা শিশুকে তখন থেকেই অনেকটা একমুখি করে তোলে। এদিকে অনেক সময় মা তার অফিস শেষে আবার হয়তো পারিবারিক কিংবা অফিসিয়াল কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করতে যাবেন সমাজ বাঁচাতে; একটু আধুনিক মা’দের ক্ষেত্রে এইগুলো একটু বেশি পরিমাণেই থাকে। সেই সুবাদে হয়তো সপ্তাহে ২/৩ দিন মা ঘরে ফিরছেন রাত ১০/১১ টায়। সেক্ষেত্রে শিশুটি মা’র সান্নিধ্য পাচ্ছে কতক্ষণ! আর বাবা! বাবাকে সপ্তাহে একবার সারাদিন দেখতে পাওয়া তার জন্যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো! অথচ শিশুর মনন বিকাশে সব থেকে বেশি গুরুত্ব রাখে বাবা-মা!

কিন্তু সেই বাবা-মা যুগের তালে তাল মিলাতে ব্যস্ত। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন বেশির ভাগ বাবা-মা। সন্তানকে যেন সব থেকে দামি খাবারটা খাওয়াতে পারেন, সব থেকে দামি কাপড়টা পরাতে পারেন সে নিয়েই ব্যস্ত তাঁরা। পাল্লা দিচ্ছেন পাশের বাড়ির ভাবির সাথে কিংবা পাশের বাড়ির আপার সাথে। পাশের বাড়ির আপা কিংবা ভাবি তার সন্তানকে শহরের সব থেকে দামি স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন আমার সন্তানকেও তাই করতে হবে। এবারের ঈদে ভাবি তার বাচ্চার জন্য পাঁচটা জামা কিনেছেন; আমার বাচ্চার জন্য ছয়টা কিনতেই হবে। সেই জন্য অনেক টাকা দরকার, উপার্জন বাড়াতে হবে। বাচ্চার জন্যে কিছু সেভিংস তো করতেই হবে।

এইসব বিষয় নিয়েই ব্যতিব্যস্ত বাবা-মারা। কিন্তু এইসব দিক লক্ষ্য করতে গিয়ে যে তাঁরা তাদের সন্তানের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এটা তারা বুঝতেই পারেন না। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে, একটা শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে উপার্জনও অত্যন্ত জরুরী; কিন্তু শিশুর মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রাখা তারও আগে জরুরী।

এভাবেই শিশুটি একা বড় বড় হতে থাকে। আবার বয়স চার হতে না হতেই বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি, বাচ্চার উপর আরেকটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ঘুম থেকে উঠেই স্কুল, স্কুল থেকে ফিরলেই হোমওয়ার্ক করার তাগদা, ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। অমুকের ছেলে এ প্লাস পেলে তুমি পাবেনা কেনো, তমুকের মেয়ে এ প্লাস পেলে তোমাকেও পেতে হবে। অমুকের বাচ্চা তো তিনবেলা ঠিকমতো ভাতও খেতে পারেনা তবু ভালো রেজাল্ট করে আর আমি তোমাকে সব থেকে দামি এবং পুষ্টিকর খাবারগুলো খাওয়াচ্ছি তবু তুমি ভালো রেজাল্ট করতে পারছোনা কেনো!!

এই কথাগুলো একটি শিশুকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হতে সহযোগিতা করে আসছে। এতো চাপ সহ্য করার মতো বয়স যেখানে তার হয়নি সেখানে তার উপর বাড়তি চাপ তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ্য করে ফেলছে! ধীরে ধীরে সে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে।কারো সাথে মিশতে পারে না, কথা বলতে পারে না ; আবার সে নিজেও মানুষ সহ্য করতে পারেনা। বেশি মানুষ দেখলেই রাগারাগি করে, আবার কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যেতে চায় না, বন্ধুদের সাথে খেলতে চায় না। তার জন্য এটাই তার স্বাভাবিক আচরণ কিন্তু সে তখন সমাজের চোখে একটা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ঠিক অমন মুহূর্তে বাবা-মা’র ঘুম ভাঙে, তারা বুঝতে পারেন যে তাদের বাচ্চা অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কিন্তু এখন আর তারা চাইলেও বাচ্চাকে সহযোগিতা করতে পারছেন না।

আমরা বলে থাকি আজকের শিশু আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। যেকোনো জাতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে শিশুরা। আজকে যারা শিশু তাদের যদি আমরা যত্ন সহকারে, সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ বিকাশ লাভের সুযোগ করে দিই, তাহলে ভবিষ্যতে তারা হবে এদেশের এক একজন আদর্শ, কর্মক্ষম ও সুযোগ্য নাগরিক। তার জন্যে শুধু শারীরিক বিকাশের দিকে সচেতন হলে হবে না, মানসিক বিকাশেও সচেতন হতে হবে। একটা শিশুর জীবন থেকেই শিশুর শরীরের বৃদ্ধি হয় আর মনের হয় বিকাশ। শরীরের বৃদ্ধি হলো বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিবর্তন ও আকৃতি বৃদ্ধি পাওয়া। অন্যদিকে মনন বিকাশ মানে শিশুর জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, আবেগ ও অন্যের সাথে মেলামেশা করার দক্ষতা অর্জন করা। একটি শিশুকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক বৃদ্ধি বা মনের বিকাশেরও সমানভাবে সুযোগ করে দিতে হবে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ-২০০৯ শীর্ষক এই জরিপ চালিয়েছে। জরিপে জানা যায়, মেয়েশিশুর ১৭.৪৭ শতাংশের তুলনায় ছেলে শিশুদের মধ্যে ১৯.২১ শতাংশের মানসিক রোগের প্রকোপ বেশি এবং শহর ও গ্রামের তথ্যও আলাদাভাবে দেয়া হয়েছে। তাতে জানা যায়, শহরের ১৪.৩১ শতংশের চেয়ে গ্রামের ১৭.৫০ শতাংশ শিশুরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়। জরিপে আরো জানা যায় দেশের ৩.৮১ শতাংশ শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী । মৃগীরোগে আক্রান্ত ২.০২ শতাংশ শিশু ।

আর তাই মানসিক বিকাশে শিশুকে সহযোগিতা করতে তার জন্যে সবার প্রথমে:

♣ বাবা-মা এবং শিশুর সব থেকে নিকটস্থরা তার সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে হবে।

♣ শিশুকে অন্য একটি শিশু ও পরিবারের বাইরের লোকদের সাথে মেলা মেশার সুযোগ করে দিতে হবে।

♣শিশুকে পরিবারে ছোট ছোট কাজে উৎসাহিত করতে হবে, পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা এবং শিশুর ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে। কোনোভাবেই তার ব্যর্থতায় তাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না; বরং দ্বিগুণ উৎসাহ প্রদান করতে হবে যে সে পারবেই।

♣ তাকে পূর্ব শিখন থেকে প্রশ্ন করুন, তার প্রশ্নের জবাব দিন, কখনও তার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাবেন না ।

(আমাদের দেশের মায়েরা অতিরিক্ত কাজের চাপে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দিন শেষে ঘরে ফিরে বাচ্চার অতিরিক্ত প্রশ্ন সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাকে ধমক এর উপর রাখেন। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে)

♣ খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, কান্না থামানো কিংবা অন্যান্য কাজের জন্য কখনই তাকে ভয় দেখানো যাবেনা।

♣ একটু একটু করে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে।

♣ বাচ্চাকে ঘরে রেখে নিজেরা নিজেরা বেড়াতে না গিয়ে তাকে সাথে করে নিয়ে বেড়াতে যান ।

♣ তার পছন্দকে গুরুত্ব দিন, দেখবেন সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে ।

♣ তার সাথে খেলা করুন ।

আমরা জানি যে, শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়। তাই তাদের সামনে এমন সব আচরণ করতে হবে, যা তার মানসিক গঠনে সহায়তা করে। একটা শিশুর সামনে কখনোই নেতিবাচক কথা বলা যাবে না। এগুলি শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়াও অকল্যাণ বয়ে আনে। শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো এবং যথাসময়ে টিকা প্রদানে সচেতন থাকতে হবে। ছেলে এবং মেয়েশিশুর মধ্যে পার্থক্য করা যাবে না। বাবা-মা’র নেতিবাচক আচরণ তাদের কন্যাটির মানসিক বিকাশে বাধা হতে পারে ।

শারিরীক, মানসিক বিকাশের পাশাপাশি একটি শিশুর নৈতিক বিকাশের দিকেও বাবা-মা এবং পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের খেয়াল রাখাটা জরুরী। একটা বাচ্চা জন্মের পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের আগে পরিবারের সাথেই সে বেড়ে ওঠে। তখন শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশ এর পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রও গঠন হয়ে থাকে।

আমরা সবাই জানি, পরিবারই হলো একটা শিশু সন্তানের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অতএব প্রত্যেক শিশুর জীবনে পারিবারিক শিক্ষার মূল্য অপরিসীম। প্রত্যেক শিশুসন্তানের মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম হয় পরিবার থেকেই। সাধারণত বাবা-মা যে আদর্শ লালন করে থাকেন তাদের বাচ্চারাও তা-ই ধারণ করে।

তাই বাবা-মা’র প্রধান কর্তব্য হলো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনের সাথে সাথে নৈতিক চরিত্র গঠনের দিকে লক্ষ্য করা। শিশুরা হয় নিষ্পাপ, অপ্রষ্ফুটিত পুষ্পকলির মতোই পবিত্র। নানারকম নিষ্ঠুরতা, অবহেলা ও সহিংসতাপূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা একটা শিশুর মধ্যে যে মানসিক জঠিলতা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তা থেকে রক্ষা করতে পারেন একমাত্র বাবা-মা। বাবা-মা’র সান্নিধ্য প্রতিটা শিশুকে সমাজের বিভিন্ন বিপজ্জনক ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে ।

সঠিকভাবে শিশুদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাভাবনা ও কাজ করার সময় এখনই। শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে বাবা মায়ের ভালবাসার, সান্নিধ্যের কোন বিকল্প নেই। পরিবারে মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর বাবা মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়। তাই মা’র পাশাপাশি বাবাকেও শিশুর মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে ভুমিকা রাখতে হবে ।

লেখক : অবনি মণি
ছাত্রী, জনস্বাস্থ্য পুষ্টি বিভাগ, প্রাইমেশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বনানী, ঢাকা !

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে জরুরী কিছু কথা!

কমাশিসা ডেস্ক: শুক্রবার ২৫সেপ্টেম্বার ২০২০. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি যখন কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ...