শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ ভোর ৫:৩৬
Home / খোলা জানালা / কওমী মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বিষয়ক কমিটির নেতা কে হবেন?

কওমী মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বিষয়ক কমিটির নেতা কে হবেন?

darul-uloom-dewbondসৈয়দ মবনু ::

কওমী মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বিষয়ক কমিটির নেতা কে হবেন, আল্লামা আহমদ শফি, না আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ? তা নিয়ে চলছে কওমী মাদরাসার জগতে তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলছেন, শাহ আহমদ শফি বর্তমান বাংলাদেশের আলেমদের মধ্যে বুজুর্গ, তাই তিনি হবেন নেতা। আর কেউ বলছেন, আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ একজন পণ্ডিত মানুষ, তাকেই কওমী সনদের নেতা করা উচিৎ। এখানে আমি তিনটি ঘটনা বর্ণনা করতে চাই।
এক.
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সৃষ্ট অসংখ্য আন্দোলনের চিন্তক, ঐতিহাসিক রেশমি রোমাল আন্দোলনের পরিকল্পক নেতা শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (র.) মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে ভারতবর্ষের উলামাদেরকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আবি শায়খুল হিন্দ কা যামানা খতম হ গিয়া, ইমামুল হিন্দ কা যামানা আ গিয়া। তুম আজ তোমারেচে এক কো ইমামুল হিন্দ মকরর কর লো।’ অর্থ : এখন শায়খুল হিন্দের সময় শেষ, ইমামুল হিন্দের সময় এসেছে। তোমরা তোমাদের মধ্য থেকে যে কাউকে ইমামুল হিন্দ নির্বাচিত করে নাও। আমরা জানি, শায়েখ অর্থ মুরুব্বী, আর ইমাম অর্থ নেতা। এখানে শায়খুল হিন্দ বলেছেন, হিন্দুস্তানে এখন মুরুব্বীর সময় শেষ, সময় এসেছে নেতার। তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে নেতা করে নাও। আজ কওমী মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি নিয়ে যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে তা দেখে শায়খুল হিন্দের এই ঘটনা বারবার স্মরণ হচ্ছে। সেদিন শায়খুল হিন্দের বক্তব্যের সাথে সবাই একমত হলেও যখন শায়খুল হিন্দ ইমামুল হিন্দ হিসেবে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের দিকে ইশারা দিলেন তখন একদল আলেম নাক কপালে উঠিয়ে আজাদের নিন্দা করতে লাগলেন। সেই বৈঠকে মাওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর গ্র“পটি ছিলো মাওলানা আযাদের পক্ষে। কারণ, সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী জানতেন মাওলানা আযাদই এখানে নেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কারণ নেতৃত্ব আর বুজুর্গি দুই জিনিষ।

দুই.
একবার সিলেট দরগাহ মসজিদের ইমাম দ্বিতীয় শাহ জালাল বলে খ্যাত আমার মুর্শিদ হযরত মাওলানা হাফেজ আকবর আলী (র.)-কে নিয়ে আমি আমার গাড়ি দিয়ে ইংলান্ডের বার্মিংহাম থেকে ওয়েস্ট ব্রমিউচ যাওয়ার সময় গাড়িতে উঠেছি। হুজুর ড্রাভিং সিটে বসেছেন। আমি বললাম বেল্ট বাধতে, কারণ বেল্ট না বাঁধলে পুলিশ ৫০ পাউন্ড ফাইন এবং লাইসেন্সে তিন পয়েন্ট দিয়ে দেবে। কেউ একজন পাশ থেকে বললো, হুজুর বুজুর্গ মানুষ, লাগবে না। সাথে সাথে হুজুর বললেন, বুজুর্গতে লন্ডন কেন? বুজুর্গ যদি গাড়িতে উঠার নিয়ম না বুঝেন তবে দেশে থাকবেন। অতপর তিনি বুজুর্গ নিয়ে একটি কৌতুক বলে হাসতে থাকেন। কৌতুক এখানে বলবো না, যদি বুজুর্গরা নারাজ হন।

আমরা কাকে নেতা বলে মেনে নেবো তা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। নেতৃত্ব প্রসঙ্গে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন কথা বলেছেন, তাদের সবার কথা যে কার্যক্ষেত্রে সত্য তা কিন্তু নয়। আবার তাদের কথাগুলোকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাবে না। আমরা দয়াদর্শনের আলোকে তাদের কথাকে দেখতে পারি, ভাবতে পারি, বিবেচনা করতে পারি। দয়াদর্শন মনে করে, প্রকৃত অর্থে নেতৃত্ব হল অন্য বা অন্যদের উপর আপনার প্রভাবের এমন এক প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আপনি কোন একটি বা অসংখ্য কাজ সম্পন্ন করতে অন্যান্য মানুষের সহায়তা ও সমর্থন লাভ করতে পারেন। এই কথাকে ভেঙে-টেনে একেকজন একেক কথা বলেছেন। দয়াদর্শন মনে করে, সঠিক নেতৃত্বের জন্য নেতাকে বিশেষ কিছুদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। যেমন-

১. পরিবেশের দিকে নজরদারি করতে হয়।
২. অধিনস্তদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন থেকে সেদিকে নজরদারি করতে হয়।
৩. অদিনস্তদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কজের উপযুক্ত করতে হয়।
৪. নিজের কাজের প্রতি অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়।
৫. দলের কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে নেতৃত্ব দিতে হয়।
৬. নেতা-কর্মর মধ্যে কার্যকরী সুসম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয়।
৭. কোন কর্মীর প্রতি উদ্বেগ কিংবা সমর্থন প্রকাশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হয়।
৮. কাজের পরিকল্পিত কাঠামো আগেই গঠন করতে হয়, কারণ এর উপরই কাজের সফলতা-বিফলতা নির্ভর করে।
৯. কাজের শুরুতে কর্মীকে স্পষ্ট করে বলতে হয় তার কাজ কী।
১০. কাজের শুরুতে কর্মীকে কাজের মান নির্ণয় করে দিতে হয়।
১১. বিশেষ কোনও কাজ সম্পাদন এবং দলের কাজের জন্য কর্মীকে পুরস্কার বা শাস্তি দানের ক্ষমতা নেতাকে অর্জন করতে হয়।

এই এগারোটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দিতে পারলে সবাই বুঝতে পারবেন নেতা কে হবে? চিন্তা করুন, কে পারবেন কওমীকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে? যারা কওমী মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি বিষয়ক কমিটির নেতা নিয়ে ঝগড়া করছেন তাদের উদ্দেশ্য কওমীর সনদের স্বীকৃতি, না অন্য কিছু? প্রশ্ন এখানে । যারা এখানে আল্লামা শাহ আহমদ শফিকে নেতা করতে চাচ্ছেন তারা কি সত্যি শাহ আহমদ শফির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন? না সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরুব্বীকে সামনে রেখে শাপলা চত্বরের মতো নিজেরা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন?
হযরত শাহ আহমদ শফিকে নেতা করতে ইচ্ছুক এমন এক মাওলানাকে সেদিন জিগ্যাস করেছিলাম, আপনারা কেন এমন একজন আলেমকে নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছেন যিনি নিজের খবরই ভালো করে রাখার মতো বয়স হারিয়ে ফেলেছেন? তখন তিনি বলেন, আহমদ শফি সাহেব সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, তাই তার নেতৃত্ব সবাই মেনে নিবে। আমি তাকে বললাম, সবাই মানা আর নেতৃত্বের যোগ্যতা এক নয়। এজন্য ই তো শায়খুল হিন্দ নেতৃত্ব থেকে সরে মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে দিতে চেয়েছিলেন। আল্লামা আহমদ শফিও যদি মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে ডেকে নেতৃত্ব দিয়ে একটা খাস দোয়া দিয়ে দিতেন, তবেই না উত্তম হতো। শায়খুল হিন্দের চিন্তা থেকে বলছি, বুজুর্গ তো নেতা হওয়ার জন্য নয়। বুজুর্গ দোয়া করার জন্য। আমি এখানে বলতে চাই, হযরত শাহ আহমদ শফি সাহেব দোয়া করুন আর হযরত ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সাহেব সনদের জন্য কাজ করুন। ঝগড়া শেষ। কওমীর ছাত্ররা উপকৃত হোক। উপকৃত হোক বাংলাদেশ।

লেখক : কবি ও গবেষক

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...