কমাশিসা ডেস্ক: বংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নরক পানে।
ডা. নুরুল আম্বিয়া রিপন। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পূর্ব মিরাবাজার বিরতী পাম্পের বিপরীত গলির ভেতর বাসা। পাশের একটি গলিতে তার ফার্মেসি। তার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি যন্ত্রনাদায়ক ভয়ার্ত ইতিহাস তুলে ধরা হচ্ছে পাঠকদের জন্য। যে ঘটনার কারণে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশেও চলছে তোলপাড়। এরই মধ্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে সিলেট মডেল কোতোওয়ালী থানার এএসআই মাসুদ রানা ও ৩ কনেষ্টেবল কে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডা. নুরুল আম্বিয়া রিপন বলেন, ২৯ আগষ্ট দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টা। এ সময় ড্রয়িং রুমের জানালা পাশে কেউ একজন দাড়িয়ে দরজা খুলে দেয়ার জন্য চেচামিচি করছে। আমি ফার্মেসি বন্ধ করে রাত সারে এগারোটায় বাসায় গিয়েছিলাম। তাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। স্ত্রী ডেকে তুলে আমাকে , জানালা দিয়ে কে যেন ডাকছে।
লক্ষ্য করলাম পুলিশের পোশাক পরিহিত একজন ব্যাক্তি বাসার ভেতর টর্চলাইটের আলো ফেলে চিৎকার দিয়ে বলছে,‘ দরজা খুলে দিন স্যার আপনার সাথে কথা বলবে।’
বাসার মেইন গেট তখনও তালাবদ্ধ। এরা দেয়াল টপকে আঙ্গিনায় ঢুকেছে বলে মনে হলো। দেয়াল টপকে আসায় সন্দেহে হলো। ডাকাত মনে করে ভয় পেয়ে গেলাম। এরই মধ্যে দরজা খোলার জন্য সার্টারে ক্রমাগত আঘাত করছিলো। আমি বললাম এতো রাতে আপনারা কেন এসেছেন। তাদের একজন বললো ‘দরজা না খুললে তো বলতে পারবো না। ভয় নেই আমরা পুলিশ। আপনার সাথে জরুরী দরকার আছে।‘
বাসায় যেন ঢুকতে না পারে সে জন্য চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু তাদের আচরণ ক্রমস হিংস্রতার পর্যায়ে চলে যায়। বাজে আচরণ করতে থাকে। পরে সাহস করে দরজা খুলে দেই। এএসআই মাসুদ রানা, কনষ্টেবল আব্দুল কুদ্দুস সহ আরো দুই কনষ্টেবল বাসার ভেতর প্রবেশ করে। মাসুদ রানা আমাকে বলে ‘আপনি-জামাত করেন’ এই বলে সে বাসার চতুর্দিকে গোয়েন্দাদের মতো তাকাচ্ছিলো আর সন্দেহজনক কিছু খুঁজতে থাকে। আমি তাদের না সূচক জবাব দেই। ‘তাহলে জেল খাটলেন কেন?- আপনার বিরুদ্ধে তো মামলা আছে।’ কয়েকবছর আগে ষড়যন্ত্র করে আমাকে রাজনৈতি মামলায় জড়ানো হয়েছিলো। আমার এক ব্যবসায়ীক পার্টনার এটা করেছিলো। সেই মামলায় আমি এখন জামিনে আছি বলে জানাই। কিন্তু তাঁরা আমার কথা মানতে নারাজ। এ সময়ম পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খোাঁজার জন্য কনষ্টেবলদের বলে মাসুদ রানা। চারজনে মিলে ঘরের সব মালামাল তছনচ করে ফেলে। আলমিরার উপর একটি ইসলামিক বই পায়। সেটি হাতে নিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। যেন ভয়ংকর কিছু পেয়ে গেছে। বলে, ‘এই তো পেয়েছি। এই বই তো জামাতিরা রাখে। তুমি তাহলে জামাত করো। এইটা দিয়েই তোমাকে জেলে ঢুকানো যাবে।’ আমাকে গালিগালাজ শুরু করে। ‘তোমাকে এখন থানায় যেতে হবে। তোমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে।’
আমি তাদের কথার প্রতিবাদ জানাই-ওয়ারেন্টের কাগজপত্র দেখতে চাই। আমি রাজনীতি করিনা এ কথাও বলি। কিন্তু তাঁরা আমার কথার কর্ণপাত না করে আমাকে হুমকি-ধামকি দিতে থাকে। কোন প্রকার কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। একপর্যায়ে গুম করার হুমকি দেয়। বলে ,‘এখন গুমটুম হয়-তোমাকেও গুম করে ফেললে কেউ জানবে না।’ আমার স্ত্রী ও শিশু কণ্যার সামনেই আমার সাথে দূর্ব্যবহার করে। স্ত্রী ও কণ্যা এমন দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলে। স্ত্রীর হাতে মোবাইল দেখে তাকে হুমকি দিয়ে বলে ‘কাউকে ফোন দেয়া যাবেনা তাহলে ক্ষতি হবে।’ এ সময় এএসআই মাসুদ রানা বাসার মেইন গেট খুলে রাস্তায় গিয়ে দাড়ায়। বাসার ভেতর তিন কনষ্টেবল। একজন আমাকে সিরি কোটার সামনে নিয়ে যায়। বলে স্যার বাইরে অপেক্ষা করছে দেখা করেন। গেটের সামনে দাড়ানো মাসুদ রানার কাছে যাই। সে আমাকে বলে,‘ এক শর্তে তোমাকে আমরা থানায় নেবো না-এই মূহর্ত্তে আমাকে ১লাখ টাকা দিতে হবে।’ আমি অবাক হয়ে যাই। তাছাড়া গভীর রাত হওয়ায় আমার মধ্যে ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছিলো। বাসায় খুজলে বড়জোর ৪-৫হাজার টাকা মিলবে। ১লাখ টাকা আমার কাছে নেই। ‘তোমার স্ত্রীর স্বর্ণ নাই।’ যাও স্বর্ণ নিয়ে আসো। একলাখ টাকা দাও, না হয় স্ত্রীর স্বর্ণ নিয়ে আসো তাহলে তুমি ছাড়া পাবা।’ হাতজোড় করে তাদের কাছে ক্ষমা চাই। পরে কিছুটা নরম হয়ে বলে,‘আচ্ছা ঠিক আছে ৫০হাজার টাকা দাও তোমাকে ছেড়ে দিবো।’ বাসার ভেতর স্ত্রী-কণ্যার কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি জীবনেও আসেনি। তাদের মুখের দিকে চেয়ে মাসুদ রানা কে বলি-আমার এটিএমকার্ডে যা পাওয়া যাবে আপনি নিয়ে যান। এটিমকার্ড থেকে ১০হাজার টাকা তোলা যাবে বলে জানাই। বাকী ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকার একটি চেক দেয়ার প্রস্তাব দেই। সে রাজী হয়।
পরে বাসার ভেতর ঢুকে এটিএম কার্ড ও ২০ হাজার টাকার চেক নিয়ে বের হয়ে আসি। মাসুদ রানা তিন কনষ্টেবলকে পুলিশের গাড়িতে উঠতে বলে। ভোর রাত আনুমানিক ৫টার সময় আমাকে সাথে নিয়ে হেটে হেটে মিরাবাজার ডাচ বাংলার এটিএম বুথের উদ্দেশ্যে যেতে থাকি। এ সময় সে বলে , ‘ কাউকে এসব কথা বলা যাবে না তাহলে ক্ষতি হবে’ । মিরাবাজার বুথে কারিগরি সমস্যা থাকায় টাকা তুলতে পারিনি। পরে বারুতখানা বুথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে লেগুনাতে তোলে। বারুতখানা বুথ থেকে ১০ হাজার টাকা তুলে মাসুদ রানার হাতে দেই । রিসিভ কপিতে তখন লক্ষ্য করি ভোর ৫টা১০ মিনিট। আমাকে বলে এই ঘটনা যেন কাউকে না বলি। আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেই।
এই ঘটনায় আমি বিস্মিত হয়ে যাই। আমার পরিবারের সামনে এভাবে ভয় দেখিয়ে হেনস্থা করে টাকা নিয়ে যাওয়াটাকে আমি কোন সভ্য ঘটনা বলে মানতে পারিনি। এটা আমার কাছে সরকারী পোশাক পরে ডাকাতি করার মতো মনে হয়েছে। দূর্বিষহ এক রাত ছিলো। আজ আমার সাথে করেছে কাল আরেকজনের সাথে করবে। এটা হতে পারেনা। আপনজনদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। সবাই আমাকে বিষয়টি পুলিশের উর্ধ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলে। ৩১ আগষ্ট এসএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এস এম রোকন উদ্দিন’র কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেই। তিনি নিজেও অবাক হন। আইনের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান। উপ-পুলিশ কমিশনার উত্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়ার জন্য বলেন। লিখিত অভিযোগ দেই। কোতোওয়ালী থানায় আমাকে ও অভিযুক্ত ৪ পুলিশ সদস্যেক মুখোমুখি করা হয়। এতে সত্যতা পায় এসএমপি কর্তৃপক্ষ । এরপর ৪ জনকে বরখাস্ত করার খবর পেয়েছি। এটা পুলিশের জন্য যেমনি ভালো সংবাদ তেমনি দেশের জন্যও।
সুত্র: অনলাইন পত্রিকা