বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সন্ধ্যা ৬:৪৩
Home / অনুসন্ধান / মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন আপত্তিকর

মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন আপত্তিকর

image[ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন একজন অভিজ্ঞ ইসলামী বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। জনপ্রিয় বক্তা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ও সুনাম সর্বমহলে সমাদৃত। অধ্যাপনার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণা, লেখালেখি, পত্রিকা সম্পাদনাসহ ওয়াজ ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের বহুমুখী খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের নানা সংকটময় বিষয়ে তাঁর বাস্তবমুখী চিন্তা, পরামর্শ ও নির্দেশনা আলেম সমাজ ও শিক্ষিত মহলে সাড়া জাগিয়ে থাকে।

মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় বিগত ১১ আগস্ট, ২০১০ বিশ্বব্যাংকের আপত্তিকর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে বাংলাদেশের কাওমি মাদ্রাসা সম্পর্কে চরম আপত্তিজনক তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের জবাবে “মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আপত্তিকর প্রতিবেদন” শীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন, যা দৈনিক আমারদেশ পত্রিকায় ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১২ইং প্রকাশিত হয়।

বর্তমানে কওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারী স্বীকৃতি নিয়ে সারা দেশে কওমী অঙ্গন ছাড়াও সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিভক্তি প্রকট আকার ধারণ করেছে। কেউ কেউ বলছেন, কওমী সনদের সরকারী স্বীকৃতি জরুরী। কেউ কেউ বলছেন, সনদের স্বীকৃতি জরুরী হলেও বর্তমান বাস্তবতায় গ্রহণ করা ঠিক হবে না। আরেক পক্ষ বলছেন, সনদের নামে মূলতঃ কওমি আলেম সমাজকে সরকারী নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হবে। বিশ্বব্যাংকসহ পশ্চিমা বিশ্ব গত কয়েক বছর ধরেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে তাগিদ দিয়ে আসছে। এমন প্রেক্ষাপটে ড. আ ফ ম খালেদ হোসেনের প্রবন্ধটিক অনেকের কাছেই তথ্যসমৃদ্ধ হতে পারে ভেবে প্রকাশ করা হল। – ইনসাফ সম্পাদক এর সৌজন্যে]

মাদরাসা শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষাধারা, শিক্ষার মান, জঙ্গি সম্পৃক্ততা ও ধর্মসভা (ওয়াজ, তাফসির, জিকির, সিরাতুন্নবী (সা.) ও দোয়া মাহফিল) সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি কিছু কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ মন্তব্য দুঃখজনক, অনভিপ্রেত ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল বলা যায়। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষার অর্থায়নের উত্স নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বব্যাংক। দেশে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাংক মাদরাসার ওপর গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি ঢাকার হোটেল শেরাটনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আয়োজিত ‘Secondary School-Madrasah in Bangladesh : Incidence, Quality and Implication for Reform’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়, “অনিয়ন্ত্রিত এ মাদরাসার সঙ্গে বাংলাদেশে জঙ্গি নাশকতার সম্পর্ক রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষানীতি এবং কোনো ধরনের তদারকির বাইরে কওমি মাদরাসাগুলো আসলেই ধর্মীয় শিক্ষার নামে কী করছে তা জরুরি ভিত্তিতে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বিশ্বব্যাংক। শিক্ষার ধরন, অর্থায়নের উত্স, শ্রেণীকক্ষের চিত্র, সাংগঠনিক বিন্যাস সব ক্ষেত্রেই কওমি মাদরাসার রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। যদিও তাদের এসব কার্যক্রম সম্পর্কে কারও কোনো স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে রহস্যজনক বিষয়টি হচ্ছে ছাত্রদের পরিচিতি গোপন রাখা। মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রদের ২ দশমিক ২ ভাগ ছাত্র কওমি মাদরাসায় নিবন্ধিত রয়েছে বলে বলা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি হচ্ছে, কওমি মাদরাসায় নিবন্ধিত ছাত্রসংখ্যার চেয়ে বাস্তবে অনেক বেশি ছাত্রের উপস্থিতি দেখা যায়।

তাদের ভাষ্য মতে, সরাসরি বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ গবেষণায় ৪০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষার ওপর জরিপ করা হয়। সাক্ষাত্কার নেয়া হয়েছে ৯ হাজার ছাত্রছাত্রীর। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য যাওয়া হয়েছে ছাত্র ও শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি। গবেষণায় বিশ্বব্যাংক বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার মান, পরিবেশ এবং ভবিষ্যত্ করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে। সমগ্র মাদরাসা শিক্ষা খাতকে সংস্কার করে মূলধারার শিক্ষানীতি এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদ দেয়া হয়েছে এ রিপোর্টে। এ অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইলেন গোল্ডস্টেন, সাবেক অতিরিক্ত সচিব আশাবুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র শিক্ষা বিশেষজ্ঞ মিস হেলেন জে. ক্রেগ এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সেক্টর ম্যানেজার অমিত ধর উপস্থিত ছিলেন। মাদরাসা শিক্ষা খাতের ওপর পরিচালিত গবেষণা রিপোর্টের উল্লেখযোগ্য দিক বর্ণনা করেন অক্সফোর্ড অ্যান্ড রিডিং ইউনিভার্সিটির ডক্টর এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ।

রিপোর্টে মাদরাসা শিক্ষা খাতের বিস্তারের পেছনে দেশের অর্থনীতি একটি বড় কারণ বলেও উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের দরিদ্রতম এলাকা ও গ্রামগঞ্জেই মাদরাসার প্রসার ঘটেছে। দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের ছেলেমেয়েকে মাদরাসাতেই পাঠাতে আগ্রহী হয়।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদরাসারও দ্রুত ব্যাপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশেরই কিছু মাদরাসার ডিগ্রিধারী ছাত্র সঙ্গীত উত্সবে সন্ত্রাসী বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল বলা হয়েছে। এমনকি কিছু বিচারককেও হত্যা করেছে মাদরাসা ছাত্ররা। এরপরও মাদরাসার সংখ্যা বাড়ছে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে এবং সরকারের দুর্বল নজরদারির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে দ্রুত হারে মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে। পাকিস্তানেও একই চিত্র দেখা যায়। তারপরও উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ সংখ্যক ধর্মীয় সভাকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিশ্বের মধ্যে ধর্মীয় সভা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং ইন্দোনেশিয়ার পরে এর অবস্থান।’ বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে নিম্নোক্ত পয়েন্টগুলো সামনে এসেছে।

* কওমি মাদরাসায় কী হচ্ছে সবার অজানা।
* অর্থের উৎস জানা যায় না।
* নিবন্ধিত ছাত্র থেকে বাস্তবে ছাত্র অনেক বেশি।
* মাদরাসা ছাত্ররা গানের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ও বিচারক হত্যা করেছে।
* ধর্মীয় সভার (ওয়াজ, জিকির, সিরাতুন্নবী ও তাফসির মাহফিল) অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন।
* দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে এবং সরকারের দুর্বল নজরদারির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে দ্রুত হারে মাদরাসার সংখ্যা বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এই গবেষণা রিপোর্টের অধিকাংশ বক্তব্য বাস্তবতা বিবর্জিত, আপত্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মাদরাসায় কী হচ্ছে এটা মোটেই অজানা নয়। এখানে গোপনীয়তা বা রহস্যের কিছু নেই। মাদরাসার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত। কওমি মাদরাসার অর্থের উত্স জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অনুদান, সাহায্য ও সহায়তা। নিবন্ধিত ছাত্রের তুলনায় বাস্তবে ছাত্রসংখ্যা বেশি, একথা ঢালাওভাবে বলা অযৌক্তিক। মাদরাসা ছাত্ররা গানের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা ও বিচারক হত্যা করেছে, এ অভিযোগও সর্বৈব মিথ্যা। বাংলাদেশে অধিক হারে ধর্মীয় সভার (ওয়াজ, জিকির, দোয়া, সিরাতুন্নবী ও তাফসির মাহফিল) অনুমোদন দেয়া নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নাক গলানো রীতিমত আপত্তিকর। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হিন্দু ধর্মীয় সভা বা শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মীয় সভা নিয়ে বিশ্বব্যাংক কোনো প্রশ্ন তোলেনি। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলা তো মহত্ কাজ। এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে দেখা রীতিমত অন্যায় ও পক্ষপাতদুষ্ট। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিত্তশালী মানুষের সন্তানেরাও মাদরাসায় পড়ালেখা করে। সন্ত্রাসজনিত কারণে বাংলাদেশের কোনো মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।

মূলতঃ ১৮৬৬ সালের ২১ মে (১২৮৩ হি.) ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ শহরে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনে ‘দারুল উলুম’ নামক যে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়, এটাই ভারতীয় উপমহাদেশে কওমি মাদরাসার সূতিকাগার হিসেবে স্বীকৃত। শতবছর ধরে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা এ অঞ্চলে পবিত্র কোরআন ও হাদিস শিক্ষাদানের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক, চরিত্রবান, যোগ্য ও আদর্শবান জনগোষ্ঠী তৈরির মহত্ কাজ আনজাম দিয়ে আসছে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ধর্ম প্রচার, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সমাজসেবা ও নৈতিক আবহ সৃষ্টিতে কওমি মাদ্রাসার অবদান সবাই স্বীকার করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজ উদ্দীন আহমদ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য- ‘মাদরাসা শিক্ষার একটা গৌরবজনক অধ্যায় রয়েছে। উপমহাদেশে যখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তখন মক্তব-মাদ্রাসা নামে পরিচিত ছিল। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে কমিশনের পর আমরা জানতে পেরেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এসব শব্দ। মাদরাসায় লেখাপড়ার মান উন্নত ছিল। কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি ইতিহাস, দর্শন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক পড়ানো হতো। মাদরাসা থেকে বেরিয়েছেন এ উপমহাদেশের বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে, সমাজসেবার ক্ষেত্রে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অথবা কবি-সাহিত্যিক হিসেবে স্বনামধন্য। তাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কওমি মাদরাসার প্রচলন হয়। এ মাদরাসার ছাত্রদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করে গড়ে তোলার ঐতিহ্য রয়েছে। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম অথবা বিভিন্ন পর্যায়ে জনস্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে কওমি মাদরাসার বড় ভূমিকা ছিল। দেশের একটি বিশাল শিক্ষার্থীর অংশ এখনও কওমি মাদরাসা থেকে আলো পায়’। (নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ২৩.১০.২০০৯)।

মাদ্রাসা শিক্ষা এ দেশের বাস্তবতা। বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় ছড়িয়ে আছে বহু মাদ্রাসা। শিক্ষা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সরকারের বন্ধুবেশী শত্রুদের বেশি সক্রিয় দেখা যায়। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে অভ্যস্ত। এ বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...