চলমান সময়ের আলোচিত একটি বিষয় কওমি সনদের স্বীকৃতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি নিয়ে একটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অনলাইন-অফলাইনে স্বীকৃতির পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার ঝড় বইছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা এখন কী ভাবছেন, স্বীকৃতি নিয়ে বেফাকের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি কী? এ ব্যাপারে কথা বলেন দেশের বিশিষ্ট আলেম ও শিক্ষাবিদ, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার যুগ্মমহাসচিব, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক। স্বীকৃতি বিষয়ে বেফাকের অবস্থান তুলে ধরেছেন। বলেছেন সম্ভাবনা ও শংকার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ এহসানুল হক
সম্প্রতি কওমি সনদের স্বীকৃতি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ঘোষণা দিয়েছেন। এরপর স্বীকৃতি নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই ঘোষণার আগ পর্যন্ত স্বীকৃতির বিষয়ে বেফাকের অবস্থান কী ছিল?
মাওলানা মাহফুজুল হক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণার কিছুদিন আগে সরকার একটি শিক্ষাআইনের খসড়া প্রকাশ করেছে। তার আগে সরকার শিক্ষানীতি করেছে। এই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাআইন পর্যালোচনার মাধ্যমে আমাদের কাছে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, সরকার দেশের সকল শিক্ষা ব্যবস্থার উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এজন্য বেফাক মনে করে স্বীকৃতির নামে সরকার মূলত মাদরাসার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি বেফাকই প্রথম উত্তাপন করেছে। এবং দীর্ঘকাল বেফাক স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করেছে। তাই মৌলিকভাবে স্বীকৃতির দাবি থেকে সরে আসার প্রশ্নই আসে না। বেফাক অবশ্যই স্বীকৃতি চায়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে বেফাক মনে করছে- এখন শুধু স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন নয়। এর আগে আরেকটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি, তা হলো, সরকার যাতে কোনোভাবেই মাদরাসাগুলোর উপর অযাচিত খবরদারি করতে না পারে। বেফাকের এখন মূল চিন্তার বিষয় এটিই।
এটা তো আগের অবস্থার কথা বললেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা পর এখন বেফাকের অবস্থান কী?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এ ব্যাপারে বেফাক দ্রুত আলোচনার ভিত্তিতে নিজেদের অবস্থান ঠিক করবে। পাশাপাশি অন্যান্য বোর্ডগুলোর সাথেও কথা বলবে। ইতোমধ্যেই বেফাক কাজ শুরু করেছে। গত ২২ আগষ্ট সোমবার বেফাকের একটি প্রতিনিধি দল হাটহাজারি গিয়ে বেফাকের সভাপতি আল্লামা আহমদ শফি দা.বা. এর সাথে বৈঠক করেছে। আলোচনা করেছে। এবং ২৭ তারিখ শনিবার বেফাকের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের মিটিং আহ্বান করা হয়েছে।
স্বীকৃতি গ্রহণ করা না করার বিষয়ে আপতত বেফাকের সিদ্ধান্ত কী?
মাওলানা মাহফুজুল হক : সরকার ২০১২ সালে একটি কওমি মাদরাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল। যে বৈঠকের মাধ্যমে সেই শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল সে বৈঠকে কওমি মাদরাসার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্বশীল এক মাত্র বোর্ড বেফাককে বাদ দিয়ে আলেমদের মধ্যে শুধু মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব ও মাওলানা রুহুল আমীন সাহেবকেই রাখা হয়েছিল। সেখানে তারা কওমি মাদরাসার প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের কাউকে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। অথচ বেফাকের পক্ষ থেকে শিক্ষা কমিশন গঠনের সেই বৈঠকে থাকার যথেষ্ট চেষ্টাও করা হয়েছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমাদের কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়, সরকার কোনোভাবেই ব্যাপারটা স্বচ্ছ রাখতে চাচ্ছে না। সরকার চাচ্ছে তাদের আস্থাভাজন কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে কওমি মাদরাসার উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। কওমি মাদরাসার স্বার্থ রক্ষা করা যাদের একমাত্র লক্ষ্য তারা মনে করছে, যেই স্বীকৃতি কওমি মাদরাসার জন্য সুফল বয়ে আনবে সেই স্বীকৃতি প্রদানের দিকে সরকার যাচ্ছে না। তাই স্বীকৃতির নামে কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা ধ্বংস ও কওমি মাদরাসার বর্তমান অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানোর কোনো প্রক্রিয়াকে বেফাক সমর্থন করতে পারে না।
স্বীকৃতি বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো বিষয় না। স্বীকৃতিকে আমরা আমাদের অধিকার মনে করি। এবং আমরা এটাকে আমাদের মতো করে আদায় করতে চাই।
খসড়া আইনের খারাপ দিকগুলো কী বা বড় সমস্যা কোনটি?
মাওলানা মাহফুজুল হক : খসড়া আইনের বেশ কিছু ধারা আছে যা আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভবপর নয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিবন্ধনের শর্ত। সমস্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমরা মনে করি এই নিবন্ধনের অর্থই হলো, কওমি মাদরাসার উপর সরকারের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
সরকার যদি আইন করেই ফেলে তাহলে সেটা তো তারা বাস্তবায়ন করবেই। উলামায়ে কেরাম স্বীকৃতি নিক বা না নিক, তখন কী হবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : তখন উলামায়ে কেরামের কাজ হবে এটাকে প্রতিহত করা। প্রয়োজনে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা। আমরা জানি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সরকারও এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দের নেতৃত্বে উলামায়ে কেরাম যখন এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তখন সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
সরকার এখন যেভাবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, এভাবে স্বীকৃতি গ্রহণ করতে কিছু আলেম প্রস্তুত। তারা জনমত সৃষ্টি করতে চাচ্ছে এবং তাদের মতের স্বপক্ষে কেউ কেউ শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর স্বীকৃতির দাবিতে মুক্তাঙ্গনে অবস্থান কর্মসূচিকেও প্রমাণ হিসেবে পেশ করছে। এই ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : শাইখুল হাদীস রহ. এর আন্দোলনের রোডম্যাপ পরিস্কার ছিল, তিনি সরাসরি বেফাকের নামেই স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো, ওই সময়ের প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট এক নয়। তখন স্বীকৃতির সাথে নিবন্ধনের বিষয় ছিল না, মাদরাসার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারও ছিল না। শাইখুল হাদীস রহ. এর মূল কথা ছিল, বেফাকের উলামাদের নেতৃত্বে স্বীকৃতি যেন বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট হলো কওমি মাদরাসার উলামাদের নেতৃত্বকে দুর্বল করে দিয়ে, তাদের ঘাড়ের উপর অন্য আরেকটি কতৃপক্ষ চাপিয়ে দিয়ে স্বীকৃতিকে বাস্তবায়ন করা। তাই এখানে শাইখুল হাদীস রহ. এর নাম ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। আর শাইখুল হাদীস রহ. যখন আন্দোলন করেছিলেন তখনও মূল ধারাকে বাদ দিয়ে সরকারের নির্বাচিত একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে স্বীকৃতি দেয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। এভাবে সরকারের বাছাইকৃত ক্ষুদ্র কোনো জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে স্বীকৃতি শাইখুল হাদীস মেনে নেননি।
কেউ কেউ বলতে চায়, বিএনপি সরকার স্বীকৃতি দিলে বেফাক সেটা নিবে, কিন্তু আওয়ামী লীগ দিলে নিবে না। এমন কথার কী জবাব দিবেন?
মাওলানা মাহফুজুল হক : এটা একেবারেই ফালতু কথা। স্বীকৃতি বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো বিষয় না। স্বীকৃতিকে আমরা আমাদের অধিকার মনে করি। এবং আমরা এটাকে আমাদের মতো করে আদায় করতে চাই। সেটা যে সরকারই দিক না কেন। যেভাবে নিলে কওমি মাদরাসার স্বার্থ রক্ষা হবে, স্বকীয়তা বজায় থাকবে। আমাদের পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম যেভাবে স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেছেন সেভাবে যারাই দিবে আমরা তাদের থেকেই নিবো।
‘তাহলে কোন প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি দেয়া হলে বেফাক সেটা গ্রহণ করবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : কওমি মাদরাসার প্রকৃত প্রতিনিধিত্বশীল উলামায়ে কেরামের মতামতের ভিত্তিতে যদি স্বীকৃতি বাস্তবায়িত হয়, কওমি মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ যদি তাদের হাতেই বর্তমান ও ভবিষতে থাকা নিশ্চিত হয়, এবং কওমি মাদরাসার নেসাব-নেজাম ইত্যাদির উপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না হয়, কওমি মাদরাসাকে নিবন্ধনের চক্রান্তের মধ্যে ফেলা না হয়- এসব বিষয় যদি নিশ্চিত হওয়া যায় তাহলে বেফাক অবশ্যই স্বীকৃতি নিবে। রাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহিতা থাকবে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রতিনিধিত্বশীল উলামায়ে কেরামের হাতে।
সরকার যদি উলামায়ে কেরামদের মাধ্যমেই শিক্ষা কমিশন করে, এবং তারা বেফাকের বাইরের লোকজন হয় তখন বেফাক কী করবে?
মাওলানা মাহফুজুল হক : বেফাককে বাদ দিয়ে কওমি মাদরাসার প্রকৃত প্রতিনিধি নির্ধারণ সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল আলেমদের ৮০ পার্সেন্ট বেফাকের সাথেই আছেন। কাজেই ৮০ ভাগ উলামায়ে কেরামকে বাদ দিয়ে যদি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয় এবং বলা হয় এটা আলেমদের প্রতিনিধিত্বশীল কর্তৃপক্ষ, তাহলে এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার হবে। তখন বুঝা যাবে এটা সরকারের একটা দূরভিসন্ধি। এবং মাদরাসাগুলোকে তার মূল ধারা থেকে বিচ্যুত করার একটা প্রক্রিয়া।