ড. ইউসুফ আল কারযাভী : ইসলামের মৌলিক অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের মধ্যে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের প্রতিবিধান উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে দু’টি মৌলিক উপাদানের কারণে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তন্মধ্যে একটি হচ্ছে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান। ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরাই তো শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে’ (সূরা আলে ইমরান ৩ : ১১০)। মু’মিনদের মৌলিক গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে কুরআন কারীমে বলা হয়েছে : ‘তারা হচ্ছে আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী, তাঁর ইবাদাতকারী, তাঁর প্রশংসাবাণী উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য জমিনে বিচরণকারী, তাঁর সামনে রুকু ও সিজদাকারী, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধানকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী’। (সূরা তাওবা ৯ : ১১২)। মুমিন নারীরা এখানে মুমিন পুরুষদের মতো, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনে তাদেরও অংশগ্রহণ ও ভূমিকা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, তারা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে’ (সূরা তাওবা ৯ : ৭১)। ঈমানের দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির একে অপরের ওপর ভ্রাতৃত্বের অধিকার রয়েছে, এমনিভাবে প্রত্যেক মুমিন নারীরও রয়েছে।
এ বিধান পালনে যারা সচেষ্ট থাকে কুরআন কারীমে তাদেরকে যেমনিভাবে সাধুবাদ জানানো হয়েছে, তেমনিভাবে যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসে না তাদেরকে নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে। আল্লাহর কুরআনে ঘোষণা দিচ্ছে : ‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ ও মরিয়ম পুত্র ঈসার আ: মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি বড়ই জঘন্য ছিল’ (সূরা মায়েদা ৫ : ৭৮-৭৯)। এভাবে একজন মুসলমানের পরিচয় শুধু এমনটি হতে পারে না যে, সে শুধু নিজেরই কল্যাণ কামনায় ব্যস্ত থাকবে, ভালো কাজ করবে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। নিজস্ব পরিমণ্ডলেই তার যাবতীয় কর্মতৎপরতা সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য কোনো ভালো ও কল্যাণের প্রতি তার কোনো মনোনিবেশ থাকবে না; যদিও তার চোখের সামনেই তা নিঃশেষ ও ধ্বংস হয়ে যায়। এমনিভাবে তার চতুর্পাশে কোনো খারাপ কিছুর জন্ম ও লালন-পালন দেখলেও সে তা এড়িয়ে গিয়ে নিজের চরকায় তেল ঢালার কাজে ব্যস্ত থাকবে, একজন মুসলিমের ব্যক্তিত্ব কখনো এমনটি হতে পারে না।
বরং একজন মুসলমানের সত্যিকার পরিচয় হচ্ছে সে যেমনিভাবে নিজের কল্যাণ কামনায় রত থাকবে তেমনিভাবে অপরের কল্যাণ কামনাও তার মনোনিবেশের বাইরে থাকবে না। কুরআন কারীমের ছোট একটি সূরায় সংক্ষিপ্ত ভাষায় মুসলিম ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে : ‘সময়ের কসম! মানুষ আসলেই বড় ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে এবং একজন অন্যজনকে হক থাকার ও সবর করার উপদেশ দেয়’ (সূরা আল আসর)। সুতরাং একে অপরকে হক কথা ও সবরের উপদেশ দেয়ার কাজে মনোনিবেশ ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুসলমানদের মুক্তির দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। একেই কুরআনের অপর জায়গায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের প্রতিবিধান হিসেবে ব্যক্ত করা হয়েছে। আর এটিই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির একমাত্র জামিনদার।
সৌজন্যে : অন্যদিগন্ত