মুহাম্মাদ সাজিদ করিম : কোন সময়টি ছিল মুসলিম উম্মাহর জীবনের সবচেয়ে কালো অধ্যায়? কোন সময়ে মুসলিম উম্মাহ সর্বনিম্ন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল? ১১দশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন মুসলিমেরা চেয়ে চেয়ে ক্রুসেডারদের হাতে এন্টিয়ক আর জেরুসালেমের পতন দেখলো, তখন? ১৩দশ শতাব্দীতে মঙ্গলদের আক্রমণের সময়টি যখন বাগদাদ ও দিমাশকের পতন হয়েছিল? নাকি আন্দালুসের মুসলিম সভ্যতা যখন তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে গেল?
যদি ভেবে থাকেন এটা অনেক আগের কোন এক সময়ে তাহলে ভুল করবেন। মুসলিম উম্মাহ তার সবচেয়ে লজ্জাজনক ক্রান্তিকাল পার করেছে দুই-এক প্রজন্ম আগে, আমাদের দাদা ও পরদাদাদের সময়ে। তবুও রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর ভবিষৎবাণী অনুযায়ী এতো বাজে অবস্থার মাঝেও একটা দল সবসময় হকের পথে টিকে ছিল ও লড়াই করে গেছে। বানী ইসরাইল বা অন্যান্য উম্মাতের মত এই উম্মাহর সবাই একই সাথে পথচ্যুত হয়নি। গুটিকয়েক কিছু মর্দে মুজাহিদ এতো খারাপ অবস্থার মাঝেও আল্লাহর বাণী সুউচ্চ করার জন্য সারা জীবন লড়াই করেছেন, অনেকে শহীদ হয়ে গেছেন। উমার মুখতার, আহমাদ শারীফ আস সেনুসি, মুহাম্মাদ ইবন আব্দিল কারিম আল খাত্তাবী, ইযযদ্দীন আল কাসসাম প্রমুখের নাম আজও মুসলিমেরা গর্বভরে স্মরণ করে।
বিংশ শতাব্দী শুরুর প্রাক্কালে প্রায় সমগ্র আরব বিশ্ব ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে একতাবদ্ধ। এরপর আস্তে আস্তে একের পর এক মুসলিম ভূখণ্ড ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, স্পেন ও ইতালির খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যের অধীনে হারিয়ে যেতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পূর্বেই বর্তমানের মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর, সুদান, আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনসহ খালিজের ক্ষুদ্র দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদী খ্রিষ্টান দেশগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কলোনিতে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দুই বছর উসমানীয় সাম্রাজ্য এশিয়ায় সাফল্যের সাথে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়। গাল্লিপোল্লি ও ‘কুত’ এর যুদ্ধে তারা মিত্র শক্তির বিপক্ষে বড় রকমের বিজয় লাভ করে। ১৯১৭ সাল থেকে পরাজয়ের ধারা আরম্ভ হয়। ১৯১৭ ও ১৯১৮ সাল জুড়ে একের পর এক ইসলামের দুর্গের পতন হতে থাকে ফ্রেঞ্চ ও ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে যেগুলো মুসলিমদের ইতিহাস ও আবেগের সাথে জড়িত। ধরুন আপনি সেই সময় খবর শুনছেন; ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী সামাররা ও বাগদাদের পতন হয়েছে; পতন হয়েছে আলী (রাঃ) এর খিলাফতের রাজধানী কুফার। এর কিছুদিন পরেই শুনলেন ব্রিটিশ ও ফরাসী বাহিনী ঢুকে পড়েছে উমাওয়ী খিলাফতের রাজধানী দিমাশকে। পতন হয়েছে তায়েফ, তাবুক, মসুল, সিনাই, গাজা, ফিলিস্তিন, আম্মান, হালাব, আন্তাকিয়ার। বাইতুল মাকদিস যাকে ১১৮৭ সালে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী খ্রিষ্টান সৈন্যমুক্ত করেছিলেন, যা সাতশো ত্রিশ বছর মুসলিমদের দখলে ছিল, ১৯১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর তাতে আবার বিজয়ী বেশে প্রবেশ করেছে ব্রিটিশ জেনারেল অ্যালেনবি ও তার সেখানে জেনারেল অ্যালেনবি দম্ভভরে ঘোষণা দিয়েছেঃ অবশেষে ক্রুসেড শেষ হলো। জানতে পারছেন, ফ্রেঞ্চ জেনারেল গৌরার্ড বিজয়ী বেশে দিমাশকে প্রবেশের পর সালাহউদ্দীনের কবরে গিয়ে সেখানে লাথি মেরে বলেছে, উঠো সালাহউদ্দীন, আমরা ফিরে এসেছি। আর মক্কা? সেতো ১৯১৬ সাল থেকেই ব্রিটিশদের পুতুল বাহিনীর হাতে বন্দী। ১৯১৮ সালের শেষে এসে একজন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকাবে আর নিজেকেই প্রশ্ন করবে, আর কোন শহর ইহুদী-খ্রিষ্টান আর তাদের দোসরদের পদানত হওয়া থেকে কি বাকী আছে?
উত্তর হল মাদীনাহ, রাসুলের (সঃ) শহর, যে শহরে স্থাপিত হয়েছিল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র, সেই মাদীনাহ এখনও গৌরবোজ্জ্বল দূর্গ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। শত হামলা আর প্রতিকূলতা একে ও এর প্রতিরক্ষাকারীদের টলাতে পারেনি। এই প্রতিরক্ষার মূল দায়িত্ব যে সিপাহসালার নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তার দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখে শত্রুরা পর্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিল; তাকে ব্রিটিশেরা নাম দিয়েছিল টাইগার অফ দ্যা ডেজার্ট- মরুভূমির বাঘ। তুর্কিরা ভালোবেসে তাকে ডাকে ‘মেদিনে মুদাফি’- দ্যা ডিফেন্ডার অফ মাদীনাহ। একটি বিদেশী প্রবাদ আছে, এক ভেড়ার নেতৃত্বে থাকা এক হাজার সিংহের বাহিনী পরাজিত হবে এক হাজার ভেড়ার বাহিনীর নিকট যদি তার নেতৃত্বে থাকে এক সিংহ। মাদীনার প্রতিরক্ষায় আত্মোৎসর্গকৃত এই সিংহের নাম ‘উমার ফাখরুদ্দীন পাশা’। (চলবে)