২০০৯ সালের এপ্রিলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৬৪ জেলার প্রশাসকদের অধীনস্থ কওমি, নূরানী, ফোরকানিয়া, হাফেজি, আহলে হাদিস ও মসজিদভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের একটি তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়। এ লেখা প্রস্তুত হওয়ার সময় পর্যন্ত ঢাকা জেলা বাদে বাকি ৬৩ জেলার মাদ্রাসার অসম্পূর্ণ তথ্য সংবলিত তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। এই অসম্পূর্ণ তালিকার ওপরই ভর করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। কারণ ২০১২ সালের এপ্রিলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার নেতৃবৃন্দের বৈঠক শুরুর আগে শেখ হাসিনাকে কওমি মাদ্রাসার অবস্থানপত্র হস্তান্তর করা হয়। অবস্থানপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত জেলাভিত্তিক তালিকায় ৬৩ জেলায় মাদ্রাসার সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২৪ হাজার ৯৩১টি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরিত অবস্থানপত্রের ভূমিকায় মোট সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৯০৬টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা অবস্থানপত্র ও অসম্পূর্ণ তালিকা নিয়ে বৈঠকের আগেই গণভবনে হাজির হন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই শীর্ষ ব্যক্তি। গণভবনের ওই বৈঠকের ধারাবাহিকতা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন ও পরবর্তী ধাপে কওমি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ। কওমি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ বাতিলের দাবিতে অটল রয়েছেন হেফাজত নেতৃবৃন্দ।
পাঠক, অন্যান্য জেলার কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বলার আগে একটু ব্যাখ্যা করে নিই কেন জেলা প্রশাসকদের তৈরি করা তালিকা অসম্পূর্ণ। এক মাসের সময় দিয়ে ২০০৯ সালের এপ্রিলে জেলা প্রশাসকদের কাছে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছিল মাদ্রাসার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও ধরন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংখ্যা, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালকগণের নাম, অর্থের উত্স, বর্তমান তহবিলের অবস্থা, হিসাব ব্যয় নিরীক্ষা পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবিষয়সমূহের তথ্য সংবলিত তালিকা তৈরি করতে। প্রধানমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তরিত কিন্তু জনসাধারণের জন্য অপ্রকাশিত ওই তালিকায় শুধু মাদ্রাসার জেলাভিত্তিক সংখ্যা ও প্রতিষ্ঠানের ধরন উল্লেখ রয়েছে। তালিকা অনুযায়ী নওগাঁয় ৮০৪, টাঙ্গাইলে ৮৭৭, চট্টগ্রামে ৭৪৮, নীলফামারীতে ৬৬৮, গাজীপুর জেলায় ৬৫৮, সিলেটে ৫৮৬, কিশোরগঞ্জে ৫৫৩, বগুড়ায় ৫৩০, ভোলায় ৪৭৭ এবং যশোরে ৪৪২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
পাঠক লক্ষ করবেন, জেলা প্রশাসকদের তথ্যে চট্টগ্রামে ৭৪৮টি মাদ্রাসার উল্লেখ থাকলেও ২০১২ সালের এপ্রিলে পুলিশ সদর দফতরের এক এআইজির তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলার ১৫ থানায় ১৬৪টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এর ছাত্রসংখ্যা ৬৭ হাজার ২০৭ এবং শিক্ষক ২ হাজার ৯০৬। হাটহাজারীর কওমি মাদ্রাসাসমূহ সম্পর্কে পুলিশ সদর দফতরের অনুসন্ধান শীর্ষক প্রতিবেদনটি পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে উল্লেখ রয়েছে, দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম এশিয়ার বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা। হাটহাজারী থানা এলাকার ১৩ মাদ্রাসায় ছাত্রসংখ্যা ১২ হাজার, ফটিকছড়ির ৯ মাদ্রাসায় ৮ হাজার ৯৬০ ও পটিয়ার ৯টিতে ৮ হাজার ৪১৪ জন। সাতকানিয়ার ১৯ মাদ্রাসায় ৫ হাজার ৫৯৬ জন হলেও সন্দ্বীপের ৮ মাদ্রাসায় ৫ হাজার ৩৯৩ ও রাউজানের ১৫টিতে ৫ হাজার ৫২ জন এবং বাঁশখালীর ১২ মাদ্রাসায় ৪ হাজার ৩৩৪ জন ছাত্র।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সহায়তায় পরিচালিত ‘কওমি মাদ্রাসা স্যাম্পল সার্ভে ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ৫৪৪ কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫৮ হাজার ৪৩২ এবং শিক্ষক সংখ্যা ৫ হাজার ৬২৪ জন। জপিরকৃত এসব মাধ্যমিক ও তদূর্ধ্ব শ্রেণির মাদ্রাসার সঙ্গে সংযুক্ত (নূরানী মক্তব, হেফজ ও সাবাহী মক্তব) প্রতিষ্ঠানে আরও ৫১ হাজার ৫৬৩ জন শিক্ষার্থী মিলে মোট সংখ্যা ১ লাখ ৯ হাজার ৯৯৫ জন।
মাদ্রাসার এ জরিপে আরও সহায়তা করেছেন কওমি মাদ্রাসার বৃহত্তম শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া। ৫৪৪টি কওমি মাদ্রাসার মধ্যে সর্বাধিক ১৮৯টি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ময়মনসিংহে ১৪৪, মৌলভীবাজারে ৭৮, পিরোজপুরে ৪০, মাদারীপুরে ৩৯, রাজশাহীতে ৩২ ও ঝিনাইদহে ২২টি।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ জেলার ৫২ উপজেলায় মোট ৫৪৪টি কওমি মাদ্রাসার মধ্যে ১৫৩টির প্রতিষ্ঠা ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৮৩ সাল থেকে জরিপকাল (২০১০) পর্যন্ত মিউনিসিপ্যাল ও মেট্রোপলিটন এলাকায় কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার হার বেড়েছে। প্রতিবেদন বলছে, মোট ৫৪৪টির মধ্যে ৩১টি ১৯৪৭ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত, আর পাকিস্তান আমল অর্থাত্ ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে ৬৩টি, ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে ৫৪টি, ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০০ পর্যন্ত ২৪০টি।
দেশীয় সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন এবং বিদেশি অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এবার পবিত্র জাতীয় সংসদের দিকে চোখ ফেরাই। নবম জাতীয় সংসদের (২০০৯-২০১৩) পাঁচ বছর মেয়াদে কওমি সংক্রান্ত কয়েকটি প্রশ্ন, প্রশ্নকর্তা সাংসদের দলীয় পরিচয় ও শিক্ষামন্ত্রীর দেওয়া লিখিত জবাবের চুম্বক অংশ :
২০০৯ সালের আগস্টে সুনামগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিকের প্রশ্ন ছিল : শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়, অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি, দেশে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করিবার কোনো পরিকল্পনা সরকারের আছে কি না?
২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর একই সাংসদের করা অপর এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নিয়মরীতি অনুসরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসাগুলোর কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছি। তাদের সাথে আলোচনা করেই একটি পদ্ধতি স্থির করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে কওমি মাদ্রাসার তথ্য যাচাইয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যাচাই কার্যক্রমের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’
২০১৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সরকার আওয়ামী লীগ সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষের (মুন্সীগঞ্জ-১) করা এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে মন্ত্রী জানান, বর্তমান সরকার কওমি মাদ্রাসাকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে চায়। ইতোপূর্বে কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। টেবিলে উত্থাপিত জবাবে মন্ত্রী আরও বলেন, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন নামে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে।
বিএনপি সাংসদ মোসাম্মত্ শাম্মী আক্তারের প্রশ্নের জবাবে ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী সংসদকে জানান, ‘দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৩১টি। দেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহের জন্য একটি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনাক্রমে অন্যান্য মাদ্রাসার ন্যায় কওমি মাদ্রাসার জন্য পাঠ্য কার্যক্রম ও কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ শীঘ্রই শুরু করা সম্ভব হবে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের পর দেশে বিদ্যমান কওমি মাদ্রাসার পরিসংখ্যান সম্পর্কিত কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।’
শাম্মী আক্তারের প্রশ্ন ছিল কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা কত এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা উন্নয়নে বর্তমান সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না; এবং থাকিলে তাহা কী?
২০১৩ সালের ১৯ জুন মাসে আওয়ামী লীগ সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজন জানতে চেয়েছিলেন, দেশের জেলাওয়ারি কওমি মাদ্রাসার সংখ্যার চিত্র; শিক্ষার্থী-শিক্ষক সংখ্যা এবং এগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়? কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করিবার ক্ষেত্রে বাধা কোথায়? ১৯ জুন সংসদে দেওয়া জবাবে বলা হয়, জেলা প্রশাসকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২৪ হাজার ৯৩১টি। এ সকল মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন না থাকায় মাদ্রাসাওয়ারি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ে নেই।
পবিত্র সংসদে এবং আধাপবিত্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও যদি কওমিসহ সকল অনিবন্ধিত মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা যুগ যুগ ধরে অমীমাংসিত থেকে যায় তবে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এসে ভিনদেশিরা এ নিয়ে নানা ঘটনা ঘটানোর সুযোগ নিতে চাইবেন।
সৌজন্যে : দৈনিক সকালের খবর