ইউসুফ বিন তাশফিন::
ধারাবাহিক উপন্যাস – স্বপ্নবিলাস ২০৩১
শাইখ তাকিউদ্দীন আল-কিন্দীর পছন্দের অফিস বেফাক হেডকোয়ার্টারের ২২ম তালা। ২২তালার দক্ষীণ পাশের জানালাটা খুললেই বুকের মাঝে চিনচিনিয়ে ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু এই ব্যাথা তাকে সুখদেয়। কষ্ট লাঘবে সহায়ক হয়। দিনে কম হলেও তিনবার জানালার ফাকগলে কী-যেন দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। ষাটোর্দ্ধ তাকিউদ্দীনের নাম খ্যাতি আছে পুরো দেশব্যপী। ইসলামি অর্থনীতির একজ সেরা চিন্তক। কওমি ইসলামি ব্যাংকের শরীয়াবোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তা। তিনি নিজথেকে পছন্দ করে হেডকোয়ার্টারের উপরের তলা বেছে নিয়েছেন। খা খা রোদের মাঝে এয়ারকন্ডিশন অন করতে নারাজ।গরমে বার বার টিসু দিয়ে কপাল মুছে মুছে ফাইলে স্বাক্ষর করছেন। ‘এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঘরে ঘরে যেদিন আমরা ঠান্ডা বাতাস পৌছিয়ে দিতে পারবো সেদিন হয়তো এসির বাতাস তৃপ্তিভরে নেবো। জনগণের টাকা দিয়ে এভাবে আরামে আরামে বিদ্যুতের বিল বাড়ানোর কোন মানে আছে?’
গ্রামের নাম কান্দীগাও। ছোটবেলায় মায়াভরে উসতাজ একদিন বললেন, তাকিউদ্দীন আল-কিন্দী কেমন আছো? সেই থেকে ক্লাসের ছাত্ররা একটু ঠাট্টা করে তাকে আল-কিন্দী বলে ডাকা শুরু করলো। তখন থেকেই এই কিন্দী নামটি তার আর পিছু ছাড়েনি। একছেলে ও একমেয়ের সংসারে বেগম জহুরা আখতার হলেন প্রিয় সহধর্মীনী। একদিকে মহিলা মাদরাসা থেকে টাইটেল পাশ আলেমা অপরদিকে ঢাকা ভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে করেছেন মাস্টার্স। শিক্ষকতায় দারুণ জোক। তার আগ্রহেই শাইখ আল-কিন্দী নিজে ‘বানাত কেডেট মাদরাসা’ নামে ঢাকা শহরের অদূরে একটি মেয়েদের মাদরাসা কায়েম করেদেন। তবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আগে আল-কিন্দীর ২টা শর্তছিলো যে, তিনি কখনো এই প্রতিষ্ঠানের ভিতরে যাবেননা। সাথে তাকে পবিত্র কোরআন মজীদের হাফেজাও হতে হবে। স্বামীর কথায় একটুও বিচলিত না হয়ে মাত্র ৬মাসে পুরো কোরআন মুখস্থ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। চল্লিশোর্ধ নারীও তাহলে হাফেজা হতেপারে যদি অন্তরে জজবা থাকে। মায়ের সাথে কম্পিটিশন করে খালিদ ও সালমা শপথ নিলো তাদের হাফিজ হওয়া চাই। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার পাশাপাশি তারা মায়ের কাছে সবক শোনানো আরম্ভ করলো। কে কার আগে হাফেজ হবে ভাই বোনের মাঝে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা। অবশেষে খালিদের কাছে সালমাকে হার মানতে হলো।
সালমার টাইটেল ও ভার্সিটি একসাথে কম্প্লিট হলো। গ্রাজুয়েশন সারমনীতে মা ও বাবাকে যখন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো তখন তাকে বিরাট একটা ধাক্বা সামলাতে হয়েছে। সে নেকাব খুলবেনা। তাতে গ্রাজুয়েশন সারমনি ভেস্তে যাক কোন অসুবিধা নেই। অগত্যা ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ নেকাব সহ তাকে গ্রাজুয়েশন সারমনীতে অংশগ্রহনে সুযোগ দিলেন। তার অটল এই মানসিকতা দেখে পুরো হল সেদিন প্রভাবিত হয়েছিলো। হিজাবের প্রতি কিছুটা অবজ্ঞা মনোভাব যখন ছিলো কারো কারো তখন তার পরীক্ষার রিজাল্ট শোনে সবাই বিষ্ময়ে হতবাক। এরোস্পেইস ইঞ্জিনিয়ারিং ও সুপার কম্পিউটার সাইন্সে সর্বোচ্চ মেধা তালিকায় সালমা সেরা হয়েছে। আমেরিকার হাভার্ড বৃটেনের অক্সফোর্ড সহ দুনিয়ার নামিদামি ইউনি থেকে অফার আসতেছে ফ্রী টিকেট ফ্রী কোর্স সহ স্থায়ী নিবাস এবং চাকুরির নিশ্চয়তা।
সালমার এই এগিয়ে যাবার মাঝে আছে এক করুণ ইতিহাস। বিষাদময় যন্ত্রণা। কলিজা মুচড়ানো চিনচিনিয়ে এই ব্যথা তার বাবার মতো তাকেও কুকড়ে কুকড়ে খাচ্ছে। মার কষ্ট হলেও তা কাউকে দেখাতে চাননা। লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।
শাইখ তাকিউদ্দীন আল-কিন্দী পড়াতেন বোখারী শরিফের প্রথম খন্ড। ঘর থেকে দারসগাহ মসজিদ মাঝে মধ্যে দ্বীনী মাহফিলে ওয়াজ নসীহতের জন্য যাওয়া। এছাড়া দুনিয়ার আর কোন কাজে তিনির মনোযোগ ছিলোনা। মুহতামিম সাহেব মাদরাসা চালাচ্ছেন। আসাতেজায়ে কেরাম পড়াচ্ছেন। বোর্ডিংগে ছাত্র আছে। অজু গোসল নামাজ সবই চলছে সুন্দররূপে। মাঝে মধ্যে বাহিরে টুকটাক মিছিল হয়। তাতে সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই বুঝতেননা। পড়া আর পড়ানি ছাড়া তিনির খাতায় ছিলোনা ভিন্ন কিছু। ঘরের ভিতর প্রতিদিনের মতো আজও তিনি সকল জরুরত শেষে বিছানায় যাবেন অমনি ভাইবোন দুজন এসে বললো-আসসালামু আলাইকুম।ওয়া আলাইকুমুস সালাম বলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে তাদের পানে লক্ষ করে বললনে- বাহ আজ দেখি আমার কলিজার দুটো অংশ একসাথে, কি বিষয়?
এর আগেও তিনির পরিবারে দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক চায়ের টেবিল গরম হয়ে উঠতো। বেগম জহুরা আখতার শাইখ আল-কিন্দী ভাইবোনের জ্ঞানগর্ব আলোচনা তর্ক বিতর্ক শোনে খুশিই হতেন। কিন্তু আজ বেডরুমে এসে কি বলতে চাইছে দেখে একটু সতচকিত হলেন। কী ব্যাপার তোরা এসেছিস! কথা বলিস না কেন? একজন শিয়রের পাশে আরেকজন পায়ের কাছে বসে সালমাই প্রথম শুরু করলো। আব্বা আব্বা আব্বা! জী মা বলো কি হয়েছে? সে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে এমন ভাবে চোখের পানি ফেলছে যেন কথা আর বেরিয়ে আসতেছেনা। খালিদ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো আব্বা- ওর মন খুব নরম তাই ঠিক করে বলতে পারতেছেনা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় আল্লাহ ও তার রাসুল ইসলাম ও কোরআন নিয়ে খুব খারাপ ভাবে লেখালেখি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন কলেজ ভার্সিটিতে মেয়েদের হিজাব টেনে টেনে খোলে ফেলা হচ্ছে। দাড়ি টুপিওয়ালা কাউকে দেখলে জংগী বলে জেলে পুরে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। দ্বীনী কোন বইপত্র কারো কাছে পেলে পুলিশ জেহাদী বই বলে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। মাদরসায় মাদরাসায় তল্লাসি হচ্ছে জংগী খুঁজার নামে। আজ আমাদের ইসলাম ঈমান আর আল্লাহ ও রাসুল নিয়ে এভাবে প্রকাশ্যে নাফরমানী চলবে আমরা কি করে ঘরে বসে থাকতে পারি? খালিদের কথার রেশ শেষ না হতেই সালমা বলা শুরু করলো। আব্বা আমাদের মাদরাসার ৪জন মেয়েকে জংগী কানেকশন বলে পুলিশ বেঁধে ধরে নিয়ে গেছে। আমি তাদের একজনকে জানি তিনি গর্ভবতী। অথচ তাকে ধাক্বামেরে মাটিতে ফেলে দেয়। তাদের সম্পর্কে আমি খুব ভাল করে জানি যে আসলে তারা কেউই জংগী টংগীর সাথে কানেকশন ছিলোনা। এভাবে কাউকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে দেশটাকে যেন একটা জংলী দেশে রূপান্তরীত করা হচ্ছে। আমরা কি এভাবে শুধু নীরব তামাশাই দেখে যাবো? এইদিন বেশি বাকি নেই যে ওরা মুসলমানদের ঘরে ঘরে গিয়ে নামাজি লোক দেখে গ্রেফতার করে নিয়ে শেষ করে দিবে। সালমার কথা মধ্যখানে থামিয়ে তাকিউদ্দীন আল-কিন্দী আধশোয়া থেকে বসে পড়লেন। কর্তব্যের বিষয়ে তাকেও বিচলিত করে তুললো। কারণ পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন মাধ্যমে তিনিও ইদানিং সব খবরা খবর পাচ্ছেন। সন্তানদের ঈমানী জজবা ও কিছু করার দায়িত্ববোধ দেখে পুলক অনুভব করলেন। বললেন তা অবশ্যই, আমাদের এভাবে বসে বসে শুধু বোখারী শরিফের দারস দিলে চলবেনা। যে মাদরাসা আর দারসে বোখারী ইসলাম ও মুসলমানদের মান সম্মান ইজ্জত আবরু রক্ষা করতে পারেনা। কোরআন আল্লাহ ও তার রাসুলে সম্মান রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেনা তা দিয়ে আমরা কি করবো? ছেলে-মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া দিয়ে বললেন- চিন্তা করোনা এসবের বিরুদ্ধে আমাদের বিহিত একটা কিছু করতেই হবে। তবে একা নয় সম্মিলিত ভাবে সকলকে সাথে করে কিভাবে কি করা যায় তার চেষ্টা করে যাবো ইনশাআল্লাহ। রুম থেকে সন্তানদ্বয় বেরিয়ে গেলেও এক সেকেন্ডের জন্য আর বিছানায় যেতে মন চাইলোনা। বেগম জহুরা খাস কামরা থেকে নামাজ তিলাওয়াত শেষ করে এসে দেখেন শাইখ আল-কিন্দী পায়চারী করছেন। কী হলো বিছানায় গেলেননা এখনো? বেগমের আওয়াজ শোনে একটু সম্বিত যেন ফিরে পেলেন। বললনে আমাকে এক গ্লাস পানি দাও।