মুসা আল হাফিজ::
কয়েকটি কথা বলবো, এ রচনার ভাবনাসূত্র বুঝার জন্য। প্রথম কথাটি হলো বাংলাসনের জন্মসূত্র। ইতিহাস বলে, বাংলা সন হিজরী সনেরই বিবর্তিত রুপ।সবাই জানেন হিজরী সন চান্দ্রবর্ষ। সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্র বর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে।চান্দ্র বর্ষে মৌসুম ঠিক থাকে না।অথচ চাষাবাদ, খাজনা আদায় সহ অনেক কাজ মৌসুমের উপর নির্ভরশীল।মুসলিম জাহানজুড়ে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চললেও উপমহাদেশে ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র মৌসুমগত সমস্যা সামনে নিয়ে আসে।ফলে প্রয়োজন পড়ে সৌরবর্ষের।সম্রাট আকবর একারণে হিজরী চান্দ্রবৎসরকে সৌরবর্ষে রুপান্তরের আদেশ দেন।আদেশ পালন করেন তার দরবারের বিজ্ঞানী ফতহুল্লাহ সিরাজী।৯৯২ হিজরীতে হিজরী চান্দ্রবর্ষ হিজরী সৌরবর্ষরুপে ভারত উপমহাদেশে চালু হলো। তবে আকবর যেহেতু এ ঘটনার ২৯ বছর আগে সিংহাসনে বসেন, অতএব বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হলো ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে। এর আগে বাংলায় প্রচলিত ছিলো শকবর্ষ। এর পয়লা মাস ছিলো ৈচত্র।কিন্তু ৯৬৩ হিজরির মুহাররম মাসে যেহেতু বাংলা মাস ছিলো ৈবশাখ, তাই নতুন সনের পয়লা মাস ৈবশাখকেই ধরা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন যেটা, সেটা হলো এখন ১৪২৩ বাংলা হয় কীভাবে? হলো, কারণ রাসূল সা, এর হিজরত থেকেই এ পঞ্জিকার শুরু।১৪২৩ এর মানে হলো হুজুর সা, এর হিজরতের ১৪২৩ বছর।সৌর বছর চান্দ্র বছরের চেয়ে ১১/১২ দিন বেশি।প্রতি ৩০ বছরে চান্দ্র বছর এক বছর বেড়ে যায়। এজন্য ১৪৩৭ হিজরি সাল মোতাবেক বাংলা ১৪২৩ হয়েছে। এর মানে বাংলাসনের গোটা ঐতিহ্য হচ্ছে মুসলমানী ঐতিহ্য।
দুই-
এ দেশের প্রাচীন মানুষেরা ছিলো দ্রাবিড়।দ্রাবিড় মানে নূহ আ, এর বড় ছেলে হামের বংশধর। দ্রাবিড়দের উপর আগ্রাসন চালায় বহিরাগত অার্যরা। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের দিকে। তারা ভারতে চালু করে অার্যধর্ম, যা পরে হিন্দুধর্মের রুপ নেয়।আর্যরা সর্বদাই অনার্য ধর্ম ও সভ্যতাকে তাচ্ছিল্য করেছে।তারা ঘৃণা করতো বাংলা ভাষা ও বাঙালীকে।বাংলা ভাষাকে বলতো ইতরদের ভাষা। বেদ ও পুরাণে বাংলা ভাষাকে দাসের ও পক্ষীর ভাষা বলা হয়েছে, বাঙালীকে বলা হয়েছে দস্যু। তারা বাঙালী জাতিসত্তা ও ভাষাকে খুন করার সকল প্রয়াস অব্যাহত রাখে। তারা লক্ষ্য হাসিল করেই ফেলতো।কিন্তু বাঁধা দিলো মুসলিম বিজয়। বিজয়ী মুসলিমরা বাঙালী ও বাংলা ভাষাকে দিলেন নবপ্রতিষ্ঠা। নবউদ্যমে দাঁড়িয়ে গেলো এ মাটির সাংস্কৃতিক সত্তা।বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে নববিকাশে উজ্জীবিত এ সংস্কৃতিকেই বলা হতো বাংলা সংস্কৃতি। আর্যরা এ বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো বাধ্য হয়েই।
কিন্তু ১৭৫৭ সালের পরে তারা ঘুরে দাঁড়ালো।ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর দাসত্ব গ্রহণ করে তারা প্রভাব ও সুযোগ- সুবিধায় বলিয়ান হলো।বাংলা ভাষা, বাঙালী সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে দিলো নববিন্যাস।যা কিছু হিন্দুয়ানী, তাকে তারা অভিহিত করতে শুরু করলো বাঙালিত্ব বলে। বাঙালিত্বকে করে তুলতে চাইলো হিন্দুত্বের সমার্থক।
যার ফলে শরৎচন্দ্রের গল্পে দুই দলের ফুটবল খেলায় এক দল বাঙালী, আরেকদল মুসলমান। শরৎ বাবুর এ বিবরণ হিন্দু বুদ্ধিজীবিদের মানসিকতার প্রতিফলন মাত্র। তারা বাঙালিত্ব বলতে হিন্দুত্বকেই বাজারজাত করে চললেন। অতএব বাংলা নববর্ষকে হিন্দুয়ানী রুপ না দিলে তাদের চলছিলো না। আর্য অনার্যের হাজার বছর পুরণো লড়াই নতুন করে নববর্ষের উদযাপনে প্রতিফলিত হলো।ধীরে ধীরে পহেলা ৈবশাখকে পরানো হলো বিশেষ ধর্মআশ্রিত সংস্কৃতির পোশাক আর একে বলা হতে লাগলো চিরায়ত বাংলা সংস্কৃতি।
তিন-
তাদের এ প্রয়াস গণজীবনকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। তবে গড়ে তুলে এক তাত্তিক ডিকশন, যার প্রধান ভাষ্যকার ছিলেন বাবু বঙ্কিম চন্দ্র চট্রোপাধ্যায় ও বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ দুজনের বুদ্ধিজীবিতা বাংলাকে করে দুই টুকরা, ভারতকে করে তিন টুকরা। তারা জাতিয়তাবাদের মহাভারতীয় ভাষ্য ৈতরী করেন।যার দাবী হলো ভারতীয় মানেই হিন্দুত্ব। ভারতে বসবাসকারী সকলেই হিন্দু।সে মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যাই হোক।তার প্রথম ও প্রধান পরিচয় হচ্ছে সে একজন হিন্দু। এটাই হচ্ছে একজন ভারতীয়ের আসল সত্তা। একে গ্রহণ না করলে আপনি ভারতকে অস্বীকার করছেন।
এই চিন্তাধারা জন্ম দেয় শিবসেনা, বজরং দল, বিজেপি ইত্যাদিকে।তারা মুসলিম বিদ্বেষকে হাতিয়ার বানিয়ে ভারতময় লাভ করে প্রতিষ্ঠা। তাদের রাজনীতি স্বতন্ত্র এক মতবাদরুপে জীবন লাভ করে। যার প্রথম ও প্রধান ভাষ্য হলো ভারতের সব ধর্মের মানুষকে হিন্দু ধর্মের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে। তাদের এ মতবাদই হচ্ছে মনুবাদ।মনুবাদের চোখে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র দেশ হবার অধিকার রাখে না।সে মহাভারতেরই অংশবিষেশ। সুতরাং এখানেত সংস্কৃতি থাকলে থাকবে সেটাই, যা হিন্দুবাদের ধারক। ভারতে যেমন ভারতীয় জাতিয়তাবাদ মানেই হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ, তেমনি এ ভূখন্ডে বাঙালী জাতীয়তাবাদ মানেই হবে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ।
চার-
মনুবাদের প্রধান হাতিয়ার হলো সংস্কৃতি। সে যেখানে পা রাখতে চায়, আগে তার সংস্কৃতিকে পাঠিয়ে দেয়।সে যেহেতু আগ্রাসী, ফলে তার সংস্কৃতি আগ্রাসী অবয়ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়। সেটা কীভাবে?
স্থানীয় সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করো।অস্বীকার করো। অবজ্ঞা করো।মনুবাদের সংস্কৃতিকে বসাও তার জায়গায়।
মনুবাদের সংস্কৃতির ভিত্তি হলো হিন্দু ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস।যেমন পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক, সে লক্ষী দেবতার বাহন। ইঁদুর গণেশের বাহন,হনুমান রামের বাহন,হাঁস বিদ্যাদেবির বাহন,সিংহ দূর্গারবাহস, গাইগরু রামের সঙ্গী।
মনুবাদ এদেরকে পুঁজা দেয় এবং সবার কাছে চায় এদের পূঁজা। এই পূঁজার সাংস্কৃতিক রুপ হলো ঘরে ঘরে এদের ছবি, এদের মুখোশ গায়ে জড়ানো, এদের নিয়ে মিছিল- টিছিল ইত্যাদি।
মনুবাদ চায়, আপনি ধর্মে যাই হোন, আপনাকে এসব করতে হবে এবং এটাই আপনার সংস্কৃতি। এর বিপরিতে যা আছে, সেটা উচ্ছেদযোগ্য।
পাঁচ-
মুশকিল হলো মনুবাদ আপনার সামনে সরাসরি আসছে না এবং সম্মোহক বহু উপকরণ হাতে নিয়ে সে সক্রিয়।যায়নবাদ যা করে, সে তাই করছে।কিংবা অবলম্বন করছে সাম্রাজ্যবাদের খাসলতের সবচে বাজে দিকগুলো। সে টার্গেট এলাকায় ঘাটি গাড়ছে প্রধানত গণসংযোগের ক্ষেত্রসমূহে। মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছে এবং মিডিয়াসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে গড়ে নিচ্ছে লেনদেনের বিশেষ সম্পর্ক। তার কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে সিভিল সোসাইটির কণ্ঠে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি বিশেষভাবে তার দিকে হেলে পড়ায় তাদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে এতোটাই, যতটা মোদিও ভাবেনি।
সে যেহেতু ভারতের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অতএব বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতায় পরাশক্তিগুলো তার প্রতি প্রসন্ন। ইসলাম ফোবিয়া সেই প্রসন্নতাকে সহযোগিতার জায়গায় নিয়ে গেছে।ফলে সে পাচ্ছে বৈশ্বিক আনকূল্য।
অতএব মনুবাদের মিশনকে এগিয়ে নিতে বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগ অতিস্বভাবিক। কাজে কাজেই
দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়া ও কোম্পানি যখন মনুবাদের প্রতীক সমূহ নিয়ে প্রচারণায় মাতে, তখন মোহিত হয়ো না নওজোয়ান!
লেখক: গবেষক চিন্তক কবি সাহিত্যিক।