বাংলাদেশের জনসংখ্যার ধর্মভিত্তিক বিভাজন
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০% মুসলিম, ৯% হিন্দু ও অন্যান্য ১%। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ করে গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, খুলনা, নড়াইল, বাগেরহাট, হবিগঞ্জ (মাধবপুর ও চুনারুঘাট উপজেলায়) জেলায় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর বৌদ্ধ সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায়ই অনেকটা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। সংখ্যালঘুরা সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত।
মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী
মুসলমানদের মধ্যে হানাফি মাজহাবভুক্তরাই প্রধান। প্রায় ১০%-১২%-এর মতো আহলে হাদিসের অনুসারী আছে। বিশেষ করে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, সাতক্ষীরা ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের অবস্থান মজবুত। কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ করে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চল ও সাতক্ষীরা ইত্যাদি এলাকায় আহলে হাদিসদের সমর্থন নির্বাচনে অনেকটা প্রভাব বিস্তার করে। তবে এখন পর্যন্ত আহলে হাদিসরা কোনো দলকে গোষ্ঠীগতভাবে সমর্থন দেয়নি। যৎসামান্য শিয়া যারা আবার ইসনা আশারিয়া ও ইসমাইলিয়াভুক্ত তারা প্রধানত ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক।
আবার হানাফিদের মধ্যে তথাকথিত সুন্নি(?) ও ওহাবি(?) বিভক্তি আছে। আমাদের দেশে ওহাবি বলতে দেওবন্দি মতানুসারীদের বুঝানো হয়। আর রেজাখান বেরেলবির অনুসারীদের তথাকথিত সুন্নি বলা হয় যদিও পাকিস্তান ও ভারতে তারা বেরেলবি নামে পরিচিত। তবে কথিত সুন্নিদের মধ্যে মাজারপন্থীরাও আছেন। বস্তুত বাংলাদেশে সাধারণত কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক আলেম ও তাদের অনুসারীদেরকেই ওহাবি(?) বলা হয়। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলিয়া মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী ও মাজারকেন্দ্রিক গোষ্ঠী এবং কিছু কিছু পীর ও তাদের অনুসারীরা নিজদের ’সুন্নি’ বলে আখ্যায়িত করে থাকে। (যদিও আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে যৎসামান্য শিয়া বাদে সবাই সুন্নি)। আমাদের সমাজের সাধারণ জনগণের ওপর মাজারের একটি বিশেষ প্রভাব আছে। যারা মূলত ধার্মিক না হলেও ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন তারাই মাজার দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের সমাজে পীরমুরিদিরও একটা বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এসব পীরকেন্দ্রিক সিলসিলার মধ্যেও আছে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব। যেমন- ফুলতলী, চরমোনাই, শর্ষিনা, ফরফুরা, আটরশি, চন্দ্রপুরী, দেওয়ানবাগি, মাইজভাণ্ডারি ইত্যাদির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্ঘাত বিরাজমান। মাজারকেন্দ্রিক ও বংশানুক্রমিক পীরের অনুসারীরা সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক। ধর্মীয় রাজনীতিতে এসব ধর্মীয় গোষ্ঠীর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ভূমিকাই আছে। বিশেষ করে জামায়াত ও কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক দলগুলোকে তথাকথিত ওহাবিবিরোধী কট্টর গোষ্ঠী খুব কম ক্ষেত্রেই সমর্থন করে বা ভোট দিয়ে থাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে দুশমনি।
জামায়াতের সাথে রয়েছে কওমি আলেমদের তীব্র বিরোধ, অন্যান্য দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে বিরোধ ও বিভেদ। অর্থাৎ সেকুলার গোষ্ঠীগুলোর সাথে যেমন ইসলামি গোষ্ঠীগুলোর বিরোধ রয়েছে আবার নিজদের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ-বিভেদ। কাজেই ধর্মীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপস্থিতি একটি বিরাট সমস্যা। তা ছাড়াও সমাজে আছে তাবলিগের বিরাট প্রভাব। অবশ্য ভোটের ক্ষেত্রে তার প্রভাব গোষ্ঠীগতভাবে তেমন একটা বেশি নয়। তবে তাবলিগের লোকেরা সাধারণভাবে জামায়াতবিরোধী, আরো স্পষ্ট করে বললে তারা মাওলানা মওদূদীর ধর্মতত্ত্বের বিরোধী। যেহেতু তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস একজন দেওবন্দি আলেম ছিলেন, তাই ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে তাবলিগ দেওবন্দকেন্দ্রিক। তাই তাদের অনেকই কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল।
আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর প্রধান অংশ হচ্ছে সেকুলার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, আরেকটি অংশ হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত। এর আবার দুটো উপশ্রেণী রয়েছে : ক. কওমি মাদরাসা শিক্ষিত ও খ. আলিয়া শিক্ষিত। সেকুলার ও অর্ধ সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী দিয়ে পরিচালিত আর ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো আধুনিক ও মাদরাসা শিক্ষিত শ্রেণী দিয়ে পরিচালিত। তবে সাধারণভাবে আলিয়া মাদরাসার অনুসারীদের বিরাট অংশ জামায়াতের প্রভাব বলয়াধীন। আর বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম ইত্যাদি দলগুলো প্রধানত কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক। তবে খেলাফত মজলিসে আধুনিক শ্রেণী ও উভয় মাদরাসা শিক্ষিতরাই জড়িত আছে। অধুনা নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরীর দলটি মূলত আধুনিক শিক্ষিত তরুণ শ্রেণিকেন্দ্রিক।
রাজনৈতিকভাবে আলেম শ্রেণী সাধারণত আওয়ামী লীগ বিরোধী। স্বপ্লসংখ্যক আলেমই তাদেরকে সমর্থন করে। আবার তাদের সমর্থনও আদর্শিক কারণে নয় বরং বৈষয়িক কারণে। দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজন বেশির ভাগই বিএনপির সমর্থক বা ভোটার ও ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাব বিরোধী। বিএনপি মূলত আওয়ামী বিরোধী ভোটই পেয়ে থাকে। তাদের ইতিবাচক ভোট অনেকটা কম। তবে মাজারকেন্দ্রিক মাইজভাণ্ডারি গোষ্ঠীর লোকেরা সাধারণত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রায় সব ইসলামি দল ও বেশির ভাগ আলেম পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটি সঙ্ঘাত আছে বলে ধরে নেয়া হয়। বিশেষত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বিরোধী শক্তি মনে করা হয়। এ বিষয়টিও বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির পথে বিশেষ অন্তরায় রূপে কাজ করছে।
জনগণ ও ইসলাম
বাংলাদেশের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১০% মানুষ মোটামুটি আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় বিধান পালনে কমবেশি অভ্যস্ত। বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী বাস্তব জীবনে ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল নয়, যদিও তাদের মধ্যে গভীর ধর্মীয় চেতনা আছে। আর সামান্য কিছু অংশ ধর্মের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। এরা প্রধানত মার্কসবাদী বাম ও পশ্চিমা সেকুলার চিন্তায় প্রভাবিত। জনগণের মধ্যে নানা ধরনের কুসংস্কার বিরাজ করছে। ছোট একটা শ্রেণী অতি আধুনিক। সাধারণভাবে শিক্ষিত তরুণেরা পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত। জনগণের মধ্যে ইসলামের জন্য মমত্ববোধ আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে ইসলামের পরিচ্ছন্ন ধারণা নেই। তদুপরি আছে লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব। আর ইসলামি রাষ্ট্র, খেলাফত ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব শুধু সাধারণ জনগণের মধ্যেই নয়, অনেক ধার্মিক লোকের মধ্যেও রয়েছে। এমনকি এক শ্রেণীর আলেমের কাছেও ইসলামের রাজনৈতিক ধারণা স্পষ্ট নয়। জনগণ ধর্ম মানা বলতে বুঝেন দাড়ি রাখা, টুপি-লম্বা জামা পরা, নামাজ-রোজা পালন, দান-খয়রাত করা, মিলাদ পড়া; আশুরা, শবেবরাত, শবেকদর ইত্যাদি উদযাপন, পীরের মুরিদ হওয়া, মসজিদ-মাদরাসায় সাহায্য করা, ওয়াজ মাহফিল আয়োজন ও যোগদান করা, কবর জিয়ারত বিশেষত অলি আল্লাহ বলে পরিচিত ব্যক্তিদের কবরে যাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে মানত করা, নজর নিয়াজ দেয়া ইত্যাদি।
রাষ্ট্র সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে জনগণ সাধারণভাবেই অজ্ঞ। ধর্মীয় রাজনীতির ধর্মীয় প্রয়োজন আছে কি না, তা বেশির ভাগেরই জানা নেই। জানতে খুব একটা আগ্রহও নেই। তারা মূলত যতটুকু ইসলাম সমাজে প্রচলিত সে ইসলামের ওপর কেউ আঘাত করুক বা তা নষ্ট হয়ে যাক, তা সাধারণভাবে কেউ চায় না। অবশ্য ইসলামের ওপর সরাসরি আঘাত না আসা পর্যন্ত জনগণ সচরাচর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কেউ ধর্মের মৌলিক বিষয়ে আক্রমণ করলে দ্রুত ও মারমুখো প্রতিক্রিয়া দেখায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আলেম-ওলামার নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা
অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ৩০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে। ৫%-১০% লোক উচ্চবিত্তসম্পন্ন। কৃষক শ্রেণীর বেশির ভাগই ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষি। এখানে আছে কৃষিশ্রমিক বা ক্ষেতমজুর। আছে বিপুল কারখানা শ্রমিক। শ্রমিকদের মধ্যে গার্মেন্ট শিল্প একটি বড় ক্ষেত্র। সেখানে প্রায় ৩৫ লাখ নারীশ্রমিক রয়েছে। আমাদের মাথাপিছু আয় হচ্ছে ১৩০০ মার্কিন ডলারের মতো। জীবনধারণের মান নিচু। বিপুল যুবক বেকার। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতিতে শ্রমিকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রকট, এখানে দারিদ্র্য এক বিরাট সমস্যা, বেকারত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে, সুশাসনের মারাত্মক অভাব, আইনের শাসনের দুর্বলতা প্রকট। রাজনীতি এখন অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ এখনো মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নও কাক্সিক্ষত মানে হয়নি। বাংলাদেশে এখনো গণতন্ত্র অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো যথাযথ মানে গড়ে উঠতে পারেনি। সমাজে ধনবৈষম্য বেড়েই চলছে। সামাজিক বৈষম্যও প্রবল। সমাজে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে একটি শ্রেণীর দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ। সমাজে স্বাভাবিক সুবিচার নেই বললেই চলে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। তাই অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মসূচি নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব¡পূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জনগণ কেমন রাজনীতি চায়?
জনগণ চায় এমন রাজনীতি যা তাদের দৈনন্দিন সমস্যা- ভাত-কাপড়ের সমস্যা, দ্রব্যমূল্য, রুজি রোজগারের সমস্যা, বেকার সমস্যা আর রাস্তাঘাটের সমস্যা সমাধান করবে। শহুরে জীবনে মানুষেরা বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। শান্তি ও নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। সাথে সাথে তারা এমন রাজনীতি চায় যে রাজনীতি তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করবে, আলেম-ওলামার প্রতি নমনীয় থাকবে। রাষ্ট্রীয় সেবা পাওয়ার জন্য তারা ঘুষের অভিশাপ ও হয়রানি থেকে বাঁচতে চায়। তারা স্বল্প খরচে রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে আগ্রহী। দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা চালু থাকুক এটা সবাই চায়। কেউ জোর করে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করুক এটা সাধারণত কেউ চায় না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেশে বহাল থাকুক এটা সবাই চায়। এমন রাজনীতিই জনগণ চায় যে রাজনীতি জনগণের ভাগ্যের ও দেশের উন্নয়ন ঘটাবে। কোনো দল ভারতের তাঁবেদারি করুক তা চায় না। ভারতের প্রভুত্বসুলভ ও আধিপত্যবাদী আচরণও তাদের পছন্দীয় নয়। জনগণ চায় দেশের উন্নতি ও জনকল্যাণের রাজনীতি। তবে তা আমাদের ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু বিরাজমান রাজনীতি জনগণের এ চাহিদা পূরণ করছে না। তাই আজ প্রয়োজন নতুন ধারার রাজনীতি।
রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে ইসলামপন্থীদের সম্ভাবনা
জাতীয় জীবনে চলছে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা আর যারা ইসলামপন্থী তাদেরকেই এ শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে হবে। আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের জাতীয় রাজনীতির অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বিকল্প রাজনীতি। এ জন্য প্রয়োজন সময় উপযোগী বাস্তব ও বাস্তবায়নযোগ্য বক্তব্য ও কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির ময়দানে থাকা। প্রান্তিক রাজনীতি পরিহার করে গোটা জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো রাজনীতি করতে হবে। যেসব বিষয় আপাতত বাস্তবায়ন সম্ভব নয় সেসব বক্তব্য এড়িয়ে যেতে হবে অথবা বাদ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থায় রাজনীতিতে ভালো করতে হলে সাধারণ জনগণের সমর্থন তাদেরকে পেতে হবে। শুধু ধার্মিক ও ইসলামপন্থী লোকদের সমর্থন পেলে চলবে না। কাজেই সমাজের বিশেষ শ্রেণীর রাজনীতি পরিহার করে তাদেরকে সাধারণ জনগণের রাজনীতি করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি। আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের আজকের সময়ের দাবি পূরণ করার জন্য কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
রাজনীতির মূলধারায় কাজ করতে হলে সঙ্কীর্ণ ধর্মীয় বিতর্কে জড়ানো উচিত নয়। কারণ, এসব বিতর্ক রাজনৈতিক ময়দানে কর্মরত দলের জন্য খুবই নেতিবাচক। তাই তাদেরকে ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। তারা ইসলামের এমন সব বক্তবের ওপর জোর দেবেন যেসব বিষয় সম্পর্কে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীরই বিতর্ক নেই। অর্থাৎ তাদের রাজনীতি বিশেষ ধর্মীয় ফেরকা বা ধর্মীয় গোষ্ঠী নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। কিন্তু প্রচলিত ইসলামি দলগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই এসব বিতর্কেও ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। তদুপরি আছে ‘জঙ্গিবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বিতর্ক। নামের সাথে ইসলাম বা খেলাফত থাকলে ইসলামি বিরোধী শক্তি ও মিডিয়া অতি সহজেই ‘জঙ্গিবাদী’ ও ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা জুড়ে দিতে পারে। নামের সাথে ইসলাম শব্দ থাকলেই কোন ধারার ইসলাম বা কোন গোষ্ঠীর ইসলাম এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়ে যায়। এর ফলে শুরুতেই একটি বিশেষ গোষ্ঠীবদ্ধকরণের প্রচেষ্টা চলে। যে কারণে দলের সার্বজনীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়।
আজ জাতির চাহিদা এমন একটি রাজনৈতিক শক্তির যারা পুরনো ধারার গতানুগতিক রাজনীতির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে জাতির সামনে হাজির হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাÑ সাম্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করবে। যারা দেশে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান, অধিকার ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করবে। যারা বিভিন্ন ধর্মীয় ফেরকা গোষ্ঠী ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও জাতির মধ্যে ইনসাফ ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে। ইসলামের মৌলিক ভাবধারা ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধান এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের চেষ্টা করবে। আল কুরআনের নির্দেশনার আলোকে মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করবে। দলটি হবে সার্বজনীন। এটি ইসলামের সাধারণ এবং সার্বজনীন আদর্শ ও নীতিমালাকে ধারণ করবে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলাম অনুযায়ী গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হবে। একটি দীর্ঘমেয়াদি বহুমাত্রিক পরিকল্পনার আলোকে প্রাজ্ঞ কর্মসূচি গ্রহণ করে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলামের আলোকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেবে। এমনি একটি রাজনৈতিক শক্তি আমাদের দেশের জন্য আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তি এবং রাজনীতি সচেতন ও দেশপ্রেমিক শক্তিকে এ বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে।