এ প্রসঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের বালুরঘাট বসবাস করা ফেসবুক বন্ধু ব্যাংকার রঞ্জিত দে’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মনুবাদ ভারতেও আগ্রাসী সংস্কৃতি হিসেবেই বিবেচিত। অধিকাংশ ভারতীয় মনুবাদ পছন্দ করেন না। এই কারণেও হতে পারে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা মনুবাদের ধারক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি প্রকাশ থেকে বিরত থেকেছে।
বাংলা নববর্ষ বরণে পশ্চিম বাংলায় কি কি আয়োজন হয়, এমন প্রশ্নের উত্তরে রঞ্জিত দে বলেন, দুই একটা অনুষ্ঠান হয় ছোট পরিসরে। যা কমই চোখে পড়ে। মূলতঃ পশ্চিম বাংলায় বর্ষবরণ বলতে সারা বছরের বকেয়া আদায়ের অনুষ্ঠান বা হালখাতার আয়োজনকে বুঝায়। বর্ষবরণ নিয়ে ঢাকার মতো মাতামাতি কলকাতায় দেখা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা-সাক্ষাতে বা ফোন মেসেজে শুভেচ্ছা দিতে দেখা যায়। এতটুকুই।”
আগ্রাসী মনুবাদ সংস্কৃতির ধারক কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সবচেয়ে বড় সমর্থক আমাদের প্রথমআলো পত্রিকাও ‘কলকাতায় নানা আয়োজনে বর্ষবরণ’ শিরোনামে এক অনলাইন সংবাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের উপহাইকমিশন কর্তৃক আয়োজিত একটি ব্যানারের সামনে দুই জন শিশুর নাচের ছবি, পিঠা বিক্রির একটা স্টলের ছবি এবং কলকাতায় বর্ষবরণ শিরোনামে আরেকটা প্রতিবেদনে জনা বিশেক নারীর একটা ব্যানার নিয়ে রাস্তা প্রদক্ষিণের একই মানুষগুলোর সামনে পিছনের কয়েকটা ছবি ছাড়া কলকাতার মূলধারার বাঙালিদের বর্ষবরণের জনসমাগমের কোন ছবি পায়নি। প্রথম আলো পত্রিকার কলকাতার বর্ষবরণ নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদনটি পড়লে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন কর্তৃক ঘরোয়া পরিসরে বর্ষবরণের আয়োজন ছাড়া পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে এ নিয়ে অতিউৎসাহ ছিল না কোথাও।
[ দুই ]
অন্যদিকে আজকের বাংলাদেশী প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দিকে একবার তাকান। দেখবেন, বাঘ-ভল্লুক, হাতি-ঘোড়া, কুমির-কচ্ছপ, শকূন-পেঁচার ইয়া বড় বড় আবক্ষ মূর্তির পাশাপাশি দেব-দেবির বিশাল বিশাল মুখাবয়ব নিয়ে ঢাকার রাজপথে একশ্রেণীর মানুষের মঙ্গল কামনার শোভাযাত্রা, তিন স্তরের কঠোর নিরাপত্তায় রমনা বটমূলে কোরাস গাওয়া এবং বর্ষবরণে পান্তা-ইলিশসহ নানা পদের ভূরিভোজের সচিত্র রঙবেরঙের প্রতিবেদনই আজকের বাংলাদেশী মিডিয়ার প্রধান খবর। পত্রিকাগুলো টিভিগুলো কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ও রমনাবটমূলের কোরাস গাওয়ার নানা এঙ্গেল থেকে তোলা ছবি এমনভাবে প্রচার ও প্রকাশ করেছে যে, দেখলে মনে হবে আগ্রাসী মনুবাদ সংস্কৃতির ধারক মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন এদেশের সাংস্কৃতিক উৎসবের সার্বজনীন এক সমাজ চিত্র। উৎসবমুখর জীবজন্তুর আবক্ষ মূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা, নাচ-গান, পান্তা-ইলিশ ও একশ্রেণীর নারী-পুরুষের আনন্দ-উল্লাসের চিত্র ও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সংবাদ পরিবেশনা দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশের সর্বত্রই যেন মূর্তি সংস্কৃতির জয়জয়কার। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের খবর পরিবেশনা দেখলে মনে হবে, বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমান এখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে জীবজন্তুর কাছে মঙ্গল ও সুখশান্তি কামনা করছে (নাউজুবিল্লাহ), এমন একটা চিত্র ফুটিয়ে তুলতে আমাদের মিডিয়ার চেষ্টার যেন কমতি ছিল না। বাংলাদেশের মানুষের যেন সুখ-আনন্দের শেষ নেই। এর বাইরে অবিশ্বাস্য গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার বার বার প্রচারিত হওয়া একই রকম সংবাদ ও স্তুতিমূলক নিউজ অন্যান্য দিনের মতো আজকেও ছিল পত্রিকা জুড়ে। এর বাইরে জনস্বার্থ ও জনসমস্যা নিয়ে সচেতনামূলক প্রতিবেদন খুঁজে পেতে কষ্ট হয় বাংলাদেশের মিডিয়ায়। আমাদের মিডিয়ার চোখে বাংলাদেশ উন্নতি ও সুখ-সমৃদ্ধে পৃথিবীর এক নম্বর কোন দেশ। টেলিভিশন ও পত্রিকায় সংবাদ প্রতিবেদন ও রিপোর্ট উপস্থাপনার ধরণ দেখলে মনে হবে, ৮ ভাগ অমুসলিমের বিপরীতে এই দেশ যেন ৯২ ভাগ সংখ্যালঘুর দেশ!
[ তিন ]
ভারতীয় মিডিয়া তাদের দেশ, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস, নীতি-আদর্শ ও জনস্বার্থে সোচ্চার কথা বলে। কিন্তু আমাদের মিডিয়া!!! দেখবেন, প্রতিদিনই অবিশ্বাস্য গতিতে দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে চলার একই রকম নিউজ এবং মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ বিত্তশালীর উল্লাস নৃত্য ও ভোগবাদিতার খবরে ভরপুর। বাকী ৯০ ভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও বিত্তহীন কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টকর দিনগুজরানের বা সমস্যাগুলো তুলে ধরার কোনই চেষ্টা দেখা যায় না আমাদের মিডিয়ায়। মিডিয়াগুলো একবারও এই প্রশ্ন তুলতে রাজি হয় না যে, পশুপাখী ও দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কত ভাগ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কত ভাগের সাথে ঘোরতর সাংঘর্ষিক। মিডিয়াগুলো এটাও আলোচনায় তুলতে চায় না যে, পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি কবে থেকে শুরু এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে পান্তা-ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণের আর্থিক সক্ষমতা বাংলাদেশের কয়ভাগ মানুষের আছে।
[ চার ]
আমার যা উপলব্ধি, আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ ক্ষমতাশালী ও ধনী মানুষকে আরো বেশী ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী করার জন্যে একদিকে যেমন ৯০ ভাগ আমজনতার স্বার্থকে চরমভাবে উপক্ষে করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। তেমনি শোষণ ও ভোগবাদিতাকে বাধাহীন করার জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধে শুধু ঢালাও অপপ্রচারই করে যাচ্ছে না, বরং ৯২ ভাগ মানুষকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
আমজনতা দেশ ও জাতির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখনো সচেতন না হলে, এই দেশ ও জাতির অধোগতি রুখবার নয়!
মহান আল্লাহ এই জাতি ও দেশের সহায় হোন। আমীন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম