সিরাজী এম আর মোস্তাক ::
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় কর্তৃক ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৫ মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে প্রদত্ত বাণীতে উল্লেখিত একটি বাক্য থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের ঝড় সৃষ্টি হয়েছে। বাক্যটি হলো- “স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা, ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনকে, যাঁদের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।” চলতি মাসের (জানুয়ারি ২০১৬) ১১ এবং ১২ তারিখেও তিনি একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের কথা বারবার স্মরণ করেছেন। একথাগুলো তার মুখে মানায় কিনা, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তিনি সত্যিই যদি ত্রিশ লাখ শহীদদেরকে মানেন, তাহলে বাংলাদেশে মাত্র দুইলাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা প্রতিষ্ঠা করেছেন কিভাবে? দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনদেরকে বঞ্চিত করে মাত্র ৪১ জন নারীকে বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি দিয়েছেন কিভাবে? স্বয়ং তার বাবা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখেছেন কিভাবে? যে লাখ লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য সশস্ত্র যুদ্ধ করে দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল, সে সকল বীর সেনাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখেছেন কিভাবে?
অর্থাৎ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ১৯৭১ এর সাড়ে সাতকোটি বাঙালির অবদান, লাখ লাখ ভারতীয় বীর সেনার বীরত্ব ও লাখো শহীদদের আত্মত্যাগকে শুধু মুখে মুখে স্বীকার করেন আর বাস্তবায়ন করেন উল্টোটি। তিনি বাংলাদেশে প্রচলিত মাত্র দুইলাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ বীরাঙ্গনার তালিকাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে এই কি তার চুড়ান্ত নীতি? তিনি কি লাখো বাঙালি ও ভারতীয় বীর সেনা ও শহীদদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকার করেন না? তিনি কি বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির জনক হিসেবে মানেন না? তিনি কি মাত্র দুইলাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ বীরাঙ্গনা ছাড়া দেশের স্বাধীনতায় অন্য কারো কোনো ভূমিকাই স্বীকার করেন না? তিনি কি মনে করেন যে, লাখো শহীদ রাজাকারি করে মারা গেছেন? তা না হলে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখেছেন কেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় মাত্র দুইলাখ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার-পরিজনকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধার নামে এতো বেশি অতিরঞ্জন করেছেন, যা থেকে বের হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তিনি তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধাভুক্ত করেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা ব্যাপক করেছেন। ফলে ইতোমধ্যে মেডিকেলসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি এবং বিসিএসসহ সকল চাকুরীতে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নীতি পরিপালিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নীতি ছিল এরকম, ‘৭৫ এর পর এ যাবতকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালনে যতটুকু ভঙ্গ বা ঘাটতি হয়েছে, তা সম্পুর্ণ পুরণ করা।’
প্রচলিত মুক্তিযোদ্ধা কোটা নীতিতে স্পষ্ট হয়েছে যে, তালিকাভুক্ত দুইলাখ মুক্তিযোদ্ধার বিপরীতে ত্রিশলাখ শহীদদের সংখ্যাটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। কারণ, কোনো যুদ্ধে যোদ্ধার তুলনায় শহীদের সংখ্যা কখনো বেশি হয়না। যোদ্ধাদের একাংশ বা কিয়দাংশ মাত্র শহীদ হয়ে থাকে। বেশিরভাগই হয় আহত, বন্দী বা গাজী। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ঠিক তাই হয়েছিল। ত্রিশ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছিল, দুইলাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল, লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী হয়ে মানবেতর দিন কাটিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুসহ লাখ লাখ বাঙালি বন্দী ছিল এবং এদেশের কোটি কোটি বাঙালি স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছিল। লাখ লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করে দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল। বঙ্গবন্ধু এদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ত্রিশলাখ শহীদ ও দুইলাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনদেরকেও এক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় উক্ত শহীদদেরকে মুক্তিযোদ্ধা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করেছেন। তার দৃষ্টিতে, শহীদেরা মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারা এমনিতেই মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। তারা শুধু মুখে মুখেই স্মরণযোগ্য।
ত্রিশলাখ শহীদ প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের মূলভাষ্য এটাই। লাখো শহীদ বিষয়ে তিনি যত কথাই বলেন না কেন, তা তার মুখের ভাষা মাত্র। বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধা শুধু দু’লাখ এবং বীরাঙ্গনা মাত্র ৪১ জন।
অতএব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা নীতি বাতিল করে বাংলাদেশ-ভারত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনকারী সকল বীর শহীদ ও যোদ্ধা প্রত্যেককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করুন। বর্তমান ষোল কোটি নাগরিক সবাইকে উক্ত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করুন। তা না হলে, যতোদিন বাংলাদেশে প্রচলিত অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা থাকবে, ততোদিন প্রকৃত যোদ্ধা ও শহীদদের সংখ্যাটি বিতর্কিতই থাকবে। আর যতোদিন এ বিতর্ক থাকবে, ততোদিন মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আপনার সকল বাণীই অসত্য বা মিথ্যা প্রমাণ হবে।
লেখক : এ্যাডভোকেট, ঢাকা।