ইলিয়াস মশহুদ ::
আজ ৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। ঊনিশশ’ একাত্তর সালের এ দিনটি ছিলো বুধবার। এই দিনে একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে বিজয়ের চূড়ান্ত ক্ষণ নিকটবর্তী হচ্ছে। স্থানে স্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণে পরাভূত পাকবাহিনী। হানাদারদের আত্মসমর্পণের ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। মুক্ত স্বাধীন জনপদে পতপত করে উড়ছে নয়া বাংলা ভূমির লাল-সবুজের পতাকা। এদিন পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে একেবারে বিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার দিকে পালাবার কোন পথ তাদের সামনে খোলা ছিল না। একের সঙ্গে অন্যের যোগ দেয়ারও কোন উপায় ছিল না।
১৯৭১ সালের আজকের দিনে আকাশবাণী থেকে ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল মানেক’শ-এর একটি পত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পনের আহবান জানিয়ে বলা হয়, আত্মসমর্পন করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা জানি, আপনারা (পাক সেনাবাহিনী) পালাবার জন্য বরিশাল ও নারায়নগঞ্জের কয়েকটি এলাকায় জড়ো হচ্ছেন। কিন্তু আমি সমুদ্রপথে পালানোর সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। এ জন্য নৌবাহিনীকে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখনো যদি আপনারা আহবান না শোনেন এবং মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আপনাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’
মোটকথা, যুদ্ধে জয়লাভের সব আশা ইতোমধ্যে শেষ হয়ে পাকিদের। এ অবস্থায় ঢাকায় ভারতীয় জঙ্গি বিমানের হামলা তীব্রতর করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বিমান থেকে আত্মসমর্পণের আহবান সম্বলিত লিফলেট ছুঁড়া হয়। এ প্রেক্ষিতে ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন এদিন বার্তা সংস্থার সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান ধৈর্য ও পরিকল্পনা নিয়ে শত্রুর উপর চরম আঘাত হানবে। বেসামরিক প্রতিরক্ষা জোরদার করার লক্ষ্যে এদিনই ঢাকায় একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হয়। প্রতিরক্ষা তহবিলে উদারহস্তে দান করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আবেদন রেডিও-টিভিতে প্রচার করা হতে থাকে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, পাক-ভারত যুদ্ধে নিজেদের জড়িত না করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় এবং ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের মধ্যকার আলোচনায় মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন। পাকিস্তান সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলার জন্য নিউইয়র্ক রওনা হন। মার্কিন সিনেটর কেনেডি সব পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেন।
একাত্তরের এখনকার দিনগুলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য ছিল ভয়ঙ্কর। বিভিন্ন রণাঙ্গণে তাদের একের পর এক পরাজয় ঘটতে থাকে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তাদের চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে মুক্তিবাহিনীর একের পর এক বিজয়ের খবর আসতে থাকে। তখন পাক বাহিনীর পরাজয় বরণ করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না।
এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এদিন এক বেতার ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতী দিতে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান।
১৯৭১ সালের আজকের দিনে কুমিল্লা, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, গৌরিপুর, পিরোজপুর, ভালুকা, পটুয়াখালী, গাইবান্ধা, মীরসরাই, বাবুগঞ্জ, মির্জাগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।
তথ্য সহায়তা. উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।