শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ১০:৩১
Home / পরামর্শ / কমাশিসার ২১দফা ( ১০ নং দফা)

কমাশিসার ২১দফা ( ১০ নং দফা)

পূর্ব প্রকাশের পর :


পাড়ায় পাড়ায় নয়, জেলা পর্যায়ে মানসম্মত একটি টাইটেল মাদরাসা কায়েম করুন। যুগোপযুগি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা তথা প্রাইমারি-মক্তব গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠা করুন।

খতিব তাজুল ইসলাম ::

Al-Azhar-University
আল-আজহার মিশর

এ বিষয়টি নিয়ে এই পর্যন্ত যাদের সাথে কথা বললাম, সবাই একমত। তারা মনে করেন, বিষয়টা এভাবেই হওয়া উচিৎ নয়। অলি-গলিতে, পাড়া-মহল্লায় টাইটেল মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে টাইটেল নামক কওমী ধারার সর্বোচ্চ ডিগ্রীর মান যে কমানো হচ্ছে বা কমছে, এটা যেন আমাদের দেশের মুরব্বি-মুহতামিম সাহেবদের কাশফে কখনো ধরা পড়ে না। এভাবে যত্রতত্র টাইটেল মাদরাসা খোরলার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আগের মতো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
আসলে আমাদের উদ্দেশ্য কী? ভালো মানের আলিম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুবাল্লিগ তৈরি করা। এক দারুল উলূম দেওবন্দ পুরো উপমহাদেশ তথা সারা বিশ্বে তার খেদমত ছড়িয়ে দিতে পারলো। ১৮৬৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ বছরের সে তার সুনাম-সুখ্যাতি নিয়ে এখনো সেভাবেই দণ্ডায়মান, যেভাবে তার সূচনা হয়েছিলো। দারুল উলূম দেওবন্দের এটা একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠ। দেওবন্দ তার ইমতিয়াজি বৈশিষ্ঠ্য এজন্য ধরে রাখতে পেরেছে যে, তারা অলি-গলিতে নকল দারুল উলূম দেওবন্দ আর প্রতিষ্ঠা করেন নি। দারুল উলূম দেওবন্দকে তার মরকজি হাইছিয়াত অক্ষুন্ন রাখার পেছনে এক জাগায় কেন্দ্রিভূত থাকা খুব জরুরি ছিলো। আর তারা তা করতেও পেরেছেন।
হ্যাঁ, এই উপমহাদেশে আরো অনেক বড় বড় দারুল উলূম কায়েম হয়েছে। সময়ের তাকাযা এবং মানুষের চাহিদার উপর ভিত্তি করে এই পাক-বাংলায় অনেক উচ্চমানের টাইটেল মাদরাসা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামের মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী ও পটিয়া, ঢাকার লালবাগসহ এমন কিছু মাদরাসা, যা উদাহরণস্বরূপ বলা যায়। দারুল উলূম দেওবন্দ বা অন্যান্য বড় বড় মাদরাসা থেকে ফারিগ হয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ এলাকায় কুরআন ও হাদিসের খেদমত করতে গিয়ে এভাবে মাদরাসা গড়ে তুলেছেন।
মৌমাছিরা সেখানেই উড়াল দেয়, যেখানে থাকে ফুলের বাগান। ইলমে ওহীর জ্ঞানপিপাসুরা সেসব বুযূর্গদের সুহবতে থেকে বাহ্যিক জ্ঞানের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক জ্ঞানও আহরণ করতেন। সেই সহজ-সরল বুযূর্গদের মাথায় তখন একথা আসেনি যে, আমি যেখানে টাইটেল মাদরাসা করছি, তার আশপাশে অন্য কোনো মাদরাসা আছে কিনা, থাকলে কতটুকু দুরত্বে?
সাধারণত রাজধানী বা জেলা পর্যায়ের বড় কোনো শহরে একাধিক টাইটেল মাদরাসা থাকতে পারে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক- আমরাও তা কামনা করি। চাহিদানুযায়ী  প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক, এটা আমরাও চাই। তবে কথা হল, এসব প্রতিষ্ঠানকে হতে হবে মানসম্মত ও স্বয়ংসম্পুর্ণ।
যেমন-সিলেট শহরের কথাই ধরা যাক। পাঁচ মাইল স্কয়ারের ভিতর এক ডজনের মতো টাইটেল মাদরাসা। একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব আধা মাইল কোথাও বা সিকি মাইল। রাজধানী ঢাকাসহ সিলেটের এমন কিছু এলাকা আছে, যেগুলো মাদরাসা পাড়া নামে খ্যাত। সিলেটের বৃহত্তর মেজরটিলা-টিলাড়গ এলাকায় অন্তত ৩৫টি কওমী মাদরাসা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আবার ৬-৭টি মাদরাসা টাইটেল পর্যন্ত। এসব মাদরাসার টাইটেল ক্লাসের ছাত্র সংখ্যা সাকুল্যে ১০-২০-৩০-৫০-৭০-৮০ অথবা সর্বোচ্চচ ১০০ জন। পুরো শহরব্যাপী এই দশটি টাইটেল মাদরাসা মিলে একত্রে মোট তিনশ’ জন ছাত্র হবে না। মাত্র ৩০০ ছাত্রের জন্য আলাদা আলাদা ১০টি টাইটেল মাদরাসা থাকতে হবে- এ কেমন কথা? এই দশটির পরিবর্তে একটি বা দু;টি হলে কী হত? এতে কিসের ডিমান্ড? কিসের বাহাদূরী? কিসের বড়াই?
গ্রামের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ভয়াবহ না বলে চটকদারও বলা যায়। যেমন- একদিকে জামেয়া গহরপুর ঠিক তার বিপরীতে কিছু দূরে রেঙ্গা মাদরাসা। ৪ মাইল দূরে আছে দয়ামীর মাদরাসা।অনতি দূরে সুলতানপুর পুরুষ ও মহিলা টাইটেল মাদরাসা। সামান্য দূরে তাজপুর মাদরাসা। তাজপুর থেকে দু’কদম দূরে উমরপুর বাজার টাইটেল মাদরাসা। তারপরে আছে শেরপুর এবং পর্শ্ববর্তী গলমুকাপন টাইটেল মাদরাসা। এর মাঝে সদ্য গজে ওঠা আরো অনেক মাদরাসা আছে, নতুনভাবে গজিয়েছে/গজাচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে? এমন অনেক মাদরাসা আছে, যেগুলোর নামই হয়তো আমরা জানি না। গভীরভাবে লক্ষ্য চিন্তা করে দেখুন, মাত্র একটি থানায় দেড়ডজনের মত টাইটেল মাদরাসা? এই দেড় ডজন মাদরাসার টাইটেল ক্লাসে ছাত্র হবে বেশির চেয়ে বেশি ৫০ জন। বিশেষত : সিলেট জেলার সবগুলোর টাইটেল ক্লাসের ছাত্র একত্র করলে এর সংখ্যা পাঁচশ’র উপরে যাবে না। এ তো গেল টাইটেল মাদরাসার হিসাব। ছানোভিয়্যাহ থেকে নিয়ে ফযিলত পর্যন্ত যে কত অসংখ্য মাদরাসা এই বাংলার জমিনে পড়ে আছে, সেসব তো উল্লেখই করা হল না।

এক মাদরাসার ইন্তেজামিয়া কমিটির সাথে অন্য মাদরাসার ইন্তেজামিয়া কমিটি বা একই প্রতিষ্ঠানের একবিভাগের দায়িত্বশীলদের সাথে অন্য বিভাগের দায়িত্বশীলদের পরামর্শমূলক কোনো সম্পর্ক নেই। আছে শুধু চা-পান, ওয়াজ, খতমে নারী আর খতমে খাজেগানের দাওয়াত। আক্ষেপের বিষয়, অত্র এলাকায় যতটি টাইটেল মাদরাসা আছে, সেই তুলনায় তার সিকিভাগ ইবতেদায়ী মক্তব নেই। প্রাইমারী ও উচ্চমাধ্যমিক মাদরাসা পরিচালনা করা যেন আইবের বিষয়। কারণ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্মান কামাতে হবে। প্রিন্সিপাল লক্বব লাগাতে হবে। টাইটেল ক্লাস খোলা হলে এর গন্ধে ভালো চাঁদা আসবে। দিন বদল হবে। জ্ঞানের বদল নয় পেটের আকার বৃদ্ধি পাবে। ছাত্রদের তারাক্কী নয়; মুহতামিমদের রাতারাতি সার্বিক তারাক্কী হবে।
এমনও অবস্থা যে, যখন ছাত্র হবে তখন ক্লাস বাড়বে। ছাত্র নেই ক্লাসও নেই। জালালাইন, মিশকাত, দাওরা আছে কিন্তু মধ্যখানে কাফিয়া-শরহে জামী নেই। কোথাও বা ছাত্রের অভাবে মুশতারাকা নামে দুই জামাতকে একীভূত করা হয়ে থাকে। দ্বীনি ইলম নিয়ে এরচেয়ে নিকৃষ্ট তামাশা আর কি হতে পারে!
আমি একটি প্রাইমারি মক্তব পরিচালনা করি। কর্তৃপক্ষ এবং এলাকার কওমী আলিমগণ মক্তবটির ক্লাস তারাক্কী না হওয়ায় যেন খুব চিন্তিত। সদা ফিকিরে মশগুল- কেনো যে আগ বাড়ছে না। বছরে বছরে নতুন নতুন ক্লাস খোলা হচ্ছে না। আমি তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছি, অন্তত আমি জীবিত থাকতে বা পরিচালনার দায়িত্বে থাকাবস্থায় এই কাজ ইশাআল্লাহ কখনো হবে না। আশে পাশে কত সিনিয়র মাদারাসা আছে, টাইটেল তো আছেই, পার্শ্বকর্তী সেসব মাদরাসায় যেখানে চলছে ছাত্রের অকাল, সেখানে আমরা কোনো নতুন ক্লাস খোলে ছাত্রের অভাবে হু হু করব? যার জরুরত সেখানে যাক। আমার সামর্থ্য আছে বলেই থর থর করে উপরের দিকে প্রতিষ্ঠানকে উঠতে হবে, এমন কোনো কথা নেই।
প্রাইমারী প্রাইমারীই থাকবে। উচ্চমাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক হিশেবেই থাকবে। প্রতিষ্ঠান হবে তার সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থের উপর। এলাকা, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও চাহিদার উপর। এলোমেলো পরিস্থির কারণেই তো  আজ আমাদের এই দুরাবস্থা। সুতরাং এসব সমস্যা সমাধানে করণীয় হল-
প্রথমত : আমাদের মাঝে ঐক্যমত সৃষ্টি করতে হবে। একত্রে বসে পরামর্শ করার মানসিকতা থাকতে হবে। দ্বীতিয়ত : একই বোর্ডের আওতায় দেশের সব কওমী মাদরাসাকে আশ্রয় নিতে হবে। তৃতীয়ত : কার্যকরি সিলেবাস ফলো করতে হবে। কোন প্রতিষ্টান কোন বিষয়ে সাফার করছে বা কষ্টে আছে, তার কাছে না গেলে জানবো কি করে! ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করলে কাজে গতি ও বাস্তবতা ফুটে উঠবে না। তাই চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে ঐক্যের সাথে কাজ করতে হবে। ঐক্যের পাহাড় গড়ে তুলতে হবে।
যখন একই টেবিলে সবাই আসবেন, বসবেন, তখন কোন মাদরাসা কি পর্যন্ত থাকবে বা কিভাবে সমন্বয় সাধন হবে; তার একটা ফর্মুলা বের করা যাবে। প্রতিটি এলাকায় কিভাবে এফেক্টিভ মক্তব বা প্রাইমারি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হয় এবং যেটি কমজুর আছে, তাকে কিভাবে সচল করা যায়- সবকিছু সমাধান করা সম্ভব হবে যদি আমরা একমনে নেক নিয়তে এক টেবিলে বসতে পারি।
তাহলে যারা এই পর্যন্ত খুলেছেন, তারা কি বন্ধ করে দিবেন? না, আমরা তা বলবো না; বরং যারা কষ্টে আছেন। কখনো চালু কখনো বন্ধ, তারা এবং যারা ৫-১০ জন ছাত্র নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে টাইটেল চালা”েছন, তাদের দরবারে আমাদের আবেদন, আপনারা টাইটেলের খাহেশ বিসর্জন দিন। বড় বড় মাদরাসার ছায়ায় আপনার ফসলগুলো তুলে দিন।
যদি এমন হত যে, টাইটেলের জন্য আলাদা করা ৪টি বছর ছাত্ররা জামেয়া নামক ইসলামি ভার্সিটিতে এক সাথে পড়তো। অর্থাৎ ছানোভিয়্যাহ, ফযিলত ও টাইটেল ক্লাসের মাদরাসাগুলোকে কেবল জামেয়ার স্বীকৃতি দেয়া হত, তখন নওজোয়ান ছাত্রদের পদভারে প্রতিটি ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে উঠতো। বিশেষ করে রাজধানী ও অন্যান্য বড় বড় শহরের মাদরাসাগুলোকে জামেয়ার স্বীকৃতি দেয়া হত তখন। অন্যান্য সাধারণ ভার্সিটির মতো যেখানে কেবল উপরের ক্লাসগুলো সম্পাদন হবে। মক্তব, প্রাইমারী ও মাধ্যমিক মাদরাসাগুলো সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকবে।
এভাবে বিভাগভিত্তিক আলাদা আলাদা ক্যাম্পাস হলে লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি পেত। উলামাদের মাঝে মতানৈক্য কমে আসতো। তৃণমূল পর্যায়ে দ্বীনি শিক্ষা পৌঁছানোর মহান কর্মটি ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হত।
বর্তমানে সামাজিকভাবে মাদরাসা এবং স্কুলের মাঝে বিভেদের যে দেয়াল সৃষ্টি হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে- এটা নিশ্চিৎ বলা যায়। এখন যেমন দাড়ি, টুপি, হিজাব নিয়ে সমস্যা হ”েছ। ইসলামি কারো হাতে দেখলেই জিহাদী-জঙ্গী বই বলে ধার্মিক ছেলে-মেয়েদের হয়রানি করা হ”েছ, তা আরো প্রকট রূপ ধারণ করবে। যদি না এসবের বিহিত ব্যব¯’া গ্রহণ করা হয়। বিহিত ব্যব¯’া বলতে মক্তব ও মাধ্যমিক মাদরাসাগুলোকে সাধারণ শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষা ও পরীক্ষায় অংগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : খতিব ও গবেষক।

আরও পড়ুন : কমাশিসার ৯ম দফা

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...