ইলিয়াস মশহুদ ::
লাখো শহীদের রক্তেরঞ্জিত দিন-মাস পেরিয়ে আজ ৩ ডিসেম্বর ২০১৫। ২৬ মার্চ শুরু হওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়ে শহীদ হয়েছেন লাখ লাখ বীর বাঙালি। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এদেশের মাটি। রঞ্জিত হয়েছে গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর, অলিগলি থেকে রাজপথ। এই আমাদের মহান বিজয়ের মাস। ৭১’র এ দিনে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে পঞ্চগড়- সর্বত্র ছিল বাংলার অকুতোভয় দামাল ছেলেদের চোখে-মুখে বিজয়ের আনন্দ। তাদের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধকে ক্রমেই চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের সর্বত্রই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা পিছু হটতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় উপকূলীয় জেলা বরগুনা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের এ জেলায় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে বরগুনাকে মুক্ত করেন বাংলার দামাল ছেলেরা।
একাত্তরের এ দিনে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় মুক্তিপাগল বীর বাঙালীরা। গেরিলা আক্রমণে ঘুম হারাম অবস্থা পাক হানাদার বাহিনীর। একাত্তরের এই দিনে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। রণাঙ্গনে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভিন্নমাত্রা পায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় যৌথ কমান্ডের সম্মুখযুদ্ধ। ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সম্মুুখ সমরে হানাদার বাহিনীকে একে একে পরাস্ত করে বাংলার দামাল ছেলেরা বিজয় কেতন ওড়াতে ওড়াতে এগুতে থাকে ঢাকার দিকে।
বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত করার মতো শেষ অস্ত্র বেছে নেয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের জের ধরে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্যের সঙ্গে ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধারা মুখোমুখি হয়। মনোবল চাঙ্গা হয়ে ওঠে বাংলার মুক্তিপাগল দামাল ছেলেদের। সময় ঘনিয়ে আসতে শুরু করে এই মাটি আর বাংলার স্বাধীনতার শত্রুদের। বাঙালীর জীবন-মরণ লড়াইয়ে ভারতের সহযোগিতার ধারা বাড়তে থাকে।
ডিসেম্বরের প্রথম দু’দিনেই এক কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বীকৃতি পায় কিছু পরে। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর থেকেই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এসে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে। ফোর্ট ইউলিয়াম থেকে সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী চারদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। নবম ডিভিশন এগোতে থাকে গরিবপুর, জগন্নাথপুর হয়ে যশোর-ঢাকা হাইওয়ের দিকে।
এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারতের আগরতলা, অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর, উত্তরলাই, যোধপুর, আম্বালা ও আগ্রা বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। বিকেলে কলকাতা প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল এক জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাষণদানকালে এ খবর পান। দিল্লি ফিরে তিনি রাতেই আকাশবাণী দিল্লি বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে’।
ভাষণের আগেই রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ভরতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী মিত্রবাহিনী নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে।
ভারতীয় বিমানবাহিনী গভীর রাতেই বাংলাদেশের সব মুক্ত এলাকায় পৌঁছে যায়। সব রুট দিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর অবিরাম বিমান হামলা চালিয়ে বাংলাদেশের সব বিমান ঘাঁটি অচল করে দেয়। কুর্মিটোলা এয়ারপোর্টে ৫০ টন বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানের এক ডজনের ওপর বিমান বিধ্বস্ত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হওয়া ভারতীয় বিমান হামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়।
তাছাড়া চোরাগোপ্তা আক্রমণ থেকে সরে এসে ভারতীয় যৌথবাহিনীর সাথে একসারিতে সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যায় বীর বাঙালিরা। মনোবল বাড়তে থাকে বাংলার দামাল ছেলেদের। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী আকস্মিকভাবে স্থল ও আকাশপথে ভারতের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালায়। মধ্যরাতে ভারতও সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এ দিন গঠন করা হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড।
একাত্তরের এই দিনে ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিতভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধারা মুখোমুখি হয়।
এদিন কুমিল্লায় মেজর আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে মিয়াবাজার দখল করে নেয়। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সিলেটের ভানুগাছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লৎফুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সফল হামলায় নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে দুটি ফুয়েল পাম্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এদিন। রাত ৯টার দিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর দু’জন চৌকস অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম (স্বাধীনতার পর দু’জনই সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) দু’জন গানারসহ বিমান নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগারে একের পর এক রকেট নিক্ষেপ করে তা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে দেন।
এছাড়া ঘন কুয়াশার মধ্যে উড্ডয়ন বিপজ্জনক হলেও দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর স্কোয়ার্ডন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম (স্বাধীনতার পর এ দু’জনও সাহসিকতার জন্য বীরউত্তম খেতাব পান) আরেকটি যুদ্ধ বিমান নিয়ে চট্টগ্রামের জ্বালানি সংরক্ষণাগার উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দেন। এই দুই স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলে মনোবলে চিড় ধরে উর্দু ভাষী দখলদারদের। নিশ্চিত পরাজয়ের দিকে ধাবিত হয় পাকহানাদার বাহিনী।
তথ্যসূত্র. উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন দৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।