শনিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:৫২
Home / নারী-পুরুষ / যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (পর্ব-৬)

যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (পর্ব-৬)

হিজড়া ও আমাদের সামাজিক দায়

হিজড়াখতিব তাজুল ইসলাম ::

মাস তিনেক আগে লম্বা একটি রিপোর্ট পড়লাম এক অনলাইন দৈনিকে। ঢাকার অদূরে এক ক্লিনিক আছে, যেখানে পুরুষদের ধরে এনে হিজড়া বানানো হয়। হিজড়া আসলে কারা? এরা পুরুষও না, আবার নারীও না; পুরুষ-নারীর মাঝামাঝি তাদের অবস্থান। হরমোনজনিত কারণে শরীরের গঠন প্রকৃতি বিভিন্নজনের বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। যেমন- কাউকে দেখতে পুরুষের মতো অথচ ভিতরে ভিতরে সে নারী। পরিণত বয়সে অনেকে কিন্তু ঠিকই পূর্ণাঙ্গ নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সামান্য চিকিৎসার বদৌলতে আবার বিপরীতও আছে। যেমন দেখতে নারী নারী ভাব কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে পুরুষ। এমনও দেখা গেছে, আটারো বিশ বছর নারী পরিচয়ে চলার পর হঠাৎ করে পুরুষ হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আবার কেউ কেউ সেই অবস্থায়ই থেকে যায়, যেমন তার শুরু হয়েছিলো।

এবার আসি মূল কথায়, এই হিজড়াদের কি কোন জায়গা নেই সমাজে? বর্তমান ঢাকা চট্টগ্রামসিহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিজড়া একটি সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কার জন্ম কিভাবে হবে- সেই ক্ষমতা তো আল্লাহপাক কাউকে দেন নি। তাহলে তারা কি উপেক্ষিতই থাকবে? না, ইসলামে তো এমন কোন বিধান নেই।

সুদূর ফুরাতের তীরে একটি কুকুর অনাহারে মারা গেলে খলিফাতুল মুসলিমীন যদি আল্লাহর কাছে জবাবদিহীতার ভয়ে কম্পমান থাকেন, সেখানে আশরাফুল মাখলুকাতের মাঝ থেকে জন্মগত দুর্বল যারা, সামাজিক দায়বদ্ধতার খাতিরে তাদের প্রতি কেনো দৃষ্টি দেয়া হবে না? তারা কেনো সাপোর্ট-সহযোগিতা পাবে না? সহযোগিতা পাওয়ার কি কোনো অধিকার তাদের নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা তাদের উপেক্ষাই করছি কেবল। সমাজের বোঝা মনে করে আঁড়চোখে তাকাচ্ছি। আমাদের এই অবস্থান, এমন মনোভাব, এহেন হেয়ালিপনা- যার পরিণতিতে তারা এখন সমাজে ভয়ংকর ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সমাজের বোঝা হিশেবেই তারা পরিব্যাপ্ত হচ্ছে।

সমাজ, রাষ্ট্রের অবহেলায় গড়ে উঠেছে হিজড়া সিন্ডিকেট। বিস্তৃত হচ্ছে বিকৃত যৌনাচারের প্রাদুর্ভাব। রাস্তাঘাটে তারা দলবেঁধে চলে। চাঁদাবাজি করে।  হাত পাতলে আপনি তাদের কিছু না কিছু দিতেই হবে নতুবা নাজেহাল অবস্থা। গান-বাজনাসহ সকল প্রকার অসামাজিক কার্যকলাপে তাদের ব্যবহার করা হয়।

এখন বিষয়টা কেবল তাদের মাঝে নয়, ভালো মানুষকেও ফুসলিয়ে ধরে এনে লিঙ্গ কেটে হিজড়া বানানো হচ্ছে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকায়। ঐযে ক্লিনিক আছে ঢাকার অদূরে। প্রতিদিন কাউকে না কাউকে তারা ধরে এনে লিঙ্গ কাটাচ্ছে। ডাক্তার নামক এই কসাইদের কোন ধর্ম নেই। এরা ধর্মহীন। গরিব, অসহায়ের রক্ত চোষে খেতে এরা বড়ই স্বাদ পায়। টাকাই তাদের কাছে সব। টাকাই তাদের ধর্ম।

সেই রিপোর্টে কিছু হৃদয়বিধারক করুণ কাহিনী পড়েছি। কিভাবে মানুষকে ধরে এনে স্বার্থবাদীরা অঙ্গহানী ঘটিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা অপরাধে লিপ্ত করে। কই এসব ক্রিমিনালদের বিচার হতে তো দেখি না; বরং পুলিশের আশ্রয়ে চলে এসব অমানবিক কাজসমূহ।

ঢাকায় নাকি লাখের উপরে হিজড়া আছে। তারা তাদের গডফাদারের কথায় উঠবস করে। এদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল এক সিন্ডিকেট। চোর-ডাকাতের সিন্ডিকেটের মতো। এই হিজড়াদের অর্জিত আয়ের সিংহভাগই যায় সর্দার বা গডফাদারের পেটে আর মাঠের কর্মীরা পায় সামান্য একটা অংশ। এদের মাধ্যমে সামাজিক বিপর্যয় ছাড়াও ছড়াচ্ছে মরণব্যাধি এইডসসহ মারাত্মক রোগব্যাধি। দূষিত হচ্ছে সমাজ ও পরিবেশ।

ইসলামি শিক্ষা, ওয়াজ-নসিহত, রাজনীতি-সমাজনীতির কোথাও তাদের উল্লেখ নেই। তারা মুসলমান থাকবে, না হিন্দু হবে, না স্যেকুলার হবে- এর কোনো উত্তর নেই। কোথাও কোনো ব্যাখ্যা নেই। আছে কেবল খুনসা মুশকিলের কথা। খুনসা মুশকিলের মাসআলা ঠিকই পড়ানো হয়; কিন্তু এই জাতি বা শ্রেণির মানুষগুলোর সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করে তাদের পাশে এসে কেউ দাঁড়ায় না। এই হিজড়াদের ব্যাপারে আমাদের কি কোনো কর্তব্য নেই? কোনো দায় নেই? তারা এখন কুফরের শিকার। ইসলামি সমাজ এবং মুসলমানী রীতিনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে হিজড়া নামক আজব এক জাতির উদ্ভব ঘটেছে। সেকালের খুনসায়ে মুশকিলরাই আজ সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। এদের যদি এখনই আমরা লাগাম টেনে না ধরি, ইসলামের ছায়াতলে আশ্রিত না করি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এর ভোগান্তি আমাদের পোহাতে হবে খুব বীভৎস রূপে, করুণভাবে। তখন অনেক চড়া মূল্য হয়তো আমাদের দেওয়া লাগতে পারে। তাই ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকদের মতো তাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু আদায় করে দিতে যেন আমরা সচেষ্ট হই। হিজড়া সমস্যা হয়তো কেউ ব্যক্তিগতভাবে সমাধান করতে পারবেন না। কিন্তু ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যদি নেয়া হয়, তাহলে একটা উপায় বের হবে। আশু সমস্যার সমাধান হবে।

হিজড়াদের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছিয়ে দেয়া আমাদের ঈমানী তাকাযা। আজকাল শত শত চ্যারিটি আছে, যারা মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে। এই উন্নয়ন কর্মসূচিতে আমরা তাদেরকেও জড়াতে পারি। তাদের জন্য কর্মসংস্থানের পথ বের করে দিতে পারি। দাওয়াতি কাজের সাথে আর্থিক সহযোগিতা পাশে থাকলে তারা প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগবে না। তাদের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আমরা যেন সরকারকে চাপে ফেলতে পারি, যাতে হিজড়াদের পুণর্বাসন ত্বরান্বিত হয়।

4545শরীরের কোথাও যদি পচঁন ধরে আর তার সুচিকিৎসা  না করা হয়, তাহলে ক্রমান্বয়ে তা পুরো শরীরকে গ্রাস করে ফেলে। ঠিক তেমনি হিজড়া সমস্যা বর্তমান সমাজের জন্য পচঁন বা ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই হিজড়াদের দুনিয়া-আখেরাত উভয়টাই তাদের বরবাদ হচ্ছে। তাদের মাঝে কি এমন কেউ নেই, এমন কোনো মেধাওয়ালা নেই, যারা সমাজে আলো ছড়াতে পারবে না? আলেম-আলেমা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ডাক্তার-ইজঞ্জনিয়ার হতে পারবে না? ড্রাইভার- রিকশা চালক কিংবা কারিগর কিছুই হওয়ার ক্ষমতা রাখে না? নিজেরা বদলিয়ে সমাজকে বদলে দিতে পরার যোগ্যতা রাখে না? অবশ্যই রাখে, যদি আমরা তাদের সঠিক গাইড দেই। তাদেরকে সমাজের বোঝা মনে না করে বরং সমাজের অংশ মনে করি। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। তাদের বদলে দেই। আমরাও বদলে যাই।

শেষকথা, হিজড়াদের দূরে ঠেলে দিয়ে আমরা আর সামাজিক এই ক্ষতকে যেন আর না বাড়াই; বরং শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবনকে পাল্টিয়ে দেই। আবাধ যৌনাচারের হাতিয়ার হিশেবে যারা তাদেরকে ব্যবহার করছে, তাদের হাত থেকে এই সম্প্রদায়কে রক্ষা করে দেশ, সমাজ ও জাতিকে এই কলংকজনক অধ্যায় থেকে রেহাই দিতে আমরা যেনো সচেষ্ট হই।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন

যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয়: পর্ব ৫

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...