(প্রথম পর্ব) বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা। বিশেষত হেফাজতের লং মার্চ ও ১৩ দফা আন্দোলনের পর কাওমি মাদ্রাসা জোরেশোরে আলোচনায় আসে।
সাধারণত কাওমি মাদ্রাসাকে প্রশ্ন করার জায়গা হচ্ছে দুটো। এক. অনাধুনিক শিক্ষা ব্যবস্তা; দুই. উপমহাদেশে জঙ্গিবাদ প্রচারের কথিত অভিযোগ। অভিযোগ দুটির প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পেছনের শক্তি ও শ্রেণির চরিত্র আমরা ইতোমধ্যে শনাক্ত করতে পেরেছি। ২৫ এপ্রিল,২০১৩ নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ফরহাদ মজহারের লেখাটি পড়ে নিজের দায় বা দায়িত্ববোধ থেকে অব্যক্ত কিছু কথা না বলে পারছি না। ফরহাদ মজহার আমার একজন প্রিয় লেখক। অন্যসব লেখার মত এই লেখাতেও আপোষহীনভাবে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। দায়িত্ববোধটা বেশি এজন্য, যারা কাওমি মাদ্রাসায় পড়ে সত্য ও সুন্দরের সবটুকু সুবাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে আমি তাদের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নিজকে সত্যি ভাগ্যবান ভাবতে শুরু করি, কারণ আমার অন্য ভাইদের মত ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যালে পড়ে শেষ করি নি; বরং কুরআন-হাদিস, আকাইদ-ফিকহের স্বর্গীয় সুরভি নিয়ে বড় হচ্ছি। বিনীত অহংকারের সাথে বলছি, আমি কওমি মাদ্রাসায় পড়ে জঙ্গি হই নি, ধর্মান্দ্ব হই নি। তালেবান হই নি। ‘মধ্যযুগীয়’ হই নি। প্রতিনিয়ত ভাবছি। চিন্তার চর্চা করছি। একজন গণতান্ত্রিক সহনশীল মানুষ হয়েছি।
হেফাজত আন্দোলনের অভাবনীয় ও ঈর্ষনীয় শক্তির উৎস জানতে কাওমি মাদ্রাসার গোঁড়ার ইতিহাস জানা জুররি। উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব কায়েমের পর লর্ড ম্যেকলে প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্তা চালু হয়। শাসক শ্রেণী চিন্তা করলেন মোসলমানদের ধর্মীয় চেতনার চর্চা করতে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রয়োজন। এর ফলে শুরু হয় কলকতা আলেয়া মাদ্রাসার যাত্রা। ‘ব্রিটিশ খেদাও’ যুদ্ধে ইংরেজদের জয় হলেও কাওমি আলেমরা সেই পরাজয় মেনে নেননি। ব্রিটিশ বিরোধী জঙ্গি চেতনা রাখতে ‘দারুল ঊলূম দেওবন্দ’ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহর ‘খেলাফত আন্দোলন’, শাহীদ তিতুমীর ‘বাঁশের কেল্লা’র মত ‘দারুল ঊলূম দেওবন্দ’মাদ্রাসা ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার প্রতীক হয়ে দাড়ায়। প্রায় দুই লাখেরও বেশী কাওমি আলেম ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধে শাহাদাত বরন করেন। উল্লেখ্য উপমহাদেশে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক আবদুল ওয়াহাব আন নাজদির মতানুসারী মাওলানা আবুল কাশেম নানুতুবীর প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল ঊলূম দেওবন্দ’ মাদ্রাসা পন্থী আলেমদের ওয়াহাবী নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওয়াহাবী বা কওমি আলেমদের সম্পৃক্ততা শুরু হয় হাফেজ্জী হুজুরের প্রার্থিতার মধ্য দিয়ে। যে নির্বাচনে খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী হাফেজ্জী হুজুর জাসদ প্রার্থী মেজর এম এ জলীলের চেয়ে তিনগুণ বেশী ভোট পেয়েছিলেন। পরে তাওবা করে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের অনুসারী হন। সে অন্য প্রসঙ্গ।
ভারত উপমহাদেশের অসম্প্রাদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আবদুল হামীদ খান ভাসানি,মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সহ অনেকেই কাওমি মাদ্রাসা ছাত্র ছিলেন। মাওলানা আজাদ সোবহানি যিনি স্বায়ত্তশাসনের বদলে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে মহাত্মা গান্ধীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে ছিলেন- তিনিও কাওমি আলেম ছিলেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আলোকপ্রাপ্ত’ মুসলমানরা ইংরেজ তোষণ নীতি মেনে নিলেও দেওবন্দের কাওমি আলেমরা সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
শিক্ষা ও জীবিকার প্রশ্নে
আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত বুর্জোয়া-পাতি বুর্জোয়া প্রগতিশীলরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি নাক সিটকানো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। অথচ আমরা কেউই সুস্থ ও দূরদর্শী মনোভাব নিয়ে তাদের কাছে যাইনি, আলোচনার টেবিলে স্থান দিইনি। দূর থেকে মৌলবাদ বলে অশ্লীল গালি গালাজ করেছি। স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন জাতির ভবিষ্যৎ, তেমনি মাদ্রাসা ছাত্ররা ও জাতির ভবিষ্যৎ- এমন সমান অধিকারের প্রশ্নটা না দেশ, না সংবিধান কেউই করেনি। কোন রকম তদন্ত- প্রতিবেদন ছাড়াই জঙ্গি জঙ্গি বলে ‘ধর ধর’ করেছি।
কাওমি মাদ্রাসার সিলেবাস নিয়ে প্রশ্ন তুললে পাল্টা প্রশ্ন উঠবে, এখানে কেউই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল হওয়ার জন্য ভর্তি হয়না বরং কুরআন-হাদিস,আকাইদ-ফিকহের তথা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাটুকু জেনে প্রচার ও প্রসারের জন্য ভর্তি হয়। যদি মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হয় স্রেফ সাচ্চা মুসলমান তৈরি করা, তাহলে ‘কিছু করে খাওয়ার শিক্ষা’ তথা পূজিঁতান্ত্রিক আধুনিক নীতি বিবর্জিত শিক্ষাকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর আদল। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহমানতা পাল্টে দিচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। মসজিদ-মাদ্রাসা-মক্তব এই বৃওে আবর্তিত হয় এদের জীবনের সবটুকু চাওয়া পাওয়া। বিশাল এই শিক্ষিত শ্রেণিকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে একঘরে করে ‘ধার্মিক’ করে রাখার মাজেজাটা কী ? অনেক শিক্ষক আছেন যারা কুরআন-হাদিস, আকাঈদ-ফিকহের মৌলিক শিক্ষাটুকু নিস্বার্থভাবে পাঠ দেন । কিন্ত একজন শিক্ষার্থীর ইলম হাছিলের পথকে অবাধ না করে তার আগ্রহের জায়গায় যদি এভাবে সীমানা এঁকে দেওয়া হয়, তার মানসিক বিকাশ অসম্ভব। চিন্তা করবার অধিকার সে হারিয়ে ফেলে। কওমি মাদ্রাসায় কতো অসাধারণ মেধা, চমৎকার প্রতিভা আমি দেখেছি, যারা রাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকলে এই ঘুনেধরা নৈতিকতা বিবর্জিত সমাজ পাল্টে যেত।
সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চলমান বিপরীতমুখী দুটি ধারা (আরবি ও ইংরেজি) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একেকটি বৈষম্যের সূচক। যা পরস্পর বিরোধী মানসিকতার জন্ম দিচ্ছে। ফলে একঘরের দুই ভাইয়ের মধ্যে চিন্তা, রুচি ও মানবিক জীবনবোধের দিক দিয়ে ব্যক্তিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে বিশাল ব্যবধান তৈরি হচ্ছে।
স্কুল-কলেজে যারা অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেনা তাদের বিশাল একটি অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে পড়াশুনা করছে। অতি দরিদ্র বা নিন্ম অর্থনৈতিক অবস্হান থেকে কওমি মাদ্রাসায় আসছে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলে যারা বিনামূল্যে পড়ছে,তাদের বাবারা দিনমজুর, কুলি,ঠেলাগাড়ি চালায় ।এসব পরিবারের সন্তান মনস্তাত্বিক জঠিলতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। যে মাদ্রাসায় পড়ছে,সে নিপীড়িত যুবক,বিধ্বস্ত সত্ত্বা ।তার উপর সামাজিক-অর্থনৈতিক নিপীড়ন আছে।
রাষ্ট্র বলছে, কওমি মাদ্রাসায় যা পড়ানো হয়, তার কোন একাডেমিক দাম নাই। সংবিধান, আইন বা আধুনিক রাষ্ট্রের কোন ধারণা না নিয়েই এরা বড়ো হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষা কিংবা চিন্তা-চেতনার সঙ্গে এদের পরিচিতি নেই। তাই শিক্ষানীতিতে এর স্থান হয় নি। রাষ্ট্র এদের জীবিকা স্বীকার করছে না।
আধুনিক রাষ্ট্র মানুষকে ‘জীব’নয়, স্বীকৃতি দেয় ‘ব্যক্তি’ বা সাংবিধানিক অর্থে ‘নাগরিক’ হিশেবে । নাগরিকের ‘অধিকার’ ও ‘দায়’ সংবিধান ব্যাখ্যা করে। মূলকথা, রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য। তাহলে আমরা এই অধিকারের জায়গায় দাড়িয়ে এইসব মানুষদের কোনটাসা করে রাখাকে প্রশ্ন করতে পারিনা ?
তালেবান ও জঙ্গিবাদের ‘প্রজননক্ষেত্র’!
রাষ্ট্র বলছে এসব কওমি মাদ্রাসা জঙ্গি আস্তানা। সুশীল সমাজ বলছে, এরা জঙ্গি, মৌলবাদী। অস্পৃশ্য। এ দেশে মৌলবাদের স্থান নাই । মিড়িয়া এদের নিয়ে যাচ্ছেতাই লিখছে। মনের খায়েশ মিটিয়ে আমরা তাদের জঙ্গি বলি, হাতে বেড়ী পরিয়ে কারাগারে নিয়েছি। মিড়িয়ার ক্যামেরাগিরি…লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন। লম্বা দাডি, টুপি পুরোটাই ‘ইসলামিস্ট’। বেশি দৌড়-ঝাপের দরকার নাই । কওমি মাদ্রাসা ও হুজির জঙ্গি কানেকশন। তারপর সোজা আফগানিস্তান। আফগানিস্তান মানে আল কায়েদা, আল কায়েদা মানে তালেবান, ৯/১১, বিশ্ব সন্ত্রাসী। সৌদি আরব, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া হয়ে মিশর, ইয়ামেন, সিরিয়া…কী সাংঘাতিক সমীকরণ!
আমরা যারা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অডিয়েন্স (দর্শক-শ্রোতা-পাঠক), তাদের কাছে জঙ্গি, ধর্মীয় লিবাস এবং মাদ্রাসাওয়ালাদের একটি ইমেজ দাড়িয়ে গেছে। মোটামুটি হিশেবটা এরকম মাদ্রাসা-ধর্ম- মৌলবাদ -জঙ্গি । মাদ্রাসা-জঙ্গি, জঙ্গি -মাদ্রাসা, মাদ্রাসা –জঙ্গি । সুতারাং মাদ্রাসা মানে জঙ্গি, সব কওমি মাদ্রাসাওয়ালারা তালেবানী প্রোডাকশন। জঙ্গিবাদের ‘প্রজননক্ষেত্র’! মৌলবাদী, সন্ত্রাসী (প্রমাণিত) কওমি মাদ্রাসা মাত্রই রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন- বিমূর্ত এক সত্তা। রাষ্ট্র, সংবিধান, রাজনীতির বাইরে এদের অবস্থান এদের অবস্থান অচেনা, সংখ্যা অস্পষ্ট। তারা এমনই, অনায়াসে জঙ্গি, সন্ত্রাসী বলা যায়।
ব্যক্তি নিয়েই সমাজ। ব্যক্তির অপরাধ এবং দায় পুরো সমাজের। অথচ কখনো প্রশ্ন করি নি, আমরা যাদের জঙ্গি বলছি, পায়ে শেকল পরিয়ে মনের সুখ মিটাচ্ছি। এরা কারা ? জঙ্গিবাদ নামে নির্বিচারে বিশাল একটি শ্রেণিকে আহত করে মূল সমস্যা জিঁইয়ে রেখেছি। ইসলামের আর্দশিক ভবনা এবং সর্বজনীন আবেদনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সাম্রাজ্যবাদকে ঘরে টেনে নিয়ে আসছি। অবিরাম আতংক ও ভীতি ছড়িয়ে পুরো বিষয়টিকে সংশয়পূর্ণ করে তুলেছি। ফলে প্রতিনিয়ত নতুন প্রজন্মের মানসপঠে ইসলাম সম্পর্কে একটি ভীতিকর চিত্র তৈরি হচ্ছে।
আমরা অবাক হয়ে দেখি,মানবাধিকার সংস্থা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন, বিচা্র, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবার কাছে এরা প্রান্তিক,সেকেলে। মিডিয়া, এনজিও, মানবাধিকার কর্মী কেউই এদের আমলে নেয় নি। ঘনিষ্ঠভাবে মিশবার গরজবোধ করে নি। কওমি মাদ্রাসার চেহারা দেখে নি। অথচ যাচ্ছেতাই বলে, লিখে জঙ্গিবাদের নামে নির্বিচারে বিশাল এক শ্রেণিকে আহত করছে। প্রতিনিয়ত ধর্ম প্রশ্নে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মাঝে দ্বন্ধ তৈরি হচ্ছে। ফলে ইসলাম বলতে যা বুঝি, সেই বোঝাবুঝির ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সংশয়পূর্ণ করে পুরো ইসলামকে তর্কিত করছে। অথচ এর সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা ও বাঁচার লড়াই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
কওমি মাদ্রাসা নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবার আহবান যদি আমরা শুনি, তাহলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বা আঞ্চলিক জঙ্গিবাদ নিয়ে চিন্তাশীলতার যে অভাব আমরা দেখি তা খানিকটা খোলাসা হবে বলে মনে করি।
আমরা এমন রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়ত একতরফা চিন্তা-নীতিনৈতিকতা-সংস্কৃতির মধ্যে জঙ্গি ও পশ্চাদপদতার ধারণাসহ মতাদর্শিক লড়াইয়ের পাঠাতন নির্মিত হচ্ছে । এইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটু অগ্রসর হয়ে দেখি, ব্যক্তি বা দলবদ্ধ কোন শ্রেণিকে দমন করবার জন্য রাষ্ট্র যখন রাষ্ট্রীয় বিকৃত মনোভাব ও ভারসাম্যহীন চেহারা দেখায়, তখন বুঝতে হবে সেই রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দন্ধ অনিবার্য।
আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যে আইন বা রাষ্ট্রীয় ধারণা গড়ে উঠেছে সেখানে বিরাট ফারাক দেখা দিচ্ছে। ব্যক্তি এখানে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন। রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র গড়ে উঠছে। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে দেওয়াল বাড়ছে। এই মুহূর্তে যে ভেদটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে-ব্যক্তির স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রের রাজনীতি– এই দুয়ের সম্পর্ক নতুন করে বিচার করতে হবে। সেটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয় যখন রাষ্ট্র (State) ও আইনের (Jurisprudence) মৌলিক বিষয়গুলোকে সংশয়পূর্ণ করে এক অস্বস্তির সৃষ্টি করে।
একদিক গণমাধ্যমের অপপ্রচার ও অন্যদিকে কণ্ঠরুদ্ধ অবহেলিত মাদ্রাসা পড়ুয়াদের অসহায়ত্ব, বুকচাপা কষ্ট বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে। আজকের হেফাজতে ইসলাম তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই দেখি হেফাজতের ১৩ দফায় ধর্ম ইসলামের গণ্ডি পেরিয়ে ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন সহ সামগ্রিক ইসলাম চর্চার নানা উপাদান নিয়ে আওয়াজ উঠছে। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদ্রাসা যে সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করে, তা ধর্মীয় ক্ষমতা চর্চার উপাদান তৈরি করার কথা থাকলেও কওমি মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভঙ্গুরতা ও অসম্পূর্ণতার কারণে ফলে নিজেদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে নি। অথচ ক্ষমতার মোহ, আঞ্চলিক সংকীর্ণতা নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত দন্ধ তৈরি করলেও রাষ্ট্রের চরম অস্বীকৃতি, জীবিকার অনিশ্চয়তা বিশাল এই প্রজন্মকে উদ্ভ্রান্ত করেনি বরং অবহেলাকে তুচ্ছ করে ঈমান-আকীদা, দেশের স্বাধীনতা-সংস্কৃতির প্রশ্নে চেতনা ও বিদ্রোহের মিনার হয়ে বুক পেতে দাড়িয়েছে। দেশে যে নৈতিকতার চরম সংকট চলছে তার মোকাবেলায় এই হেফাজতে ইসলামীর বার্তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে সময়ের দাবী।
আগামী দিনে নতুন রাজনীতি, নতুন সমাজ গড়ে তুলবার জন্য নতুনভাবে ভাববার, কিছু করবার পথ খোঁজা জুরুরি হয়ে উঠেছে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।
লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, দারুল মা’রিফ আল ইসলামিয়া চট্টগ্রাম। বর্তমানে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ে স্নাতকোত্বর পর্বে অধ্যয়নরত। azizmonir7@gmail.com