প্রতিটি মাদরাসায় গবেষণা বিভাগ চালূ করুন। ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিন। নিজস্ব, আধুনিক প্রয়োজনীয় বই-পুস্তক রচনা ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করুন। পাশাপাশি সমৃদ্ধ, আধুনিক কুতুবখানা বা লাইব্রেরি স্থাপন করুন।
খতিব তাজুল ইসলাম ::
মুসলমানদের গবেষণা আজ নেই বললেই চলে। আত্মভুলা মুসলিম সমাজের অধঃপতন যেন আর ঠেকানো যাচ্ছে না।তবুও আমাদের কাজ করে যেতে হবে। যে জাতির নবী বলেন ‘তুমি রাতে ঘুমানোর আগে বালিশে মাথা পাতার আগে হিসেব কষে নাও সারাদিন যা করেছ তার কতটুকু সহীহ আর কতটুকু ভুল। সহীহ-শুদ্ধ হলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো আর ভুল হলে ক্ষমা চেয়ে নাও আল্লাহর দরবারে।’ এই শিক্ষা যাদের ললাটের লিখন তারাতো গবেষণা ছাড়া থাকতেই পারে না। কিন্তু হচ্ছে তাই যা নবুওতি চাহাতের বিপরীত।
তাফাক্কুর ফিকির বা কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। ইংরেজিতে বলে রিসার্চ। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের মূলে রয়েছে গভীর সাধনা আর ফিকির। পবিত্র কুরআন শরিফে বারবার ফিকিরের আহবান জানানো হয়েছে। “আফালা তাফাক্কারুন?” তোমরা কি ভেবে দেখবে না?
আমাদের আলোচ্য বিষয় দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন, দেড়হাজার বছর আগে শিক্ষাপদ্ধতি কেমন ছিলো আর আজ কেমন দাঁড়িয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধিকে ব্যবহার করে চিন্তা-ফিকির করে জ্ঞান বা শিক্ষার মানকে ক্রমশ উন্নতির দিকে নিয়ে গেছে। বড় বড় দার্শনিক, প্রখর মেধাবী ব্যক্তিত্বগণ গবেষণা করে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার সকল কলা-কৌশল লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যে কারণে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পথচলা আরো সহজ থেকে সহজতর হতে চলেছে। বিগত শতাব্দিগুলোতে বার্তা প্রেরণের বাহন ছিলো চিঠিপত্র।তারপর টেলিগ্রাম। তারপর টেলিফোন তারপর মোবাইল, ইন্টারনেট-ইমেইল কত কিছু। এখনতো দেখে দেখে কথা বলা যায়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত এখন সেকেন্ডের দূরত্বে।
পাঠদানর পদ্ধতির সংস্কার স্কুল, কলেজ ভার্সিটিগুলোতে সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলো পাল্লা দিয়ে পারছে না। তবু চলছে অগ্রগামিতার কসরত। আজকের বিশ্বে নিরাপত্তা হচ্ছে একটি বিরাট ইস্যু। প্রতি যুগে আগ্রাসন ছিলো, এখনো আছে, তবে ভিন্ন পন্থায়। তাই গবেষকরা নিত্যনতুন সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে যার-তার দেশকে আরো শক্তিশালী করছেন।
চলছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চরম উন্নতি। মানুষের জীবন-মান এখন আগের চেয়ে টোটালি অন্যরকম। কাগুজে নিউজ পেপারের দিন প্রায় শেষ হতে চললো। বই আর আলমিরাতে থাকবে না। ছোট ছোট আঙ্গুলের মতো দিয়াশলাইর বক্স তথা পেনড্রাইভ মেমোরিকার্ড নিয়ে মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। অনলাইনে চলছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ব্লগ এবং ওয়েবের মাধ্যমে সারা দুনিয়া আজ তাদের নিজেদের চিন্তা ফিকির ছড়িয়ে দিচ্ছে। ইসলামের দুশমনরা পুরো ইন্টারনেটে তুলছে খোদাদ্রোহী ঝড়। এই ঝড়ের মোকাবেলা আমাদের করতে হবে।
প্রশ্ন কিভাবে করবো? ফেসবুকের স্ট্যাটাস লিখে? আর কিছু অনলাইন পত্রিকা পাবলিশ করে? না না না। আমাদের পুরো শক্তি নিয়ে মেধা-যোগ্যতার সাথে এই অঞ্চল দখলের বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বসেই আপনি পৃথিবীর যেকোন দেশে দারস তা’লিম দিতে পারবেন, যা সচরাচর অন্যান্য দেশে শুরু হয়ে গেছে। এটা কর্মসংস্থানের এক মহাসুযোগ।
অতএব যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কুরআন হাদিসের উপরও আমাদের গবেষণার বিকল্প নেই। তাফসির, ফিক্বহ, আক্বাইদসহ সকল প্রকার ‘ইলমি মশগলা’ আমাদের টেকনোলজিতে নিয়ে যেতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন গবেষণা ও প্লান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ক্যাপাসিটির ভিতর কমপিউটার বিভাগকে উন্নত করে সাজাতে হবে। ছাত্রদের ক্লাশভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জরুরী। ভাল মাস্টার রেখে কোন ক্লাশের জন্য কোন ক্যাটাগরির কোর্স হবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। আইটি একটি বিশাল জগত। এখনো আমরা তার সিকিভাগ দখলে আনতে পারি নি।
শুধু আইটি নয়; বাংলা, আরবি, ইংরেজিসহ সকল প্রকার দারসি কিতাবের পাঠদানের বিষয়ে প্রয়োগ প্রণালী যাতে এফেক্টিভ হয় তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন। ছাত্ররা যা পড়ছে বাস্তবের সাথে তা কতটুকু সামঞ্জস্য বা মিল আছে তা ভেবে দেখতে হবে।
আমরা জানি, আগে ছিলো বাগদাদী ক্বায়দা তারপর এলো নাদিয়া ক্বায়দা এখন এসেছে নুরানী ক্বায়দা। মানুষের মননের সাথে পাল্লা দিয়ে শিক্ষা সিলেবাস পুণর্বিন্যাস একান্ত কাম্য। চলমান নদী আর বহমান নদীর সাথে শিক্ষা ও সিলেবাসের তুলনা চলে। যে নদী যত বহমান স্রোতসিনী সে নদী জীবিত ও জাগরুক। যে নদীতে পানির প্রবাহ নেই, বহতা নেই সে নদী মরা। তাই শিক্ষা সিলেবাসকে জীবিত করতে হলে নিয়মিত গবেষণা ও রিসার্চ করে উন্নততর ও আপডেট করে রাখতে হবে।
সিলেবাস সংস্কার ও পাঠদান পদ্ধতির উন্নতকরণকে যারা কুরআন-হাদিসের বিরোধী বলেন বা আকাবির ও আসলাফের বিরোধী বলেন, তারা আসলে বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে। আমাদের আকাবির-আসলাফ যা বলে গেছেন, কি করতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা আমরা এড়িয়ে চলি। তাই প্রতিষ্ঠানের একটি টিম থাকতে হবে যারা নিয়মিত রিপোর্ট করবেন। তথ্য ও তত্ত্ব সন্নিবেশিত করবেন। প্রস্তাবনা পেশ করে আলোচনার দোয়ার খোলে দিবেন।
আধুনিক লাইব্রেরি বলতে সময়ে সময়ে প্রকাশিত সকল গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ের বইয়ের সমাহার গড়ে তোলা যাতে ছাত্র বা শিক্ষার্থীরা যেন যেকোন বিষয়ের ব্যাপারে সঠিক তথ্য বা মা’লুমাত হাতের নাগালে পায়।
প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা বিভাগ শুধু বার্ষিক ম্যাগাজিন বা মাসিক পত্রিকায় সীমাবদ্ধ না রেখে মৌলিক গ্রন্থ রচনায় উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। যাতে প্রতিটি প্রকাশনা অভ্যন্তরীণ ও সাধারণ মানুষের দ্বীনী চাহিদা মিটাতে সক্ষম হয়। (চলবে)