বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৩৮
Home / খোলা জানালা / ঘটনা ‘বিচ্ছিন্ন’ আমরা তো ‘ছিন্ন–বিপন্ন’

ঘটনা ‘বিচ্ছিন্ন’ আমরা তো ‘ছিন্ন–বিপন্ন’

img

গোলাম মোর্তোজা ।।

‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’, ‘দেশ আজ গভীর সংকটে’, ‘আইনশৃঙ্খলা ভালো, অবশ্যই ভালো’, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি’, ‘প্রকাশক হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সব দেশেই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে’, ‘আইনের শাসন বলতে কিছু নেই তার পরিণতিতেই এসব হত্যাকাণ্ড’- প্রতিদিন শুনছি, শুনতে বাধ্য হচ্ছি এসব বক্তব্য। হত্যাকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি-বাহিনী নিয়ে কিছু কথা-

১. একই বিষয় নিয়ে পুরোপুরি বিপরীতমুখী বক্তব্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘ভালো’, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘খারাপ’। কার কাছে ভালো, কার কাছে খারাপ?

ক. ভালো তাদের কাছে, যারা গাড়ির পেছনে-সামনে পুলিশ প্রহরা নিয়ে চলেন। ভালো তাদের কাছে, যারা গাড়ির সামনের সিটে ‘গানম্যান’ নিয়ে চলেন। ভালো তাদের কাছে, যারা নিজেরা এক বা একাধিক লাইসেন্স করা অস্ত্র বহন করেন।

খ. খারাপ তাদের কাছে, যারা রাস্তায় বের হন পুলিশ প্রহরা ছাড়া। যাদের বাড়ির গেটে পুলিশ থাকে না। সঙ্গে ‘গানম্যান-অস্ত্র’ থাকে না। দেশের সাধারণ জনমানুষ নিজের জীবনকে নিরাপদ ভাবেন না। কেন ভাবেন না বা ভাবতে পারেন না? কারণ মানুষ দেখে দীপনরা খুন হয়ে যায়, তার সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গায় ‘নিজের কর্মক্ষেত্রে’। সাগর-রুনীরা খুন হয়ে যান ‘নিজের ফ্ল্যাটে’।

২. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো দেশের কয়েকশ’ বা সর্বোচ্চ কয়েক হাজার মানুষের কাছে। এর বাইরে দলমত নির্বিশেষে মানুষের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শুধু খারাপ নয়, দুর্বিষহ। তবে এ কথা সত্যি দেশের বড় জনগোষ্ঠীর মানুষ সরাসরিভাবে সব সময় ভুক্তভোগী নয়। তারা সরাসরিভাবে আক্রান্ত হন না। আক্রান্ত হন কিছুসংখ্যক মানুষ। এই কিছুসংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়া দেখে সাধারণ জনমানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আক্রান্ত হতে পারেন, আশঙ্কা তাদের জাপটে ধরে। নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।

৩. গত কিছুদিন ধরে বারবার বিশ্ব গণমাধ্যমে সংবাদ হয়ে আসছে বাংলাদেশ। লেখকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। সর্বশেষ আক্রান্ত হলেন প্রকাশকরা। হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন আমাদের বন্ধু, জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন। কেন দীপন হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন? আমাদের বন্ধুর অপরাধ কী ছিল?

প্রথমত, দীপন তেমন কিছু কখনও লেখেনি। তার লেখায় কেউ আঘাত পেয়েছেন, এমনটা হওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি।

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি জীবনে দীপন ‘নাস্তিক’ ছিল না। আমরা তাকে রোজা রাখতে দেখছি, দেখেছি নামাজ পড়তে। ব্যবসার অংশ হিসেবে দীপন প্রকাশ করেছিল অভিজিৎ রায়ের বই। এর সঙ্গে তার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল না।

আস্তিক-নাস্তিক, ধর্মীয় অনুশাসন মানা না মানা নিয়ে আমরা তর্ক করেছি কলেজ জীবনে। বয়স এবং জানা-দেখার পরিণতিতে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, ধর্ম পালন করা যেমন লোক দেখানোর বিষয় নয়, কেউ যদি পালন না করেন, সেটাও লোক দেখানোর বিষয় নয়। দীপনসহ আমরা বন্ধুরা তা মেনে চলেছি। দীপন কোথাও কোনওদিন ধর্মের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।

৪. কেউ ধর্ম মানে না, কেউ যদি নিজেকে ‘নাস্তিক’ হিসেবে দাবি করে, সেটা তো একান্তভাবেই তার নিজের বিষয়। যুক্তি দিয়ে সেই যুক্তি খণ্ডন করা যেতে পারে। তা না করে, হত্যা করা হবে? কোনও ধর্ম তা সমর্থন করে? ইসলাম তা সমর্থন করে? কোনওভাবেই সমর্থন করে না। তারপরও ধর্মের নামে দেশে চলছে এই হত্যাকাণ্ড। প্রতিকারহীন হত্যাকাণ্ড।

৫. লাশের সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী-রাজনীতিবিদরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা ‘ভালো অবশ্যই ভালো’। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পর দেশে কোনও ‘জঙ্গি নাই, জঙ্গি নাই’ বলে একনাগাড়ে কথা বললেন। এখন দীপন হত্যাকাণ্ডের পর আবার বলতে শুরু করেছেন, ‘জঙ্গিরা’ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। জঙ্গি যদি দেশে না থাকে, জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ড ঘটান কিভাবে?

৬. স্ববিরোধী এবং অসত্য বক্তব্যের একটা সীমা থাকা প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা তা দেখছি না। দেশে জঙ্গি ধরে তাদের ‘আইএস, আল কায়েদা’ হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে আইএস হিসেবে পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘জঙ্গি আছে, জঙ্গি নেই’ তত্ত্ব আবিষ্কার করছে সরকারি কর্তারা।

শুধু তাই নয়, সরকারের মন্ত্রী-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তারা অন্তত একটি ক্ষেত্রে জঙ্গি বা হত্যাকারীদের ভাষায় কথা বলছে। জঙ্গি বা হত্যাকারীরা বলে ‘এসব লেখা যাবে না’। সরকারের কর্তারা বলেন, এসব লেখা যাবে না, সতর্কতার সঙ্গে লিখতে হবে। লিখলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি।

অথচ তারা হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয় না। নিশ্চয়ই ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা নিতে পারে। কিন্তু জঙ্গিদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কথা কেন বলবেন তারা?

৭. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে ভালো না, তা বোঝার জন্যে ব্যর্থতা স্বীকার করার মানসিকতা আর দলীয় অন্ধত্বমুক্ত থাকলেই চলে। দীপন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা খারাপ, তার প্রমাণ দিয়ে চলে গেছে।

আমরা আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি। বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে গোয়েন্দা-আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীরও অনেকে বারবার সতর্ক করছেন। ‘সাবধানে’ থাকতে বলছেন। যদিও ‘সাবধানে থাকা’ বলতে কি বোঝায়, কিভাবে থাকতে হয়- জানি না।

৮. অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক একজন মনীষী। সন্তানের লাশ পাশে নিয়ে ব্যক্তি শোকের ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলছেন, ভবিষ্যতের দেশ ও জাতির মঙ্গলের লক্ষে। ‘আমি বিচার চাই না। চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক’- কিন্তু অশুভ নীতি নির্ধারকদের শুভবুদ্ধি আসবে কোথা থেকে! এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একদল তথাকথিত প্রগতিশীল দালাল-লেখক বুদ্ধিজীবী। যারা অপকর্ম সমর্থন করে, জনগণের বিপক্ষে কথা বলছে। ‘সরকার সবার নিরাপত্তা দিতে পারবে না’, দালালি করছে।

সতর্কভাবে লেখার পরামর্শ দিচ্ছে। অথচ তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ‘অশ্লীল’ লেখার অভিযোগ আনা যায়। যদিও তা আনার চিন্তাও করি না। শুধু ঘৃণা জানাই এসব, সুবিধাভোগী তথাকথিত প্রগতিশীলদের প্রতি।

সারাজীবন জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি আজ জাতির সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার ব্যক্তি। শ্রেণিকক্ষে জ্ঞান বিতরণ করেছেন, লিখে বিতরণ করেছেন। আপাদমস্তক একজন প্রগতিশীল মানুষ। দীপনও তাই। নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত পচা মানুষেরা, নিম্ন শ্রেণি রুচির মানুষরা, আবুল কাশেম ফজলুল হকদের মেধার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারে না। অস্তিত্বহীন জলাশয়ে ‘মাছ চাষ’ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারে, এসব নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা। আর পারে গুণী মানুষদের অসম্মান করতে।

৯. কথা দিয়ে মানুষকে অসম্মান করা যায়, সত্যকে অস্বীকার করা যায়- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যায় না। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। সবাই তা জানে-মানে, জানে কিন্তু মানে না স্বীকার করে না শুধু আমাদের ক্ষমতাসীনরা। ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলতে বলতে তারা পুরো দেশ-সমাজকেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।

দীপনদের জীবন কেড়ে নেয় সন্ত্রাসী-জঙ্গিরা। আমরা বেঁচে থাকছি নিরাপত্তাহীনভাবে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। জীবন বিপন্ন করে।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কমাশিসা-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কমাশিসা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...