ফকীহুল ইসলাম নওরোজ ::
আধুনিকীকরণের একটি সংকটপূর্ণ রাজনৈতিক ফলাফল হল এটি গ্রামাঞ্চল ও নগরাঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে থাকে। যেসব সমাজে দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটছে, সেসব সমাজের জন্য এই তফাৎ একটি অগ্রগণ্য রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। বলা চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা সেসব সমাজের উন্নয়নের একটি প্রধান প্রতিবন্ধক এবং একই কথা জাতীয় সংহতির বেলাতেও সত্য। আধুনিকীকরণ পরিমাপের অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে শহরের সংখ্যা বৃদ্ধি। শহর হয়ে ওঠে সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্রস্থল। এখানে ঘটে নতুন নতুন শ্রেণীর আগমন। শহর হয়ে ওঠে নতুন সংস্কৃতি ও শিক্ষার কেন্দ্রস্থল, যা বুনিয়াদী ভাবে গ্রামাঞ্চল থেকে পৃথক প্রকৃতির। সে সঙ্গে আধুনিকীকরণ গ্রামাঞ্চলেও মানুষের মধ্যে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দেয়। নগরবাসীরা মনে করেন যে তারা গ্রামাঞ্চল থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উৎকৃষ্ট। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলের মানুষ মনে করে তারা নৈতিক দিক থেকে উৎকৃষ্ট। এতে করে দেখা যায় শহর ও গ্রাম হয়ে ওঠে পৃথক পৃথক জাতিগত মনোভাবসম্পন্ন, তাদের উভয়ের মধ্যে জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় গুরুতর ভিন্নতা।
শহরের অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুখানজনিত অস্থিরতা, দাঙ্গা ও বিক্ষোভ, ইত্যাদি হল আধুনিকীকরণের অনিস্তার্য বৈশিষ্ট্য। তবে এ ধরনের অস্থিরতামূলক গটনা কোথায় কতটুকু ঘটবে; তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের বৈধতা ও কার্যকারিতার ওপর। শহুরে ধাঁচের অস্থিরতা কর্মগুরুত্বপূর্ণ হলেও তা সর্বজনীন। অন্যদিকে গ্রামীণ অস্থিরতা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান হলেও তা উৎরে যাওয়া সম্ভব। যদি শহুরে এলিট সম্প্রদায় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সবুজ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন, তবে সেখানে বৈপ্লবিক ধারার বিরুদ্ধশক্তি কৃষকদের সুসংগঠিত করে একদলীয় কায়দায় নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ফ্রেম তৈরী করে গ্রাম ও শহরের ভেতর বিদ্যমান তফাদ ঘুচাতে সচেষ্ট হতে পারে। যদি শহুরে এলিটগন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গ্রামীণ কৃষকদের তাদের পক্ষে সংগঠিত করে আনতে সক্ষম হন, তাহলে তারা শহরে তাদের বিরুদ্ধে চালিত বিক্ষোভ ও অস্থিরতার উপাদানগুলো দমনে সক্ষম হতে পারেন। শাসকের পক্ষে গ্রামীণ জনগন থেকে প্রাপ্ত শক্তির বলে শহুরে উন্বিত বিরোধাত্মক কর্মকান্ডের মোকাবিলা করে আধুনিকীকরণের প্রাথমিক পর্যায় সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতে পারে। গ্রামীণ জনগনের সমর্থন আদায় করার মূল্য হিসেবে শাসককে হয়তো পাশ্চাত্যের অনেক মূল্যবোধ ও ধারা বাদ দিতে হতে পারে। সুতরাং সবুজ অভ্যুত্থান হয়তো গতানুগতিক ধারার মধ্যেই থেকে যেতে পারে, আবার তা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনেরও সুচনা ঘটাতে পারে।
যদি বিপ্লব এড়ানো সম্ভব হয়, এবং যথারীতি শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে থাকে; তাহলে তা হবে খুবই রক্ষনশীল ও বৃহদায়তনিক। শহুরে শ্রমজীবীরাও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। তবে সাধারনত এই শক্তিটি থাকে দুর্বল। কিংবা এত রক্ষনশীল প্রকৃতি যে, তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ জানায় না। এমতাবস্থায় দেখা যায় নগরায়ন এগিয়ে যায় এবং শহরকেন্দ্রীক রাজনৈতিক তৎপরতা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জেঁকে বসে। এবং বলাবাহুল্য; শহর নিজেই হয়ে পড়ে অধিকমাত্রায় রক্ষনশীল। রাজনৈতিক, ব্যবস্থায় সরকার অধিকতর গ্রামের চাইতে বরং নগরবাসীর সমর্থন পেতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাস্তবিক ভাবে, এখন প্রয়োজনও সময় এসেছে নগরকেন্দ্রীক অধিপত্যের বিরুদ্ধে গ্রামীণ জনগনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। তবে সেক্ষেত্রে দেখা যায় এই গ্রামীণ প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলন হয়ে থাকে মৌলবাদী ধাঁচের। যা নগরের আধিপত্য ও শহুরে সংস্কৃতির সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। যখন বিরোধী আন্দোলন অচলাবস্থায় কিংবা ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়ে যায়, তখন আধুনিকীকরণ রাজনৈতিক অর্থে আধুনিকতার দিকে পৌছে যায়। এমতাবস্থায় শহর ও গ্রাম উভয় এলাকাই সুস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু সে অবস্থায় মূল প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে যায় শহরের হাতেই। যে সমাজ একদা গ্রামীণ সংস্কৃতির দ্বারা একত্রিত হয়েছিল; এখন সেই সমাজ নবতর আধুনিক নগরকৃষ্টির অধীনে চলে আসে।
একটি সমাজ বিপ্লবী ধারায় বিকশিত হবে কিনা তা কমবেশি নির্ভর করে তার নেতাদের পছন্দ এবং তাদের শহরবিরুদ্ধ শক্তির ওপর, কেননা শহর ভিত্তিক শ্রেণী রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। এমতাবস্থায় গ্রামীণ কৃষক সমাজকে গ্রামীণ নেতৃত্ব বিপ্লবের জন্য সংগঠিত করতে পারে। বিশেষ করে তাদের শহরের প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করার জন্য। যা হয়ে থাকে সহিংস পন্থায় এবং প্রচলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে। একটি সমাজ কেবল তখনই বিপ্লবের সম্ভাবনার জন্য ঝুঁকিবহুল বা বিপ্লবের জন্য উজ্জল সম্ভাবনা নিয়ে আসে তখন মধ্যবিত্তের বিরোধিতা ও কৃষককুলের বিরোধিতা একত্রে মিলে যায়। যখন মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে সংরক্ষনশীল তখন গ্রামীণ বিদ্রোহ হতে পারলেও বিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
এটাও পড়তে পারেন
ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই
খতিব তাজুল ইসলাম: বিগত আড়াইশত বছর থেকে চলেআাসা ঐতিহাসকি একটি ধারাকে মুল ধারার সাথে যুক্তকরে ...