বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ড যেকোনো দেশের জন্য বিব্রতকর। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশেও বিদেশি নাগরিকেরা সব সময় নিরাপদ থাকেন না। বিদেশের মাটিতে বর্ণবাদী বা পেশাদার অপরাধী চক্রের শিকার হয়ে বাংলাদেশ বা অন্য দেশের মানুষ নিহত হওয়ার বহু ঘটনা এখনো ঘটে থাকে। প্রতিপক্ষ সংগঠনের স্বগোত্রীয়দের হাতে বা পারিবারিক বিরোধের জের হিসেবে খুন হওয়ার ঘটনাও খুব বিরল নয় ইউরোপ বা আমেরিকায়। পড়াশোনা করতে গিয়ে আমি যে পাঁচ-ছয় বছর ইউরোপে ছিলাম, তখন দেখেছি যে বাংলাদেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন শারীরিকভাবে অনেক শক্তিশালী গুন্ডা প্রকৃতির আক্রমণকারীদের নিয়েও।
বাংলাদেশ সে তুলনায় বিদেশিদের জন্য অনেক নিরাপদ একটি দেশ। এ দেশে দুজন বিদেশি নাগরিকের হত্যার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তারপরও আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলো ষড়যন্ত্রমূলক মনে হওয়ার কারণ রয়েছে বলেই এমন হয়েছে। হত্যাকাণ্ডগুলো কোনো বর্ণবাদী আক্রমণের ঘটনা নয়, বাংলাদেশে সে অর্থে বর্ণবাদের অস্তিত্বই নেই। হত্যাকাণ্ডের শিকার দুই বিদেশির সঙ্গে কারও বিরোধ বা স্বার্থ-সংঘাত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এগুলো ছিঁচকে অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত বলেও ধারণা করা যাচ্ছে না। ফলে এগুলোর পেছনে ষড়যন্ত্রমূলক কিছু রয়েছে বলে আশঙ্কা করার কারণ রয়েছে।
ষড়যন্ত্র থাকলে এর লক্ষ্য হতে পারে যে কেউ, যেকোনো সময়ে। ষড়যন্ত্র থাকলে ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য কী, কারা করছে এসব ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের ক্ষমতা বা নিয়ত সরকারের রয়েছে কি না—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়া গেলে সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা কাটবে না। আর তা না কাটলে এ দেশে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে বিদেশিদের অংশগ্রহণ ব্যাহত হওয়া অনেক দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে, দেশের ইমেজের জন্যও তা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে।
২.
দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের আগে-পরের ঘটনাগুলোও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক হত্যার আগেই এ দেশে নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে সফর স্থগিত করেছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল। আকস্মিক এই সফর বর্জন অযৌক্তিক মনে হয়েছিল। দুই বিদেশি হত্যার পরও বাংলাদেশ কোনো ক্রিকেট দলের সফরের জন্য একেবারে নিরাপত্তাহীন হয়ে গেছে—এটি আমরা অনেকেই মানতে চাইব না। হত্যাকাণ্ডগুলোর জের হিসেবে যেভাবে পশ্চিমা দূতাবাসগুলো সতর্কতা জারি করেছে, তাদের কিছু কর্মরত নাগরিক দেশে ফিরে গেছেন, ব্যবসায়ী দল সফর বাতিল করেছে, তা সাদা চোখে দেখলে বাড়াবাড়িও মনে হতে পারে।
তবে আমরা বা আমাদের সরকার কী ভাবছে, তা-ই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বৈশ্বিক রাজনীতি আর কূটনীতি আমাদের সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পশ্চিমা বিশ্বের পারসেপশন, তা যদি আরোপিত বা মিথ্যেও হয়, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অনেক ক্ষেত্রে। আরোপিত ধারণা ও প্রচারণার ভিত্তিতে অন্য দেশে ব্যাপক সামরিক হামলা, সরকার উৎখাত এবং বিভিন্ন ধরনের অবরোধের ঘটনা বিশ্বে ঘটে চলেছে। কোনো দেশে স্বৈরাচার আর দুঃশাসন চেপে বসলে আন্তর্জাতিক বৈরিতা ঘটার আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। এসব বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সরকারকে সৎ ভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে দুই বিদেশি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে।
৩.
দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড তদন্তে সরকার আন্তরিক রয়েছে বলে বারবার বলা হচ্ছে। তবে দুঃখজনকভাবে হলেও সত্যি যে সরকারের পক্ষ থেকে দুই বিদেশি হত্যার ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কিছু প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। সিজার তাবেলা হত্যাকাণ্ডের পর কোনো গ্রেপ্তার এমনকি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের আগেই এ জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করা হয়েছে। সরকারপ্রধান নিজে যখন এ ধরনের কথা বলে ফেলেন, তখন বাংলাদেশের গোয়েন্দা বা পুলিশ সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তদন্তকাজ সাজানোর চেষ্টা করে, এমন নজির আমরা বিভিন্ন আমলে দেখেছি। এতে আর যা-ই হোক সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব হয় না।
বিএনপি নেতা মঈন খানের বাসায় পশ্চিমা কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের নৈশভোজনের ঠিক পরদিন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল সফর বর্জন করেছিল, এর সূত্র ধরে পশ্চিমা নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। সরকারের লোকদের অভিযোগ শুনে মনে হয়েছে মঈন খানের কথায় পশ্চিমারা একযোগে তা করেছে! এটি কি আদৌ সম্ভব? বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিজস্ব অবলোকন ব্যবস্থা প্রতিটি শক্তিশালী বিদেশি রাষ্ট্রের রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তারা শুধু একজন রাজনীতিকের কথায় রাতারাতি এমন পদক্ষেপ নিয়ে ফেলবে? বিদেশি একটি দূতাবাসের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে যে তারা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কার কথা সরকারকে আগেই জানিয়েছিল। সেটি কি সরকার বিবেচনায় নিয়েছে?
সরকারের মন্ত্রীরা দুই বিদেশি হত্যায়ও বিএনপির হাত রয়েছে বলে চলেছেন। এই অভিযোগ বা সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু একই সন্দেহ আরও বহু মহলের বিরুদ্ধে করা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত এখন হনন স্পৃহার পর্যায়ে চলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে সরকার বা বিএনপি যে কাউকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের ওপর আরও বেশি আন্তর্জাতিক খবরদারি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেও কোনো গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটাতে পারে। দুই বিদেশি খুনের ঘটনার পরপরই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এই ইঙ্গিতকে শিরোধার্য ভেবে সরকারের এজেন্সিগুলো বাকি সব সম্ভাবনা বাদ দিয়ে বিদেশি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শুধু বিএনপিকে জড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। এমন আশঙ্কা বিএনপির নেতারা বেশ কয়েকবার প্রকাশ করেছেন।
দুই বিদেশির হত্যাকাণ্ড স্পর্শকাতর ঘটনা। যেভাবে এর আগে-পরে পশ্চিমারা এবং অন্য কিছু ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) জোটভুক্ত দেশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা এই হত্যাকাণ্ডগুলোর গুরুত্বকে আরও অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত থেকে কোনো রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের চিন্তা থাকলে সরকারকে তা বাদ দিতে হবে। কোনো একটি পূর্বানুমানকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা না করে সব পূর্বানুমান ও সন্দেহের সুচারুভাবে তদন্ত করতে হবে।
আমরা জানি, বাংলাদেশে বহু চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা হয়নি (যেমন সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড)। গুলশান-বনানীর নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে বিএনপি নেতা রিয়াজ রহমানের ওপর প্রকাশ্য আক্রমণের কোনো সুষ্ঠু তদন্তই হয়নি। অন্যদিকে বহু ঘটনায় বিরোধী দলের নেতাদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, অনেকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব একটি পুরোনো সত্যকেই প্রমাণ করে। তা হচ্ছে, এ দেশে যেকোনো সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনায় গোয়েন্দারা ক্ষমতাসীন সরকারের অভিলাষ মোতাবেক তদন্তকাজ পরিচালনা করে। এমন এক পরিপ্রেক্ষিতে দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড তদন্তে সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়ার আগে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করলে বরং তদন্তকাজের সততা নিয়ে গোড়া থেকে সন্দেহ থাকবে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে কারও জন্যই ভালো হবে না।
৪.
দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে আমাদের আরেকটি বিষয়ে বোধোদয় হতে হবে। আমরা অতীতে এই সরকারকে বাংলাদেশে আইএস, আল-কায়েদা এ ধরনের জঙ্গি আছে বলে বলতে শুনেছি। প্রধানত বিরোধী দলকে ঘায়েল করতেই এ ধরনের প্রচারণা চালানো হতো বলে অভিযোগ ছিল। এ জন্য আমরা এমনকি বিদেশে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনায়ও বিএনপি-জামায়াত জড়িত বলে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাকে বলতে শুনেছি।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আইএস যদি এ দেশে থেকেই থাকে তাহলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পর কেন সরকার বারবার বলছে যে এ দেশে এমন কোনো গোষ্ঠী নেই? আর না থেকে থাকলে কেন অতীতে এসব প্রচারণা চালানো হয়েছে? অপপ্রচারণা দিয়ে বিরোধী দলকে সাময়িকভাবে ঘায়েল করা সম্ভব। বহু দেশেই এটি হয়। কিন্তু তা নিজ দেশের এমনকি নিজ সরকারের স্বার্থকে কীভাবে বিপন্ন করতে পারে, এমন উদাহরণও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতা বা সংঘাত এমন পর্যায়ে তাই যেতে দেওয়া উচিত না, যা দেশের স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে। সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষকেই এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। বিদেশি হত্যাকাণ্ড, বিদেশি বয়কট আর বিদেশি প্রচারণার বিরুদ্ধে পরস্পরকে সহায়তা করতে হবে। নিজের চেয়ে দেশকে বেশি মূল্যবান ভাবলে এটি না করার কোনো বিকল্প নেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।