ইসলাম আমাদের জীবনার্দশ। এ কথা র্সবজনবিদিত যে আঞ্চলিকতা, জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ভিত্ততে ইসলামের জাতিসত্তা নির্মিত হয়নি। এমনকি ইসলাম আনুষ্ঠানর্সবস্ব কোনো র্ধমও নয়; বরং মানব জীবনের সব র্কমকা-কে ঘিরেই রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও নির্দেশনা। হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে প্রতিটি সম্প্রদায়েরই সুনির্ধারিত গণনারীতি বা ক্যালেন্ডার রয়েছে। খ্রিস্টর্পূব ৩৭০০ বছর আগে থেকে ইহুদিরা র্বষ গণনা শুরু করে আর খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা আ.’র জন্ম তারিখ থেকে ঈসায়ি র্বষ গণনা শুরু হয়। উপমহাদেশে বাদশাহ আকবরের সমরে প্রবর্তিত বাংলা সন সময়ের প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়। অনুরূপভাবে হিজরি র্বষের সূচনা হয় হযরত রাসুলে করীম সা.’র হিজরতের ঐতিহাসিক সফরকে কেন্দ্র করে। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাটি ছিল ২০ সেপ্টেম্বর মতান্তরে ২৭ সপ্টেম্বের ৬২২ খিস্টাব্দ। ৮ ই রবিউল আউয়াল। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাযি. স্বীয় খেলাফতকালে সময়ের প্রয়োজনে হিজরি সন প্রর্বতন করেন এবং পহেলা মুহররম থেকে হিজরি বর্ষ গণনার রেওয়াজ চালু করেন। অতএব বলা যায়, ইসলামি র্বষ গণনা ও শতাব্দির সূচনা ১৬ জুলাই ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই শুরু হয়েছিল। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল, যেদিন থেকে ইসলামি শতাব্দি বা হিজরি নববর্ষের সূচনা হয়েছিল, সেদিন ছিল পহেলা মুহররম এবং জুমাবার।
চান্দের মাস : কিছু বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য
প্রচলতি সাল গণনা, বর্ষপঞ্জি ও হিজরি সনের মাঝে র্পযালোচনা করলে দেখা যায় যে, হিজরি সন অন্যান্য বর্ষসনগুলোরচে’ বিশেষ কিছু কারণে অনন্য ও বৈশিষ্টম-িত। হিজরি সন বা আরবি সনের সূচনা চন্দ্রকে কেন্দ্র করেই প্রবর্তিত হয়েছে। আর ইসলামি মাসের র্কমকা-ও এ চাঁদকে ঘিরেই হয়ে থাকে, যথা- হজ্ব, রোযা, ঈদ, কুরবাণী ইত্যাদি। মূলত: এটি আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই হয়ে থাকে। এখানে কারো হস্তক্ষেপ করা বা অযথা টেনশন করে মাথা ঘামিয়ে দিন-তারিখ বের করার দরকার হয় না। এ হল বান্দার প্রতি মহান মাওলার অনন্য এহসান। প্রতিটি ভূখ-ইে পাহাড়ের উচ্চতা, গভীর অরণ্য ও বিস্তির্ণ মরুভূমি; সব জায়গা থেকেই জোৎস্নাময় চাঁদ অবলোকন করা যায়। এটা একেবারেই সহজসাধ্য। অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিরাও চাঁদকেন্দ্রি হিসাব-নিকাশ বের করতে পারেন। অন্যদিকে অন্যান্য গণনারীতি এতোটা সহজসাধ্য ও বোধগম্য নয়; বরং অসংখ্য যোগ্য জনবল, সীমাহীন সময় ব্যয় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-তারিখ নির্ধারণ করতে হয়। তারপরও কিন্তু পৃথিবীর সব শ্রেণির মানুষ তা সহজে মেনে নিতে পারে না এবং হিজরি সনের মত এতো সহজে দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশও ওয়াকিবহাল হতে পারে না। বরং নানা মাধ্যমে এটা মানুষকে জানাতে হয়। অপরদিকে চাঁদ র্সবত্র দেখা যায় বলে তার হিসাবেও এতো জটিলতা নেই।
ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত ন্যায় ও ইনসাফরে র্ধম। তার সাম্যনীতি র্সবজনবিধিত। এজন্য আল্লাহ তা’য়ালা এটাই পছন্দ করেছেন যে, ইসলামি মাসগুলো মানুষের জীবনে বছরব্যাপী ঘুরে ঘুরে আসুক। এজন্যই চাঁদকেন্দ্রিক গণনারীতি ইসলাম গ্রহণ করেছে। অন্যান্য সম্প্রদায়; যদি ইসলামি জীবন পরিচালনায় খ্রিস্টীয় গণনারীতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে প্রতিবছর একই স্থানে একই ঋতুতে একই সময়ে রমযান মাস আসবে। ফলে সুবিধাবাদী লোকেরা শীতকালে যখন দিন ছোট থাকে, তখন রোযা রাখতে আগ্রহী হবে। একই কথা হজের সফরের ক্ষেত্রেও।
মুহররম মাস ও পৃথিবীর ইতহিাস
মুহররম একটি ঘটনাবহুল মাস। ইসলামর্পূব পৃথিবীর ইতিহাসেও এই মাসে অসংখ্য অবিস্মরণীয় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সেসব ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসকে কেবল সমৃদ্ধই করেনি; একাধারে সৃষ্টি করেছে অপার বিস্ময়। সেসব ঘটনা আকস্মিক বা কাকতালীয় কোনো ব্যাপার ছিল না; বরং মহান স্রষ্টার অকাট্য সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ঐসব ঘটনার অবতরণ ও সূত্রপাত হয়েছিল। সেসব ঘটনা সমূহের কয়েকটি নিম্নরূপ :
* খুঁটিহীন চমৎকার এই পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল পবিত্র এ মাসেই।
* এ মাসে মানব জাতির পিতা হযরত আদম আ.কে সৃষ্টি করা হয়েছে।
* এ মাসেই হযরত আদম আ.’র তাওবা কবুল হয়েছিল।
* এ মাসেই মানুষকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি ঘোষণা দিয়ে হযরত আদম আ.কে খেলাফতের মুকুট’ পরানো হয়।
* নুহ আ.’র দুনিয়া ডুবানো মহাপ্রলয়ঙ্কারী বন্যার সময় নুহ আ.’র নৌকা এ মাসেই ‘জুদী’ নামক পাহাড়ে যাত্রাবিরতি করে।
* এ মাসেই আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহীম আ. ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হন।
* এ মাসেই হযরত ইউসূফ আ. কয়েদখানা থেকে মুক্তি পান।
* এ মাসেই হযরত ইয়াকুব আ. হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান।
* এ মাসেই হযরত ইউনূছ আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন।
* খোদাদ্রোহী ফেরাউন এ মাসেই নীল নদে ডুবে মারা যায়।
* এ মাসেই হযরত ঈসা আ.কে ঊর্ধলোকে উঠিয়ে নেয়া হয়।
* হস্তীবাহিনীর ঘটনা এ মাসেই সংঘটিত হয়। পবিত্র কা’বায় হামলাকারী বাদশাহ আবরাহা একঝাঁক আবাবিল পাখির আক্রমণে সদলবলে নিহত হয়।
* এ মাসের ১০ তারিখে কিয়ামত সংঘটিত হবে।
ইসলামের ইতিহাসে মুহররম মাস
মুহররম মাস ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনার স্মারক। অনেক কালজয়ী ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছে ঘটনাবহুল এ মাস। নি¤েœ তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
* নবুওয়াতের চর্তুথ বছর পহেলা মুহররম রাসুল সা. ‘শিয়াবে আবি তালিব’এ অবরুদ্ধ হন।
* ২য় হিজরিতে হযরত আলী রাযি. ও নবী কন্যা হযরত ফাতেমা রা. বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
* ৭ম হিজরিতে পৃথিবীর বিভিন্ন বাদশাহদের প্রতি ইসলামের দাওয়াতী র্কাযক্রম শুরু হয় এবং খায়বার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
* ৯ম হজিরি মুহররম মাসে ‘দূত’ প্রেরণ শুরু হয়।
* ১৯ হজিরি হযরত মুহররম মাসে হযরত মুয়াবিয়া রাযি. ক্ষমতার চেয়ারে।
* ২৪ হজিরি পহেলা মুহররম ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান গনী রাযি. খেলাফতের মসনদে আরোহন করেন।
* ৩৪ হিজরির এ মাসে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাযি. খেলাফতের আসন অলঙ্কৃত করেন।
* ৩৭ হিজরির এ মাসে ‘ সিফ্ফীন যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়।
* ৪৫ হিজরির এ মাসে আফ্রিকা মহাদেশ বিজিত হয়।
* ১৩৩ হিজরির এ মাসে রোম বা ইতালির সম্রাট মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়।
* ৯৪৭ হিজরিতে শের শাহ সিংহাসনে আরোহণ করনে।
* ১২৮৩ হিজরির পাঁচ মুহররম দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ১৪০০ হিজরির এ মাসেই শিয়া সম্প্রদায় পবিত্র কা’বা শরীফে হামলা করে।
যাঁদের ওফাত ও শাহাদাতে শোকাতুর এ মাস
* বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযি.’র ইন্তেকাল।
* হযরত ওমর ফারুক রা.’র শাহাদাত বরণ।
* আবদুর রহমান রা. বনি আবু বকর রা.’র ইন্তেকাল।
* মেজবানে নবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.’র শাহাদাত লাভ।
* হযডরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা.’র ইন্তেকাল।
* উম্মুল মু’মিনীন হযরত জুয়াইরিয়া রা.’র ইন্তেকাল।
* কারবালা প্রান্তরে নবী দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা.’র শাহাদাত লাভ।
* বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর রা.’র ইন্তেকাল।
* মির্জা মাজহার জানে জানান মতান্তরে জান রাহ.’র ইন্তেকাল।
* আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি রাহ.’র ইন্তেকাল।
তথ্যসূত্র. সব লেখকই যেমন বিভিন্ন মাধ্যমের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন, তাই…। তথ্য নিতে হয় বলে নেয়া হয়েছে। একান্ত বাধ্য হয়ে। পকেট থেকে তথ্য দেয়া হয় নি।