সাঈদ হোসাইন::
[প্রিয় পাঠক! শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। লেখাটি একটু দীর্ঘ হয়ে গেল। হুমায়ুন আহমেদ আমার পছন্দের মানুষ ছিলেন না। কারণ লোকমুখে তাঁর সম্পর্কে অনেক কানকথা শুনেছি। তাই তাঁর প্রতি আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর কিছু বিষয়ে জানতে পারি। সেসব বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে। হৃদয়-গহ্বরে তাঁর জন্য ইকটুখানি ভালোবাসা জন্মেছে। সেই সুপ্ত ভালোবাসার কিঞ্চিৎ প্রকাশ এই লেখা। লেখাটির কিছু বিষয় আপনার মনেও রেখাপাত করতে পারে। একটু সময় নিয়ে পড়ে দেখুন। তাঁর সম্পর্কে অজানা অনেক কিছু জানতে পারবেন। এ বিষয়ে অন্য কোন লেখায় একসঙ্গে এত তথ্যের সমাহার ঘটেনি। হয়ত খুচরো খুচরো কিছু জেনেছেন। লেখাটি সঠিক তথ্যভিত্তিক লেখা হয়েছে। ধারণানির্ভর কোন তথ্য এখানে আসেনি। জানি না লেখাটি তথ্যসমৃদ্ধ করে কতটুকু সাজাতে পেরেছি। তবে পাঠক উপকৃত হবেন বলে আশা রাখি।]ভুল-শুদ্ধ মিলিয়েই মানুষ। দোষ-গুণ মানুষের থাকাটা স্বাভাবিক। হুমায়ুন আহমেদ একজন মানুষ। তাঁর অনেক দোষ থাকতে পারে এবং আছেও। যশ-খ্যাতির মোহমন্ত্র তাঁকে বিপথগামী করেছিল। আজ আমরা সেদিকটায় যাব না। আজ আমাদের আলোচনা হবে তাঁর বিশ্বাস, স্পষ্টবাদিতা ও শেকড়ে ফেরা নিয়ে। লিখব তাঁর ভাষায়, তাঁর বই ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দিয়ে। অনুমাননির্ভর কোন তথ্য বা কানে উঠা কোন কথা এই লেখায় ওঠে আসবে না। শুরুতেই আমরা তাঁর বংশ-পরিচয় ও পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে একটু জেনে নিই। তিনি লিখেন, ‘আমি এসেছি অতি কঠিন গোড়া মুসলিম পরিবেশ থেকে। আমার দাদা মাওলানা আজিমুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর বাবা জাহাঙ্গির মুনশি ছিলেন পীর মানুষ। আমার দাদার বাড়ি ‘মৌলবিবাড়ি’ নামে এখনো পরিচিত। [ফাউন্টেনপেন: ১৯]’ দাদার কাছে লেখা হুমায়ুন আহমেদের মায়ের একটি চিঠির অংশ- ‘…বাচ্চুর (হুমায়ুন আহমেদের ডাকনাম) পরীক্ষা মে মাসে। সে আপনার কথা শুনে। তাকে বুঝায়ে পত্র দেন। যাতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেয়। আর যাতে নামাজ পড়ে সে জন্য উপদেশ দেন। …[আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলি: ৩৯৪] ’হুমায়ুন লিখেন, ‘ধর্ম নিয়ে আমার আগ্রহ খানিকটা আছে। সিলেট যাব, শাহজালাল (রহঃ)–এর মাজারে কিছু সময় কাটাব না তা কখনো হবে না। রাজশাহী যাওয়া মানেই নিশিরাতে শাহ মাখদুমের মাজার শরীফে উপস্থিত হওয়া। [ফাউন্টেনপেন: ২২]’ তিনি মাজারে যেতেন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে। ধর্মের নামে বেদাত তাঁর অপছন্দ ছিল। এটা তাঁর দাদারও নিষেধ ছিল। ইমদাদুল হক মিলনের ‘মৃত ব্যক্তির অলৌকিক শক্তিতে তিনি বিশ্বাসী কি না?’ এরকম এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ। আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য_আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়। [লিংক-https://shapnopuron.wordpress.com/…/হুমায়ুন-আহমেদ-এর-সাক্…/]
আমাদের দেশের অজপাড়াগাঁয়ে ভণ্ড পীর-ফকির, মূর্খ মৌলবি ও কাঠমোল্লার প্রাদুর্ভাব আছে। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর লেখায় বা নাটক-উপন্যাসে এদের ভণ্ডামি, মূর্খতা ও ব্যক্তিত্বহীনতা যদি তুলে ধরেন, তাহলে সেটাকে ভালো আলেমরা নিজের ঘাড়ে টেনে তুলে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে হুট করে তাঁকে ‘নাস্তিক’ বলে ফেলাটা আবেগপ্রসূত অজ্ঞতা বলেই মনে করি। হ্যাঁ, তাঁদের জন্যই বলছি, জেনে নিন তিনি কি আস্তিক নাকি নাস্তিক।
‘স্থান: বেলিভিও হাসপাতাল। নিউইয়র্ক। আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনী কেটে একটা সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুঁই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি মৃত্যু হলে দায়দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার।
অপারেশন হবে ভোর ন’টায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?
হ্যাঁ।
কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্যে তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?
তার মানে কী?
এই হাসপাতালের রোগীদের জন্যে প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনার জন্যে আলাদা ফি আছে। তুমি ফি’র ডলার জমা দিলেই প্রার্থনার ব্যবস্থা হবে।
হাসপাতাল হল চিকিৎসার জায়গা। প্রার্থনার জায়গা- এটা জানতাম না।
কাউন্সিলর বললেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে যাদের জন্যে প্রার্থনা করা হয় তাদের আরোগ্যের হার বেশি। এইজন্যেই প্রার্থনা বিভাগ খোলা হয়েছে।
আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই।
তোমার অপারেশন জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি। একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন।
ডিসকাউন্টের প্রার্থনায়ও আমার বিশ্বাস নেই।
তুমি কি নাস্তিক?
আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী না। [ফাউন্টেনপেন: ৪৫-৪৬]’
দৈনিক প্রথম আলোর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। আমি স্টিফেন হকিংয়ের একটা লেখা পড়লাম। প্রকৃতির মধ্যে কিছু নিদর্শন তো আছেই। তোমাকে একটা যুক্তি দিই, শোনো। এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় যুক্তি। তুমি মঙ্গল গ্রহে গিয়েছ। সেখানে গিয়ে তুমি দেখলে পাহাড়, পর্বত, পাথর। পাথর দেখে তুমি বলবে, বহুকাল থেকে, সেই আদ্যিকাল থেকে পাথরগুলো এভাবেই আছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তুমি দেখতে পেলে একটা নাইকন ক্যামেরা। তুমি সেটা হাতে নেবে। তখন তোমাকে বলতেই হবে, এর একজন স্রষ্টা আছে। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে তুমি এ কথা ভাবতে পারবে না যে শূন্য থেকে এটা আপনা-আপনি এসে হাজির হয়েছে। কারণ, এটা একটা জটিল যন্ত্র। এবার, আরেকটু এগিয়ে গেলে। কোত্থেকে একটা খরগোশ বেরিয়ে এসে তোমার দিকে তাকাল। নাইকন ক্যামেরা কী করে? ছবি তোলে। খরগোশ কী করে? অনেক কাজই করে। খরগোশের একটা কাজ হলো দেখা। এই খরগোশের চোখ নাইকন ক্যামেরার চেয়ে হাজার গুণ বেশি জটিল। নাইকন ক্যামেরাটা দেখে তোমার যদি মনে হয় যে এর একটা নির্মাতা থাকা দরকার, তাহলে খরগোশের বেলায় এটা তোমার মনে হবে না কেন? আমার প্রথম যুক্তি যদি গ্রহণ করো, আমার দ্বিতীয় যুক্তিটাও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিল এ রকম। অণু-পরমাণুতে ধাক্কাধাক্কির ফলে একটা জটিল অণুর জন্ম হয়েছে। একসময় এটা এত দূর জটিল হয়ে উঠছে, সেটা একেবারে নিজের মতো আরেকটা জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছে। তারপর তৈরি হলো মানুষ। অসম্ভব ধীমান একটি প্রাণী। একটা গোলাপ ফুল দেখে যে মানুষ তারিফ করতে পারে, একটা পরম শৃঙ্খলা ছাড়া শুধু ধাক্কাধাক্কি করে কি এটা সম্ভব হতে পারে? এবং এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে অণু-পরমাণুর ধাক্কাধাক্কির ফলে আমরা গোলাপ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি? এই পৃথিবীর সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে। প্রোটন হবে ইলেকট্রনের চেয়ে ১,৮৩৬ গুণ বড়। সমস্ত তত্ত্ব, সংখ্যা ধ্রুব। এই ধ্রুবত্ব কে নির্ধারণ করেছে?
বিজ্ঞান কোনো বিষয় সম্পর্কে হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। তার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। কিন্তু এই পদ্ধতি তো শুরু থেকে ছিল না। যেমন—অ্যারিস্টটল বলছিলেন, মানুষের মস্তিষ্কের কাজ হলো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা। কথাটা অ্যারিস্টটল বলেছিলেন বলেই আমরা এক হাজার বছর পিছিয়ে গেছি। এখন বিজ্ঞান অনেক অদ্ভুত কথা বলছে। যেমন—মানুষের শরীরের মধ্যে যে ডিএনএ থাকে, তার মৃত্যু নেই।
তাই আমি মনে করি, আমরা এখনো খুব অল্প বিষয়ই জানতে পেরেছি। একজন পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে রসায়ন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব না। জ্ঞানের পরিধি অনেক অনেক বড়। যুগে যুগে যেসব ধর্মপ্রচারক এসেছেন—তাঁরা কিন্তু একটা সামগ্রিক ধারণা রাখতেন জগৎ বিষয়ে। আল্লাহ তাঁদের কাছে সব সময় সরাসরি জ্ঞান দেন নাই। তাঁরা সব সময় যে সরাসরি ওহি পেয়েছেন তা তো না? জিবরাইল কি সব সময় সশরীরে এসে ওহি পৌঁছে দিয়েছেন? না। অনেক সময় শব্দের মাধ্যমে, অনেক সময় আলোর মাধ্যমেও ওহি পাঠানোর ব্যপারটা ঘটেছে। এ কারণে আমার মনে হয়, মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানে সৃষ্টিকর্তাকে পুরোপুরি কখনো জানা সম্ভব না।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো এটা ধরে নিয়ে কিন্তু আমি চিন্তা করছি না। আমি চিন্তা করছি এমন একটা অস্তিত্ব নিয়ে, যে সর্বব্যাপী। তাকে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কল্পনাশক্তি দিয়ে কল্পনা করতে পারছি না। তিনি আমাদের কল্পনাসীমার বাইরে। অনেক সূরায় নানাভাবে এসেছে এ প্রসঙ্গ। সূরা এখলাসও এ বিষয়েই।
কিন্তু আমি সৃষ্টিকর্তাকে জানতে চাই। আমার নিজের জীবনে নানা ঘটনা বিভিন্ন সময়ে আমাকে ভাবিয়েছে।’ [২৭-০৭-২০১২, দৈনিক প্রথম আলো,লিংক- http://www.prothom-alo.com/deta…/date/2012-07-27/news/277119]
হুমায়ুন আহমেদ মোল্লা, আধা-মোল্লাদের আনাড়িপনাকে যেমন তুলোধুনো করেছেন, তেমনি সৎ, সত্যবাদী ও সাহসী আলেমের ভূমিকাও তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায় ও নাটক-সিনেমায়। ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণমূলক লেখায় হুমায়ুন স্বীকার করেছেন এটি তাঁর জীবনের সেরা একটি লেখা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনেই তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছেন বলে দাবী করেছেন। এ উপন্যাসের মূল নায়কই হলেন একজন সত্যিকার আলেম। তিনি পাক হানাদার বাহিনীর জুলুমের বিপক্ষে ছিলেন। দেশের জন্য তাঁর আত্মত্যাগের কাহিনীটি তিনি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে উপস্থাপন করেছেন।‘শ্যামল ছায়া’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র। এই ছবিতেও তিনি মূল নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করলেন একজন আলেমকে। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তিনি যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন, তা অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশের লেখকরা যেখানে খ্যাতি অর্জনের জন্যে তাদের লেখায় বা নাটক-সিনামায় আলেমদেরকে রাজাকারের ভূমিকায় পেশ করে তাঁদের কপালে ‘কলঙ্ক তিলক’ এঁকে দিতে চায়, সেখানে হুমায়ুন আহমেদ সৎসাহস নিয়ে একটি ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করে রীতিমতো কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
হুমায়ুন আহমেদ কতটা অকপট ও স্পষ্টবাদী মানুষ ছিলেন তার একটা দৃষ্টান্ত দিলে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন। একজন সাংবাদিক তাঁকে একটি প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নটি ছিল : ‘এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?’ হুমায়ূন আহমেদের সাবলীল উত্তর : “আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে যাঁরা আছেন, তাদের কার্যক্রম খুব একটা পরিষ্কার না। এরা কেন জানি ইসলাম ধর্মকে খুব ছোট করে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান অন্য যেকোনো ধর্মের প্রায় সব উৎসবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত থাকেন, বক্তৃতা করেন, বাণী দেন- কিন্তু ইসলামি কোনো জলসায় কেউ উপস্থিত থেকেছেন বলে শোনা যায় না। তাদের মতে, ইসলামি জলসায় কেউ উপস্থিত থাকা মানে তার বুদ্ধিবৃত্তিও নিম্নমানের। সে একজন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক লোক। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অর্থ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা, প্রগতির চর্চা করা, সংস্কারমুক্ত হওয়া ইত্যাদি। প্রফেসর সালাম ঢাকায় এসে যখন বক্তৃতার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বললেন, তখন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা হকচকিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে প্রগতিশীল হওয়া, বুদ্ধিজীবী হওয়া, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানেই ইসলামবিরোধী হতে হবে। তাদের কাছে রামকৃষ্ণের বাণী, যিশুর বাণী সবই গ্রহণীয়। এসব তারা উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করেন; কিন্তু হজরত মোহাম্মদের বাণী কখনো তাদের মুখ থেকে শোনা যায় না। তাদের কাছে হজরত মোহাম্মদের বাণী গ্রহণযোগ্য নয়।
আমার মতে, পৃথিবীর তাবৎ ঔপন্যাসিক যাঁর কোটের পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তার নাম দস্তয়ভস্কি। আরেকজন আছেন মহামতি টলস্টয়। এক রেলস্টেশনে যখন টলস্টয় মারা গেলেন, তখন তাঁর ওভারকোটের পকেটে একটি বই পাওয়া গেছে, তার নাম Sayings of Prophet। বইটি ছিল টলস্টয়ের খুব প্রিয়। সব সময় সঙ্গে রাখতেন। সময় পেলেই পড়তেন। বইটিতে হজরত মোহাম্মদ সা:-এর বিভিন্ন সময়ে বলা ইন্টারেস্টিং কথাগুলো গ্রন্থিত। আমি বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাছে জানতে চাইছি, আপনাদের ক’জন বইটি পড়েছেন? টলস্টয় যে বইটি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, সেই বই আমাদের প্রত্যেকের একবার কি পড়া উচিত নয়? আমার মতে, প্রতিটি শিক্ষিত ছেলেমেয়ের বইটি পড়া উচিত।[১২ নভেম্বর ২০১৫, দৈনিক নয়াদিগন্ত ]’ হুমায়ুন আহমেদ তাঁর বিভিন্ন লেখায় মাঝেমাঝে কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে দ্বিধা করেননি। যা বলতে চেয়াছেন তা স্পষ্টভাবে বলেছেন। যেমন কুরআনের একটি আয়াত নিয়ে আলোচনার পর তিনি লিখেন, ‘আমি কোন ভুল করেছি এরকম মনে হয় না, তারপরেও এই বিষয়ে জ্ঞানী আলেমদের বক্তব্য আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনব। [ফাউন্টেনপেন: ৭২]’
‘ধর্মপরায়ণ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ’ শিরোনামের একটি লেখা এখানে উদ্ধৃত করছি-
‘হুমায়ূন আহমেদ এতাটই ধর্মপ্রাণ ছিলেন যে তার গড়া নুহাশ প্ললীতেই তিনি নামাজ পড়ার জন্য শ্বেতপাথর দিয়ে আলাদা একটি স্থান করেছিলেন। সেখানে হুমায়ূন আহমেদ যখন আসতেন, তখন মাঝে মাঝে নামাজ পড়তেন বলে জানান নূহাশ পল্লীর খণ্ডকালীন ও স্থানীয় বোয়ালিয়া মসজিদের পেশ ইমাম মুজিবুর রহমান। মৃত্যুর পর ওই স্থানের পাশেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। তাই তার নির্দিষ্টি করে দেওয়া সেই স্থানে নুহাশ মসজিদ নির্মাণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা। তাদের দাবি, সেখানে নুহাশ মসজিদ গড়ে তোলা হলে প্রতিদিন পাচঁবার হুমায়ূন আহমেদ আজান শুনতে পাবেন। হুমায়ূন আহমেদের নামাজ পড়া প্রসঙ্গে স্থানীয় বোয়ালিয়া মসজিদের পেশ ইমাম মুজিবুর রহমান জানান, আসলে স্যার ছিলেন অন্যরকম একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তাকে কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না। তিনি তার মনের গভীরে মহান আল্লাহকে স্থান দিয়েছিলেন। স্যার ও তার সঙ্গে আসা লোকজন আমার পেছনে নামাজ পড়তেন। প্রতিদিন নুহাশ পল্লীতে অনেক মানুষ আসত। তাদের সুবিধার্থে স্যার নামাজের জায়গা করে দিয়েছিলেন। স্যার যেখানে শুয়ে আছেন, তার পাশেই তিনি নামাজ পড়ার জন্য শেফালী ফুল গাছে ঘেরা শ্বেতপাথরের স্থানটি তৈরি করেছিলেন। এদিকে হুমায়ুন আহমেদের বৃদ্ধ চাচা আলতাফ আহমেদও স্বীকার করেছেন, হুমায়ুন আহমেদ নামাজ ও দোয়ার সময় বাহ্যিক সবকিছুই ভুলে যেতেন। তিনি প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিময় অনেক কথার কিছুটা স্মৃতিচারণ করে বললেন, মোহনগঞ্জে গ্রামের বাড়ির সামনের এই স্কুলটা হুমায়ূন আহমেদের একটা স্বপ্ন ছিল। সে সব সময় বলত, এই স্কুল একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার আগেই চলে গেল। আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমার খুব মনে পড়ে, স্কুল তৈরির প্রথম দিকটায় সে এসে স্কুল মাঠেই পানি এনে গোসল করত। মাঠের ঘাসগুলো তার খুব প্রিয় ছিল। গোসল শেষে এ মাঠে দাড়িঁয়ে সে নামাজও আদায় করত। অপর দিকে নূহাশ পল্লীসংলগ্ন বাবুর চালা মসজিদের ইমাম মাওলানা সেকান্দার আলীও হুমায়ূন আহমেদের ধর্মভীরুতার কথা জানিয়ে বলেছেন, স্যার যখনই এখানে আসতেন তিনি আমাদের ডেকে নামাজে ইমামতি করতে বলতেন। আমি ও মজিবুর রহমান ইমামতি করতাম। হুমায়ূন স্যার নামাজে দাড়ালে চারদিকের সবকিছুই ভুলে যেতেন। নাটক বা অন্য কোনো অনুষ্ঠান থাকলে নামাজের অনেক সময় পর সেকাজগুলো করতেন। কেউ কেউ এতে বিরক্ত হলেও স্যার বলতেন, সময় নিয়েই আল্লাহর এবাদত করতে হয়। এ ছাড়া স্যার প্রতি রমজানে এখানে ইফতারের আয়োজন করতেন। দূরদূরান্ত থেকে যারা আসতেন তাদের ইফতারের সময় বাইরে ইফতার করতে দিতেন না। আমরা বৃষ্টি বিলাসের সামনে একসঙ্গে বসে ইফতার করতাম। বোয়ালিয়া মসজিদের পেশ ইমাম মুজিবুর রহমান আরো বলেন, নুহাশ পল্লীতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ বেড়াতে আসত। স্যারের কারণেই মূলত এই অজপাড়াগাঁ মানুষ চিনেছে। এখানে যারা বেড়াতে আসেন অথবা শুটিং করতে আসতেন, তারাও নামাজ পড়তেন। এ জন্য স্যার বেশ কিছু শীতল পাটি কিনে দিয়েছিলেন। প্রতি রমজান মাসে এখানে প্রতিদিন ইফতার মাহফিল ও সেহরির ব্যবস্থা থাকে। শবেবরাতে বিশেষ ইবাদতের ব্যবস্থা হয়। স্যার এবং অনেক বিশিষ্টজন আসেন। সারারাত ইবাদত হতো। স্যার ধর্মীয় আলোচনা করতেন। স্যারের কবরের পাশেই শেফালী ফুল গাছে ঘেরা শ্বেতপাথরের নামাজের স্থান। এ জায়গাটি স্যারের খুব প্রিয়। এতদিন এখানে তিনি আমার পেছনে নামাজ পড়তেন। তিনি বলেন, স্যারের ওই স্থানটা এত প্রিয় ছিল যে গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই হেটেঁ আসনে লিচু বাগানে, এখানে নামাজের জায়গা তৈরি করেছিলেন আপন ইচ্ছাতেই। স্যারের বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। মরহুম বাবার রুহের মাগফিরাত কামনায় প্রতিবছর তিনি নুহাশ পল্লীতে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। আমি সেই মাহফিলে আসি। একদিন তিনি আমাকে এখানে স্থায়ীভাবে নামাজ পড়াতে বলেন। আমি রাজি হয়ে যাই। তারপর স্যার লিচু বাগানে গড়ে তুললেন নামাজের ঘর। আমি সেখানে পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়াই। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে। তারা নামাজের জায়গা খোঁজেন। স্যার বিষয়টি বুঝতে পেরে সেখানে নামাজ পড়ার জন্য লিচু তলার পাশে ব্যবস্থা করে দেন। মুজিবুর আরো উল্লেখ করে বলেন, তার মৃতুতে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে নুহাশ পল্লীর মানুষ, যখন জানা গেল স্যারের কবর হবে নুহাশ পল্লীতে, তখনই দুঃখের মধ্যেও সুখ পেল এলাকাবাসী। আমাদের সৌভাগ্য, জীবনে যে মহান মানুষকে আমরা পেয়েছিলাম, মরণের পরও তাকে আমরা হারাইনি। তার জন্য আমাদের আন্তরিক দোয়া, ভালবাসা থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত।
[লিংক-http://www.pipilika.com/site_ajax_ca…/…/970153/bn/new_window]হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী শাওনের লেখা ‘হুমায়ূনের টেপরেকর্ডার’ থেকে কিছু উদ্ধৃত করছি-
‘আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরণসঙ্গীত’- ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি। শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছে- ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ ‘নক্ষত্রের রাত’ নামের ধারাবাহিক নাটকের শুটিং ফ্লোরে আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এবং একজনকে দায়িত্ব দিলাম গানটি বিশেষ সময়ে গাইতে। সে রাজি হলো। উৎসর্গপত্রের মাধ্যমে তাকে ঘটনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা সময় এসে গেছে।
মেহের আফরোজ শাওন’
চলে যায় বসন্তের দিন, হুমায়ূন আহমেদ, ২০০২, উৎসর্গপত্র।…
হুমায়ূন-শাওনের শেষ আনন্দময় গানের আসরটি বসেছিল মেরীল্যান্ডের এক বাসায়। শ্রোতা ছিলেন প্রবাসী লেখক মুনিয়া মাহমুদ ও তাঁর স্বামী নুরুদ্দিন মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার বন্ধু ফানসু মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না ভাবি, গৃহকর্তা নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া, প্রবাসী পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পছন্দের গানগুলোর ইতিহাস বলছেন এবং পরক্ষণেই তাঁর টেপরেকর্ডার, আমি, সেই গানটি গেয়ে শোনাচ্ছি। ১৯০৫ সালে রেকর্ডকৃত প্রথম গান নিধুবাবুর টপ্পা, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান এবং হুমায়ূন সঙ্গীত হলো। আমাদের প্রায় সব গানের আসর মৃত্যুসংগীত দিয়ে শেষ হলেও হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই বিশেষ গানটি আমি গাইতে চাইতাম না।
‘পাঠকের যেমন মৃত্যু হয়, শ্রোতারও মৃত্যু হয়। অতি প্রিয় গান একসময় আর প্রিয় থাকে না। তবে কিছু গান আছে কখনও তার আবেদন হারায় না। আমার কাছে মরমি কবি গিয়াসউদ্দিনের একটি গান সে রকম। ওল্ড ফুলস ক্লাবের প্রতিটি আসরে একসময় এই গান গীত হতো। শাওনের প্রবল আপত্তির কারণে এই গান এখন আর গীত হয় না। গানটির শুরুর পঙ্ক্তি-
মরিলে কান্দিস না আমার দায়
ও জাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’
নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, হুমায়ূন আহমেদ, পৃষ্ঠা-৫৯
কিন্তু সেদিন হুমায়ূনের গানটি শোনার প্রবল ইচ্ছার কাছে হার মানলাম। গান শুনে প্রথম দিনের মতো কাঁদলেন তিনি। এরপর আর গান শোনানো হয় নি তাঁকে। দ্বিতীয়বার অপারেশনের সাত দিন পর ফুসফুসে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে তাঁকে মেশিনের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নিতে হয়। প্রক্রিয়াটি অস্বস্তিকর বলে বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। সারা দিনে কেবল ১-২ ঘণ্টার জন্য তাঁর ঘুম ভাঙত। মুখে নল থাকার কারণে কথা বলতে না পারলেও আমাদের সব কথা শুনতে ও বুঝতে পারতেন তিনি। সেই সময়টাতে তাঁর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম, তাঁর সাথে কথা বলতাম। নুহাশের কথা, নিষাদের কথা, নিনিতের কথা, নুহাশপল্লীর তাঁর প্রিয় গাছগুলোর কথা, আমার কথা। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়ত, তাঁর হাত দিয়ে শক্ত করে ধরতেন আমার হাত। একদিন দেখলাম পাশের রুমে কোমায় থাকা এক রোগীকে নার্স গুনগুন করে গান শোনাচ্ছে আর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানালেন রোগীকে মিউজিক থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। আচ্ছা, একইভাবে গান শুনিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে আমিও তো থেরাপি দিতে পারি। কিন্তু সেই সুযোগ আর দিলেন না হুমায়ূন। ১৯ জুলাই। নীরব নিথর হুমায়ূনের সাথে ডাক্তাররা যখন আমাকে একা কিছুটা সময় কাটাতে দিলেন তখন…।
না। আমাকে দেওয়া গুরুদায়িত্ব পালনে তাঁর শবদেহের পাশে বসে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গান ধরতে পারি নি। হুমায়ূনের টেপরেকর্ডার বিকল হয়ে গেছে সেদিন থেকে………………………
[আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘হুমায়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ’ থেকে]প্রিয় পাঠক, আপনার জন্য মরমি কবি গিয়াসউদ্দিনের লেখা ‘মরণসঙ্গীত’টি তুলে ধরছি-
মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
মরিলে কান্দিস না আমার দায়
সুরা ইয়াসীন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়।
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোঁকায়
রে যাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
বুক বান্ধিয়া কাছে বইসা গোছল করাইবা
কান্দনের বদলে মুখে কলমা পড়িবা।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
কাফন পিন্দাইয়া আতর গোলাপ দিয়া গায়
তেলাওয়াতের ধ্বনি যেন ঘরে শোনা যায়।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
কাফন পড়িয়া যদি কান্দো আমার দায়
মসজিদে বসিয়া কাইন্দো আল্লা’রই দরগায়।
রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে নিউইয়র্কে হুমায়ুন আহমেদের সেই শেষ গানের আসরটির ভিডিও পাওয়া যায় ইউটিউবে। সেখানে দেখা যায়, হুমায়ুন শাওনের দিকে ইঙ্গিত করে দর্শক-শ্রোতাদের বলছেন, ‘এই গানটা সে কখনই গাইতে চাই না। আজকে তাকে রিকুয়েস্ট করব গানটা গাওয়ার জন্য। It is true for each and every one of us. এটা হচ্ছে- আমরা বড় বড় মানুষের কথা শুনলাম, নজরুলের কথা শুনলাম, রবীন্দ্রনাথের কথা শুনলাম, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষরাও যে অসাধারণ গান লিখতে পারেন, অসাধারণ সুর দিতে পারেন এটা কিন্তু- It is a fact…। হুমায়ুন শাওনকে বললেন, Particularly তুমি গানটা শুনায় দাও। শাওন বললেন, এটা লাস্ট বার, হ্যাঁ? হুমায়ুন বললেন, হু। শাওন গাইতে শুরু করলেন- মরিলে কান্দিস না আমার দায়…ও জাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়…। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, হুমায়ুনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। তিনি হাত দিয়ে অশ্রু মুছছেন। গানের শেষেও তিনি টিস্যু দিয়ে অশ্রু মুছে ফেলতে দেখা যায়। একজন বলল, আঙ্কেলের জন্য সবাই নামজ পড়ে দুয়া করবেন, যাতে তিনি আরও ৫০ বছর বেঁচে থাকেন। হুমায়ুন আহমেদ অপারেশনের আগে ডাক্তারের সঙ্গে আলাপের একটি কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি ডাক্তারকে বললাম, Am I going to die? তারপর তিনি বললেন, Yes. You are going to die আমার তো কলিজা-টলিজা জ্বলছে। তিনি বললেন, Listen, We all are going to die, this why I said, You are going to die. But I will not let you die so so.হুমায়ুন বললেন, এটা ডাক্তারের কথা। মৃত্যু নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই যখন সময় আসবে তখন…। একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক বললেন, (فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً ۖ وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ )। হুমায়ুন বললেন, মানে? বৃদ্ধ লোকটি বললেন, শুধু মাত্র যখন সময় আসবে তখনই মৃত্যু হবে এক মুহূর্ত আগেও না, এক মুহূর্ত পরেও না। হুমায়ুন: হ্যাঁ, হ্যাঁ। সূরা বনি ইসরাইলের আরেকটা আয়াত আছে। আমার খুব পছন্দ। সূরা বনি ইসরাইলের আয়তটা হচ্ছে- ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।’ (আয়াতটি দুইবার বললেন তিনি) কাজেই আমাদের ভাগ্যে কী আছে না আছে সবই তো উপরওয়ালা…। খামোকা আমরা ঝামেলা বাধাইতেছি কেন। শাওন একটি প্রশ্ন করলেন, রিজিক আল্লাহর হাতে, তাহলে আমরা ঘরে বসে থাকি? হুমায়ুন বললেন, মানুষের রিজিক আল্লাহর হাতে ঠিকই, কিন্তু আমাদেরকে রিজিক অর্জন করতে হবে। [লিংক-https://www.youtube.com/watch?v=tP2e8wSMAv0]
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিউইয়র্কে চিকিৎসা করাতে এসে নিয়মিত নামাজ পড়তেন। হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়ায় উৎসাহিত করেন তার ভায়রা (গুলতেকিনের ফুপাতো বোনের স্বামী) জামাল আবেদীন খোকা। জামাল আবেদীন হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়ার জন্য একটি জায়নামাজ এবং তসবি কিনে উপহার দিয়েছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনাবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ নামাজ আদায় করতে শুরু করেন এবং এক সময় নিয়মিত (৫ ওয়াক্ত) নামাজ আদায় করতেন। এ কথা জানিয়েছেন জামাল আবেদীন খোকা। [লিংক-http://www.hollywoodbanglanews.com/news/8237.html]
এবার হুমায়ুন আহমেদের অসমাপ্ত লেখা ‘নবিজী’ নিয়ে কিছু আলোচনা করি। ইমদাদুল হক মিলনের নেয়া একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হল-
প্রশ্ন : আপনি অনেক দিন ধরে বলছেন যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী আপনি লিখতে চান। সেই লেখার প্রস্তুতিটা কী রকম?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতির কথা বলব, কিন্তু এখানেও কিছু সমস্যা আছে। সমস্যা হলো দুই ধরনের। প্রথম সমস্যা হলো, আমার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষি আছে তো…আমি যখন সব কিছু ঠিকঠাক করলাম, তখন একটা ঘটনা ঘটে। শুরু থেকেই বলি। বাংলাবাজারে অন্যপ্রকাশের একটি স্টল আছে। স্টলটি উদ্বোধনের জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক দিন পরে আমি বাংলাবাজারে গেলাম। স্টলের ফিটাটিতা কাটলাম। এক মাওলানা সাহেব প্রার্থনা করলেন। আমি খুবই অবাক হয়ে তাঁর প্রার্থনা শুনলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটি বইপত্র সম্পর্কিত খুবই ভালো ও ভাবুক ধরনের প্রার্থনা। একজন মাওলানা এত সুন্দর করে প্রার্থনা করতে পারেন যে আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। মাওলানা সাহেবকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার প্রার্থনাটা শুনে আমার ভালো লেগেছে।’ মাওলানা সাহেব বললেন, ‘স্যার, আমার জীবনের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হবে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে।’ আমি তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হলাম। আমি বললাম, ‘এই আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কেন?’ মাওলানা সাহেব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই কারণ আমি ঠিক করেছি, দেখা হলেই আপনাকে আমি একটা অনুরোধ করব।’
‘কী অনুরোধ শুনি?’
‘আপনার লেখা স্যার এত লোকজন আগ্রহ নিয়ে পড়ে, আপনি যদি আমাদের নবী করিমের জীবনীটা লিখতেন, তাহলে বহু লোক এই লেখাটি আগ্রহ করে পাঠ করত। আপনি খুব সুন্দর করে তাঁর জীবনী লিখতে পারতেন।’
মাওলানা সাহেব কথাগুলো এত সুন্দর করে বললেন যে আমার মাথার ভেতর একটা ঘোর তৈরি হলো। আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই, আপনার কথাটা আমার খুবই মনে লেগেছে। আমি নবী করিমের জীবনী লিখব।’ এই হলো ফার্স্ট পার্ট। চট করে তো জীবনী লেখা যায় না। এটা একটা জটিল ব্যাপার, কাজটা বড় সেনসেটিভ। এতে কোথাও একটু উনিশ-বিশ হতে দেওয়া যাবে না। লিখতে গিয়ে কোথাও যদি আমি ভুল তথ্য দিয়ে দিই, এটি হবে খুবই বড় অপরাধ। এটা আমাকে লেখা শুরু করতে বাধা দিল।
প্রশ্ন : আপনি কি মহানবীর জীবনী লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : নাহ্, আমি লেখার কাজ শুরু করিনি। আমি অন্যদিন-এর মাসুমকে বললাম, ‘তুমি একটা সুন্দর কাভার তৈরি করে দাও তো। কাভারটা চোখের সামনে থাকুক। তাহলে আমার শুরু করার আগ্রহটা বাড়বে।’ মাসুম খুব চমৎকার একটা কাভার তৈরি করে দিল। বইটার নামও দিলাম_’নবীজী’। তখন একটা ছেলেমানুষি ঢুকে গেল মাথার মধ্যে। ছেলেমানুষিটা হলো, আমি শুনেছি বহু লোক নাকি আমাদের নবীজীকে স্বপ্নে দেখেছেন। কিন্তু আমি তো কখনো তাঁকে স্বপ্নে দেখিনি। আমি ঠিক করলাম, যেদিন নবীজীকে স্বপ্নে দেখব, তার পরদিন থেকে লেখাটা শুরু করব। স্বপ্নে এখন পর্যন্ত তাঁকে দেখিনি। যেহেতু এক ধরনের ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞার ভেতর আছি, সে কারণে লেখাটা শুরু করতে পারিনি। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবু আমি স্বপ্নের অপেক্ষায় আছি।
প্রশ্ন : আপনার প্রস্তুতি কী? মানে পড়াশোনা আর অন্যান্য…।
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রস্তুতি ভালো। পড়াশোনা ভালোই করেছি। বইপত্র জোগাড় করতে পেরেছি। বন্ধুরাও বইপত্র সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছেন। কাজেই এখন আমি বলতে পারি যে নবীর জীবনী লেখার জন্য আমার প্রস্তুতি যথেষ্ট হয়েছে।
প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যেসব জীবনী লেখা হয়েছে, এর মধ্যে আপনার পছন্দের কোনটা?
হুমায়ূন আহমেদ : সত্যি কথা বলতে কি, আমার তেমন পছন্দের কোনো জীবনী নেই। জীবনীগুলোর মধ্যে ভক্তি চূড়ান্তভাবে বেশি। আমার লেখার মধ্যেও ভক্তি থাকবে। কিন্তু একটু অন্যভাবে থাকবে এবং আরো কিছু ব্যাপার থাকবে। [২১ শে অক্টোবর, ২০১১; শিলালিপি]
আমরা জানি না, তিনি নবিজীকে স্বপ্নে দেখছিলেন কি না। হয়ত দেখেছেন, হয়তবা দেখেননি। রহস্যময় পুরুষ হুমায়ুন আহমেদ সেই রহস্য ভেদ করেননি। তবে ‘নবিজী’ লেখা তিনি শুরু করেছিলেন। এই লেখাটি শেষ করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কারণ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে হন্তারক ব্যাধি ক্যানসারের তীব্র আক্রমণ। কিন্তু অসমাপ্ত এই লেখায় তিনি অসাধারণ গদ্যশৈলীর পরিচয় দিয়েছেন। ছোট ছোট বাক্যে শব্দমালার শৈল্পিক গাঁথুনি ও গল্প বলার ঢঙে বাঙময় হয়ে উঠেছে তাঁর এই লেখা। যেটুকু তিনি লিখেছেন, তাতে পাঠকের পাঠস্পৃহাকে তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সেই স্পৃহাকে তিনি পূর্ণতা দিতে পারেননি! পাঠকের জন্য লেখাটির চুম্বকাংশ পত্রস্থ হল-
‘তখন মধ্যাহ্ন।
আকাশে গনগনে সূর্য। পায়ের নিচের বালি তেতে আছে। ঘাসের তৈরি ভারী স্যান্ডেল ভেদ করে উত্তাপ পায়ে লাগছে। তাঁবুর ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্যে সময়টা ভালো না। আউজ তাঁবু থেকে বের হয়েছে। তাকে অস্থির লাগছে। তার ডান হাতে চারটা খেজুর। সে খেজুর হাতবদল করছে। কখনো ডান হাতে কখনো বাম হাতে।
আউজ মনের অস্থিরতা কমানোর জন্যে দেবতা হাবলকে স্মরণ করল। হাবল কা’বা শরিফে রাখা এক দেবতা যার চেহারা মানুষের মতো। একটা হাত ভেঙে গিয়েছিল বলে কা’বা ঘরের রক্ষক কোরেশরা সেই হাত সোনা দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে। দেবতা হাবলের কথা মনে হলেই সোনার তৈরি হাত চোখে চকমক করে।
দেবতা হাবলকে স্মরণ করায় তার লাভ হলো। মনের অস্থিরতা কিছুটা কমল। সে ডাকল, শামা শামা। তাঁবুর ভেতর থেকে শামা বের হয়ে এল। শামা আউজের একমাত্র কন্যা। বয়স ছয়। তার মুখ গোলাকার। চুল তামাটে। মেয়েটি তার বাবাকে অসম্ভব পছন্দ করে। বাবা একবার তার নাম ধরে ডাকলেই সে ঝাঁপ দিয়ে এসে তার বাবার গায়ে পড়বে।
শামার মা অনেক বকাঝকা করেও মেয়ের এই অভ্যাস দূর করতে পারেন নি।
আজও নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না। শামা এসে ঝাঁপ দিয়ে বাবার গায়ে পড়ল। সে হাঁটতে পারছে না। তার বাঁ পায়ে খেজুরের কাঁটা ফুটেছে। পা ফুলে আছে। রাতে সামান্য জ্বরও এসেছে।
শামা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাবার কাছে আসতেই তার বাবা এক হাত বাড়িয়ে তাকে ধরল। এক হাতে বিচিত্র ভঙ্গিতে শূন্যে ঝুলিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। শামা খিলখিল করে হাসছে। তার বাবা যেভাবে তাকে কোলে তোলেন অন্য কোনো বাবা তা পারেন না।
আউজ বলল, মা খেজুর খাও।
শামা একটা খেজুর মুখে নিল। সাধারণ খেজুর এটা না। যেমন মিষ্টি স্বাদ তেমনই গন্ধ। এই খেজুরের নাম মরিয়ম।
আউজ মেয়েকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। রওনা হয়েছে উত্তর দিকে। শামার খুব মজা লাগছে। কাজকর্ম না থাকলে বাবা তাকে ঘাড়ে নিয়ে বেড়াতে বের হন। তবে এমন কড়া রোদে কখনো না। আউজ বলল, রোদে কষ্ট হচ্ছেরে মা ?
শামা বলল, না।
তার কষ্ট হচ্ছিল। সে না বলল শুধু বাবাকে খুশি করার জন্যে।
বাবা!
হুঁ।
আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
তোমাকে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখাব।
সেটা কী ?
আগে বললে তো মজা থাকবে না।
তাও ঠিক। বাবা, অদ্ভুত জিনিসটা শুধু আমি একা দেখব ? আমার মা দেখবে না ?
বড়রা এই জিনিস দেখে মজা পায় না।
আউজ মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাল। সে সামান্য ক্লান্ত। তার কাছে আজ শামাকে অন্যদিনের চেয়েও ভারী লাগছে। পিতা এবং কন্যা একটা গর্তের পাশে এসে দাঁড়াল। কুয়ার মতো গর্ত, তবে তত গভীর না।
আউজ বলল, অদ্ভুত জিনিসটা এই গর্তের ভেতর আছে। দেখো ভালো করে। শামা আগ্রহ এবং উত্তেজিত হয়ে দেখছে। আউজ মেয়ের পিঠে হাত রাখল।
তার ইচ্ছা করছে না মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলতে। কিন্তু তাকে ফেলতে হবে। তাদের গোত্র বনি হাকসা আরবের অতি উচ্চ গোত্রের একটি। এই গোত্র মেয়েশিশু রাখে না। তাদের গোত্রের মেয়েদের অন্য গোত্রের পুরুষ বিবাহ করবে ? এত অসম্মান ?
ছোট্ট শামা বলল, বাবা, কিছু তো দেখি না।
আউজ চোখ বন্ধ করে দেবতা হাবলের কাছে মানসিক শক্তির প্রার্থনা করে শামার পিঠে ধাক্কা দিল।
মেয়েটা ‘বাবা’ ‘বাবা’ করে চিৎকার করছে। তার চিৎকারের শব্দ মাথার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আউজকে দ্রুত কাজ সারতে হবে। গর্তে বালি ফেলতে হবে। দেরি করা যাবে না। একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না।
শামা ছোট্ট হাত বাড়িয়ে ভীত গলায় বলছে, বাবা, ভয় পাচ্ছি। আমি ভয় পাচ্ছি।
আউজ পা দিয়ে বালির একটা স্তূপ ফেলল। শামা আতঙ্কিত গলায় ডাকল, মা! মা গো!
তখন আউজ মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, উঠে আসো।
আউজ মাথা নিচু করে তাঁবুর দিকে ফিরে চলেছে। তার মাথায় পা ঝুলিয়ে আতঙ্কিত মুখ করে ছোট্ট শামা বসে আছে। আউজ জানে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। গোত্রের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তাকে অবশ্যই গোত্র থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। এই অকরুণ মরুভূমিতে সে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে বাঁচতে পারবে না। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে হলে তাকে গোত্রের সাহায্য নিতেই হবে। গোত্র টিকে থাকলে সে টিকবে।
বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্যে গোত্রকে সাহায্য করতেই হবে। গোত্র বড় করতে হবে। পুরুষশিশুরা গোত্রকে বড় করবে। একসময় যুদ্ধ করবে। মেয়েশিশুরা কিছুই করবে না। গোত্রের জন্যে অসম্মান নিয়ে আসবে। তাদের নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে যাওয়াও কষ্টকর।
আউজ আবার গর্তের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ছোট্ট শামা ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। মরুভূমিতে দিকচিহ্ন বলে কিছু নেই। সবই এক।
আজ থেকে সতেরো শ’ বছর আগে আরব পেনিসুয়েলার এটি অতি সাধারণ একটি চিত্র। রুক্ষ কঠিন মরুভূমির অতি সাধারণ নাটকীয়তাবিহীন ঘটনা। যেখানে বেঁচে থাকাই অসম্ভব ব্যাপার সেখানে মৃত্যু অতি তুচ্ছ বিষয়।…
পবিত্র কোরান শরীফে সূরা তাকবীরে জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যা বিষয়ে আয়াত নাজেল হলো। কেয়ামতের বর্ণনা দিতে দিতে পরম করুণাময় বললেন-
সূর্য যখন তার প্রভা হারাবে, যখন নক্ষত্র খসে পড়বে, পর্বতমালা অপসারিত হবে। যখন পূর্ণগর্ভা উষ্ট্রী উৎক্ষেপিত হবে, যখন বন্যপশুরা একত্রিত হবে, যখন সমুদ্র স্ফীত হবে, দেহে যখন আত্মা পুন:সংযোজিত হবে, তখন জীবন্ত সমাধিস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে- কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?
যে মহামানব করুণাময়ের এই বাণী আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আমি এক অকৃতী তাঁর জীবনী আপনাদের জন্য লেখার বাসনা করেছি। সব মানুষের পিতৃঋণ-মাতৃঋণ থাকে। নবীজির কাছেও আমাদের ঋণ আছে। সেই বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা।
ভুলভ্রান্তি যদি কিছু করে ফেলি তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি পরম করুণাময়ের কাছে। তিনি তো ক্ষমা করার জন্যেই আছেন। ক্ষমা প্রার্থনা করছি নবীজির কাছেও। তাঁর কাছেও আছে ক্ষমার অথৈ সাগর।…’[লীলাবতীর মৃত্যু: ৯-১২]
এই লেখাটি সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর শাওন এটিএন নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক চ্যানেল থেকে এসেছে, একথাটা আমি বলিনি, বলা হয়নি আসলে। সেটা হচ্ছে একটা- (তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন) আমাদের নবিজীর জীবনীটা লেখার খুব ইচ্ছা ছিল এবং এটা লিখাটা শুরুও করেছিলেন। এবং খুব টেনশন করছিলেন এটা ঠিকমতো লিখতে পারেন কি না। এই লেখাটা শেষ করার খু-ব ইচ্ছা ছিল। নবিজীকে নিয়ে নবিজীর জীবনীটা লেখার খু-ব ইচ্ছা ছিল। প্রচুর বই সংগ্রহ করেছিলেন, প্রচুর বই। যত ধরণের বই বেরিয়েছে, প্রকাশিত যত ধরণের বই আছে দেশ-বিদেশের আমাদের হযরত মুহাম্মদ সা.কে নিয়ে। উনাকে নিয়ে বইটা লেখার ইচ্ছা ছিল। [লিংক-http://youtube.com/watch?v=yeVdo0fK4MQ&feature=g-upl]
নবিজীর ‘বিপুল ঋণ শোধের অতি অক্ষম চেষ্টা’ যিনি শুরু করেছেন, পরম করুণাময় যেন তাঁর উপর করুণাধারা বর্ষণ করেন। আর তাঁর ভুলভ্রান্তি যেন ক্ষমা করে দেন।
হুমায়ুন আহমেদের লেখা একটি জনপ্রিয় গানের পঙ্ক্তি দিয়েই ইতি টানছি এই দীর্ঘ লেখার-
ও কারিগর দয়ার সাগর
ওগো দয়াময়
চাননি পসর রাইতে যেনো
আমার মরণ হয়।