যুগান্তর অনলাইন ভার্সনে তরুণ ডাক্তারদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন আমাদের নজর কাড়ে। চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি হওয়ায় এই করুণ অবস্থা। আসুন প্রকাশিত সংবাদের দিকে একটু নজর দেই:
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা শতাধিক। এতো ছোট ভূখণ্ডে এতো মেডিকেল কলেজ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখনই প্রতি বছর সাত হাজারের কাছাকাছি ডাক্তার বের হন। দুই বছর পর বছরে ১০ হাজারের বেশি ডাক্তার বের হবেন। গত পঞ্চাশ বছরে মোট ডাক্তার নিবন্ধিত হয়েছেন প্রায় ৮০ হাজার। আগামী দশ বছরেই বের হবে আরো ১ লাখ ডাক্তার। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত জেলায় জেলায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি তো আছে। সঙ্গত কারণে এতো ডাক্তারের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এই দরিদ্র দেশে সম্ভব না। প্রতিটি তরুণ ডাক্তার ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরের দিন থেকে এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়। চাহিদার চেয়ে যোগান বেশি হওয়ায় এই তরুণ ডাক্তারদের অবস্থা হয় খুবই করুণ।
টিকাঃ স্বীকার করি বাংলাদেশ ছোট্ট একটি ভুখন্ড! কিন্তু জনসখ্যার হার কত? প্রায় সতের কোটি বনিআদমের বিরাট কাফেলা নিয়ে পথচলা এই জনপদের মানুষগুলো আজও জীবনের মৌলিক সকল চাহিদা হাতের নাগালে পায়নি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা এবং চিকিতসা এই পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে বক্ষমান নিবন্ধে চিকিতসা নিয়ে আমাদের আলোচনা। আমি মনেকরি এখনো গড় অনুপাতে মাত্র ২৫-৩০% ভাগ মানুষ চিকিতসা সুবিধা ভোগ করছে নিজেদের আর্থক সামর্থ্য ব্যবহার করে। আরো ২০ ভাগ মানুষ খুব কষ্ট করে চিকিতসা ভার বহন করে নিচ্ছে। আর ৫০ ভাগ তো তা পারছেই না। অতএব দেশের প্রায় অর্ধক জনশক্তিকে চিকিতসার বাহিরে রেখে চহিদার চেয়ে যোগানের কথাটা বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কি বলি?
এই তরুণ ডাক্তার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, জীবনের নানা মঞ্চে মেধাবী হিসেবে মূল্যায়িত হওয়া, টিউশনি থেকে শুরু করে আত্মীয় মহলে দাম পাওয়া এই তরুণের এই চলমান বাংলাদেশের বাজারে কোনো দাম নেই। ক্লিনিকের মেট্রিক পাশ ম্যানেজার থেকে শুরু করে কিংবদন্তীতুল্য প্রফেসর, সবার চোখে সে তুচ্ছ।এই তুচ্ছতার অনুভূতি বুকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সে ক্ষতবিক্ষত হয়, এই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয় আর এই অনুভূতিগুলোকে সে উগরে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।
সব মেধাবীরা নিশ্চয়ই ডাক্তার হয় না, আর সব ডাক্তারই নিশ্চয়ই মেধাবী নয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনো মেধাবী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ডাক্তার হন। এই মেধাবীদের তারুণ্যের সুন্দর সময়গুলো কুরে কুরে কেটে খাচ্ছে বিষাক্ত সরীসৃপের মতো কুটিল হতাশা আর ব্যর্থতার অনুভূতি। মেধা অনেকটা জেনেটিক্যাল হলেও এটা চর্চা ছাড়া টিকে থাকেনা। হতাশা এবং ব্যর্থতার অনুভূতি যাদের সারাক্ষণ কুরে কুরে খায়, মেধা তাদের মধ্যে বেশিদিন বসত গেড়ে থাকে না। এভাবেই বাংলাদেশের মেধার একটা বিরাট অংশ অপচয় হয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমাদের মেডিকেল পড়ুয়া তারুণ্যের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করলেই এই হতাশা আর ব্যর্থতাকে দূরে ছুড়ে ফেলা যায়। সন্দেহ নেই, এরকম হতাশার পরিস্থিতির মাঝেও সবচেয়ে মেধাবীরা এগিয়ে যাবে এবং চিকিৎসাবিদ্যার চর্চার মাধ্যমেই একটা ভাল অবস্থানে চলে যাবে। কিন্তু গাণিতিক হিসেবের কারণেই একটা বিরাট অংশ চিকিৎসা পেশায় সাফল্য লাভ করতে পারবে না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হতাশার গল্প না ছড়িয়ে তরুণ চিকিৎসকদের একটা অংশের নিজ পেশার ব্যর্থ অহমিকায় না ভুগে পেশা পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়া উচিৎ।
টিকাঃ আমি বিশ্বাস করি তরুণ ডাক্তারদের মাঝে একটা হতাশা আর গ্লানী কাজ করছে! কিন্তু কেন? সরকারি টাকায় হউক কিংবা অভিভাবকের পয়সায় আপনি লেখাপড়া করেছেন। ডিগ্রি কমপ্লিট করে ভাবছেন এখন সরকার আমাকে একটা চাকুরি দিবে! চাকুরি না পেলে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবেন! এটাই কি একমাত্র সমাধান? লেখাপড়া করার উদ্দেশ্য কি? অজানাকে জানা। নিজেকে পরিচালিত করা। আগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পারদরশি হওয়া। যোগ্যতাকে সমৃদ্ধ করে নিজে উপকৃত হওয়া অন্যের উপকার করা। ডাক্তার হিসাবে আপনাদের করার অনেক কিছু আছে। যে দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ জনগোষ্ঠী এখনো সুকিতসা থেকে বহু দূরে সেই জাতির জন্য আপনার করার কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। সরকারের হাতের দিকে না চেয়ে ক্রিয়েটিভ মনোভাব নিয়ে মানব কল্যাণে আত্মনিয়োগ করুন। আপনারে মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সুকিতসা পৌছানোর প্লান হাতে নিন।
মেডিকেলের পাশাপাশি সারা দেশের সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে একটা বিশাল সংখ্যক প্রকৌশলীও বের হন। এরা যে নিজ পেশার চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশে খুব ভালো অবস্থায় আছে তা কিন্তু না। এদের সবচেয়ে মেধাবী ও চতুর অংশটি প্রথম সুযোগেই বরফের দেশে চলে গেছে। বাকিদের অধিকাংশই সমাজের মেইনস্ট্রিম অন্যান্য পেশায় চলে গেছে। এদের এই স্মার্ট মুভকে আমি সম্মান করি। প্রতিনিয়ত নানারকম কাদুঁনি না গেয়ে, নিজেদের জীবনকে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিয়েছে।
চিকিৎসাবিদ্যায় পড়ালেখা শেষ করা তরুণদের মধ্যে অনেকেরই দেখি এই পেশার প্রতি খুব বেশী ভালোবাসা নাই। অনেকেই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে মানুষের সেবার নামে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত আছেন।এভাবে জীবন যাপন করা যায় না।
তরুণ চিকিৎসকদের উচিত,যাদের এই পেশার প্রতি সন্মানবোধ আছে, যারা এই পেশায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের এই পেশায় থাকা। আর এই পেশার প্রতি খুব বেশি প্যাশন না থাকলে, শুধু শুধু ব্যর্থ দৌড়ের চেষ্টা না করা। আপনি যদি মেধাবী হয়ে থাকেন, তবে চেষ্টা করলে যে কোনো পেশায় আপনি ভালো করতে পারবেন।
একজন সফল চিকিৎসকের চাইতে একজন সফল ব্যবসায়ী, একজন সফল আমলা, একজন সফল সাহিত্যিকের জীবন কম বর্ণময় নয়। জীবন অনেক বিশাল, অনেক চমৎকার। সাদা এপ্রোন আর স্টেথো ছাড়াও একজন মেধাবী নিজের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারেন। শুধু শুধু পেশাগত অহমিকা আর সমাজের চাপের কারণে ব্যর্থ জীবন অতিবাহিত করার কোনো মানে হয় না।
টিকাঃ শরিফ উদ্দিন সাহেবের শেষ কটি লাইন আমার খুব ভাল লেগেছে। একজন শিক্ষীত মেধাবী হলে সে যে কোন কাজে সফলতা নিয়ে আসতে পারে। ডক্টর মহাথির মোহাম্মাদ চিকিতসক হয়েও রাজনীতিতে বেশ ভাল করেছেন। জ্ঞানের দরজা যখন খোলে যায় তখন আপন চিন্তায় ঘর সংসার সমাজকে সাজানোর পরিকল্পনা নিতে কোন অসুবিধা থাকবে না ইনশা আল্লাহ।
আফসোসের বিষয় হলো বড় বড় ডাক্তার যারা তারা বড় বড় পদ দখল করে জনমের ধন কামাইতে ব্যস্ত। আমাদের সিলেটে একেকজন সাধারণ ডাক্তারের গড় আয় দিন প্রতি নুন্যতম ৫০ হাজার টাকা। সামান্য অসাধারণ হলে দিনপ্রতি দুই লক্ষ টাকা। ভাল পরিচিত নামকরা ডাক্তারের দিনপ্রতি আয় তিন থেকে চার লক্ষের কাছাকাছি। তাদের ব্যবহার শোনলে আপনি আঁতকে উঠবেন। গরু ছাগলের মত আচরণ। ডাক্তার মানেই কসাই একথা এখন সমাজে বেশ চাউর। তাহলে আমাদের এনালাইসেস মতে তো দেশে ডাক্তার সংকট চলছে। মানুষ পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরছে ভাল চিকিতসা পাচ্ছেনা। একেকজন ডাক্তারের অমানবিক কাহিনী শোনলে চোখের পানি চলে আসে। মনে করা হয় বাংলাদেশের জনগণ ডাক্তারদের কাছে প্রায় জিম্মি। এই জিম্মিা দশা থেকে কে জাতিকে উদ্ধার করবে তাহলে?
একটি জনকল্যাণ মূখী সরকারের মূল ভিত্তি হলো জনগণনের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে ভাবা। প্রশ্ন হলো আমাদের সরকারগুলো কি ঠিক সেভাবে ভাবে? ডাক্তার নামক কসাইদের লাগাম সরকার ছাড়া কে ধরবে? শুণ্যস্থান কে পুরণ করে দিবে? ৪৫৬২ টি ইউনিওনের গড় বসতি প্রায় ৪০ হাজার করে। সেখানে প্রতি ইউনিয়নে নুন্যতম দশজন করে সাধারণ প্রাক্টিশিয়ানের দরকার আছে। ৪৫৬২০ ডাক্তার সরকারি ভাবে প্রতিটি ইউনিওন ভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারে। বিভিন্ন শহুরে হাসপাতাল প্রাইভেট হাসপাতাল তো এই হিসাবের বাহিরে। আমাদের ধারণা মতে বর্তমান চাহিদা মোতাবিক বাংলাদেশে প্রায় দু’লক্ষ অভিজ্ঞ ডাক্তারের খুব প্রয়োজন। তাই চাহিদা মোতাবিক যোগানের চেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে কথাটা ঠিকনা। মূল কথা হলো ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনা। তাছাড়া গোটা বিশ্বে ডাক্তারদের প্রচুর ডিমান্ড আছে। আমাদের চিকিতসা ইন্ডাস্ট্রি আরো সমৃদ্ধ হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চাহিদা মেটাতেও আমরা সক্ষম হবো বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
লেখক: ডা. শরীফ উদ্দিন, সার্জারি বিভাগে উচ্চতর প্রশিক্ষণরত
টিকা লিখেছেন: খতিব তাজুল ইসলাম