সৈয়দ শামছুল হুদা ::
আজ অমর একুশ। ভাষার মাস হিসেবে আমাদের কাছে অনেক সম্মানিত।জাতীয় ভাষা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শহীদ আ.জব্বার, রফিক আর বরকতদের বরকতময় দিবস। আমরা এ দিবসকে স্মরণ করে অনেক কিছুই করি। প্রভাতফেরি থেকে শুরু করে নানা আয়োজনে মেতে উঠে।
কিন্তু আমার কাছে মনে হয় বিষয়টা আসলে এমন নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবকিছু নিয়েই যেমন বিভক্তি, তেমনি ভাষা দিবসের মাজেযা নিয়েও কথা আছে। পাকিস্তান আমলে যখন রাষ্ট্রের ভেতর থেকে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা যাচ্ছিল না, তখন কারো কারো কাছে ভাষা ছিল তখনকার শাসকদের বিব্রত করার একটি অন্যতম হাতিয়ার।
ভাষা যেহেতু একটি অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এটা নিয়ে খুব সহজেই তৎকালীন সরকারকে ঘায়েল করা ছিল খুব সহজ। ভাষা বিষয়ক আন্দোলন আর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দুটির ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস আছে। ১৯০৫সালে যখন বঙ্গভঙ্গ হয় তখন এদেশের কতিপয় জমিদার রাজপথে নেমে আসে। বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ কোন ভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। তখন বাহ্যিকভাবে মনে করা হতো, বঙ্গের প্রতি কী অপরিসীম প্রেম তাদের? কী সীমাহীন ভালোবাসা তাদের? একটি বিশেষ গোষ্ঠী সেদিন বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের কষ্ট সইতে না পেরে রচনা করেন আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি কবিতা।তাদের আন্দোলনের কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন রহিত করতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার।
বঙ্গভঙ্গ আইন দ্বারা বাংলার বঞ্চিত, অধিকারহারা কৃষককূলের উপকার হচ্ছিল, বাংলার রাজধানী ঢাকা জেগে উঠছিল। কিন্তু এটা সইছিল না ঠাকুর বাবুদের। তারা বাংলা প্রেমের দোহায় দিয়ে রাজপথে নেমে এলেন। তাদের মিত্র ইংরেজকে বাধ্য করলেন এই আইন বাতিল করতে। বাহ্যিকভাবে আন্দোলন মহৎ হলেও উদ্দেশ্য ছিল খারাপ। বাংলার মুসলমানদের উত্থানকে কোনভাবেই সইতে পারে নাই তৎকালীন হিন্দু জমিদারেরা। বাংলার কৃষককূলের সম্পদ লুটেরা। ঢাকা রাজধানী হয়ে এ অঞ্চল জেগে উঠলে কলকাতার দাদাগিরি যে থাকে না।
সেই দাদারাই কিন্তু ৪৭সালে বাংলাকে ভাগ করেছে। তখন আর বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ হওয়ার ব্যথায় তাদের অন্তর একটুও কেঁপে উঠেনি। বরং তারা দিল্লীর আনুগত্য তথা গোলামীকেই পরম আরাধ্য হিসেবে মেনে নিয়েছিল। সেদিন যদি তারা ঢাকার সাথে আসতো, তাহলে আজ দুই বাংলা মিলে সত্যিকার বৃহত্তম বাংলা গঠন করা সম্ভব হতো। দিল্লীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বুক উঁচু করে টিকে থাকা যেতো। কিন্তু তারা মুসলমানদের কোন রকম সুযোগ দিতে রাজি হলো না। ৪৭সালের সেই পরাজিত শক্তিটা যখন বাংলায় ভাষা নিয়ে দুই পাকিস্তানের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলো, তখন আবার তারা ভাষাপ্রেম তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলো।
ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী প্রতিষ্ঠান তমুদ্দুন মজলিস। ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু কেউ কেউ চেয়েছিলেন তৎকালীণ সরকারকে কীভাবে ভেঙ্গে দেওয়া যায়, কীভাবে রাষ্ট্রকে তছনছ করে দেওয়া যায়, তার বীজ বুনতে। আর সে জন্যই দেখা যায়,কেউ ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সেক্যুলার তত্ত্ব নিয়ে আসতে। ভাষাকে ধর্ম থেকে মুক্ত করতে। বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চাকে নিরুৎসাহিত করতে। আর এ কারণেই আজ একুশের বইমেলায় ধর্মীয় প্রকাশনা নিষিদ্ধ। এরা সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা সাধনের প্রেমিকও নয়। তাদের উদ্দেশ্য অন্য। যে কোন মূল্যে ধর্ম ঠেকাও। ইসলাম ঠেকাও।
ইসলাম কোন ভাষাকেই অবহেলা করে না। সকল ভাষার মানুষের মধ্যেই ইসলাম অনুসারী আছে। সকল ভাষাতেই বিশ্বে কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক রচনা তৈরী হচ্ছে। সকল ভাষাই আল্লাহর দান। ভাষার ভিন্নতা আল্লাহর অপার শক্তি প্রকাশের অন্যতম নিদর্শন। এক জিহ্বা দিয়ে শত ভাষা উচ্চারণ করা যায়। কোন ভাষাই ইসলাম বিরোধী নয়। তবে যে সকল ভাষায় কুরআন ও হাদীসের চর্চা বেশি হয়েছে সে সকল ভাষার প্রতি প্রকৃত মুসলমানদের একটু দুর্বলতা আছে। এর বেশি কিছু নয়।
একুশ নিয়ে কেউ কেউ ভিন্ন আঙ্গিকে রাজনীতি করতে চায়। আজ যারা একুশের প্রতি প্রেম দেখায়, তারা হিন্দীর প্রতি আসক্ত। বাংলাদেশে হিন্দীকে জনপ্রিয় করে তুলতে অনেক কিছুই করা হচ্ছে। একটি বিশেষগোষ্ঠী সবসময় চেষ্টা করে কী করে মুসলমানদের ঠকানো যায়, ঠেকিয়ে রাখা যায়। একুশের বইমেলায় সৃজনশীলতার দোহাই ইসলাম প্রবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। আর সে জন্যই বলছি- একুশ মানেই বাংলা প্রেম নয়। আজ দেশে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় চর্চা দুর্বল হয়ে উঠছে। দিনদিন বাংলা ভাষা চর্চার মান নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলা ভাষায় ঠিকমতো কোন গবেষণাই হয় না। বিচারবিভাগে এখনো চর্চা পিছিয়ে।
শুধু ভাষার জন্য যারা সেদিন প্রাণ দিয়েছিল তাদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আর যারা এর নেপথ্যে অন্য উদ্দেশ্য হাসিলের চিন্তায় বিভোর ছিল, এখনো যারা ইসলাম ও মুসলমানকে ভাষার সাথে বন্ধুত্ব করাকে পছন্দ করে না, তাদের প্রতি ঘৃণা। ধিক্কার।