সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
একালের ওয়াজ
এখন ওয়াজের মৌসুম। গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দরে মাইক লাগিয়ে চলছে সুরে সুরে হেদায়ত বিলানো। বক্তা ছুটছেন টাকার পেছনে। জনতা দৌড়াচ্ছে কোকিলকণ্ঠী গায়ক-নায়ক বক্তার পেছনে। কার চেয়ে কার কণ্ঠে বেশি সুর, কার অঙ্গভঙ্গি ভাল। কে ভাল হাসাতে পারেন- এই হল আজকালের বক্তাদের কোয়ালিটি। ভাড়াটে কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের এক নতুন ফেৎনা চলছে আজ সর্বত্র। গতকাল অনলাইনে ভাইরাল হওয়া এক বাজারি বক্তাকে পাবলিকের গনধোলাই দেখলাম। অগ্রিম বড় অংকের টাকা নিয়ে ওয়াজে আসেন নি আবার টাকাও ফেরৎ দেন নি। যুবক ছেলেরা পুরো একদিন পাহারা দিয়ে পিছু পিছু ঘুরে তাকে ধরেছে। এর মাঝে আছর, মাগরিব, এশার কোন নামাযই ‘দেশসেরা বক্তার’ পড়ার মতো সময় হয় নি। এই যাদের হেদায়ত বিলানো আর এক রাতে লাখ টাকে কামানোর নষ্ট দান্ধা, তাদের বিরোদ্ধে এখনই সচেতনতা তৈরি করা সবার জরুরী। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রকে এই বাজারি ভাড়াটে বক্তাদের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
কিছুদিন আগে আমাদের বাজারে মসজিদের পাশে একলোক গান গেয়ে পয়সা নিচ্ছিল। পাশ দিয়ে আমি আর আব্বা যাচ্ছিলাম। আব্বাকে বললাম, লোকটি গান গেয়ে পয়সা নিচ্ছে, সবাই দেখেও নিষেধ করছে না। উত্তরে আব্বা বলেন, “তাদের চেয়ে সে ভাল”। আমি বললাম, কাদের চেয়ে? বললেন, যারা আল্লাহর নাম বলে অগ্রিম কন্টাক্ট-চুক্তি করে টাকা নেন! কারণ এই ব্যক্তি দুনিয়া দেখিয়ে দুনিয়া খাচ্ছে। আর তারা আখেরাত দেখিয়ে, কুরআন-হাদীস, আল্লাহ-নবির নাম ভাঙ্গিয়ে দুনিয়া খাচ্ছে।
স্বভাবত প্রশ্ন জাগে, দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের দৈনিক বেতন-ভাতা কত? একজন মানুষের দৈনিক পারিবারিক বা সাংসারিক খরচ কত? আমাদের বাড়ির পাশে এক মাহফিলে এক চুক্তিবাদি বক্তাকে দু’ঘণ্টার জন্য ৬০হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে এসেছেন। বাকি ৪০হাজার দিবেন আসার পর। সেদিন তার আরো ৩টি মাহফিল আছে। প্রতি রাতে তার আয়, ৩লাখ টাকা। ভাবতে পারছেন বিষয়টি। পৃথিবীর কোন দেশে কে এমন সস্তা ইনকাম করার সাধ্য রাখে! বিনাপুজিতে জনগণকে ধর্মের নামে ইমুশন করে এমন ব্যবসা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এটা কেবল নালায়েক জাতি বাঙ্গালিদের মাঝে সম্ভব।
গত বছর আমাদের এলাকায় এক যুবক বক্তাকে আনা হল হেলিকাপ্টার দিয়ে। রাত দশটায় তার হেলিকাপ্টার ল্যান্ড করল নবনির্মিত হেলিফিল্ডে। দু’ঘণ্টা বয়ান করে খাওয়া দাওয়া করে রাত্রিযাপন করলেন। বাংলাদেশে হেলিকপ্টার ভাড়া প্রতি ঘণ্টা ৬০ থেকে ১ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা, প্লাস ১৫%ট্যাক্স, প্লাস ইন্সুরেন্স। ল্যান্ড ওয়েটিং প্রতি ঘণ্টা ১০ হাজার। এতগুলো টাকা একজন বাজারি বক্তার পেছনে কোন বিবেকে ব্যয় করা হয়? কেন ঢালা হয়?
কসম করে বলতে পারি, হেদায়ত আসতে পারে না এসব নালায়েক অমানুষদের গরীবের রক্তচুষা টাকার বয়ানে। হেদায়তের বদলে আজাব আসতে পারে এ জাতির উপর। বক্তার এই বিলাসী জীবনের টাকা কিভাবে সংগৃহীত হয়? গ্রামের গরীব মানুষের কাছ থেকে চাঁদা করে বা তাকে চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয় গ্রামে থাকতে হলে। হয়তো এ্টই কায় বেচারা সন্তান-সন্ততি নিয়ে দুদিন সংসার চালাতে পারত সাচ্ছন্দ্যে। দু’বেলা পেটভরে খেতে পারত। গ্রামে তাফসির হবে ,তার উপর অর্পিত চাঁদা; গ্রামে থাকলে তাকে ঋণ, মাজন বা সুদি করে হলেও দিতে হবে। এটাই এখন গ্রামের পর গ্রামে তাফসিরের কন্ডিশন। গ্রামে গ্রামে প্রতিযোগিতা। কোন গ্রাম থেকে কোন গ্রাম বড় বক্তা আনবে, বেশি টাকা দিয়ে আনবে, কার মাহফিলে লোক বেশি হবে। বক্তার পাশাপাশি হুজুগী শ্রোতাদেরও দায় কম নয়।
সেকালের ওয়াজ
কিন্তু আমরা শৈশবে দেখছি এর ভিন্ন চিত্র। সিলেট অঞ্চলে শায়খুল ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর খলিফাগণকে গ্রামগঞ্জে ওয়াজ করতে দেখেছি। আমরা ছোট থেকে বড় হওয়ার পথে আমাদের বুযুর্গদের দেখেছি মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গিয়ে ওয়াজ করতে! এমনও হয়েছে যে, ওয়াজ করে বিদায় না নিয়েই চলে গেছেন। হাদিয়া দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ তাদের অনেককে খুঁজেও পায়নি।
নিজ চোখে দেখা শৈশবের একটি ঘটনা না বললেই নয়-”দীঘলবাগ মাদরাসার মাহফিল। প্রধান অতিথি শায়খুল হাদীস হাফিজ আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরী রহ.। বয়ান শেষ করে মাদরাসার চাঁদার সময়, নিজে নগদ বড় অংকের টাকা দান করলেন দীঘলবাগ মাদরাসার জন্য। মাঠভর্তি লোকজন। একজন বক্তাকে মাদরাসার চাঁদার জন্য মাইক দিয়ে বললেন আমি জরুরতে যাব। জরুরত শেষ করে পুকুরেই অযু করলেন। তারপর আর আয়োজকরা শায়খে গহরপুরী রহ. কে খুঁজে পেল না। তিনি সবার অগোচরে মিশে গেলেন মাহফিলের ভেতর। জনতার কাতারে।
কারণ একটাই ছিল, তিনি বিদায় নিয়ে গেলে তাকে আয়োজকদের পক্ষ থেকে হাদিয়া দেয়া হবে ওয়াজের বিনিময়ে। তিনি তো ওয়াজের বিনিময় নিতে পারেন না। টাকা তাদের পেছনে ঘুরত আর তারা টাকার গন্ধ পেলে সেখান থেকে পালাতেন।”
শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালে একজন মানুষেরও হিদায়াত হবে না। অযথা টাকা খরচ ও সময় নষ্ট এবং বিনোদন বৈকি। একথা স্বীকার করতে বাধ্য, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সেই প্রভাবময় নয়। আগে বক্তাদের যেরকম ইলম ছিল, ছিল সেরকম আমলও। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতেরও কোন ঘাটতি ছিল না। এককালে মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, খতীব মাওলানা উবায়দুল হক, মাওলানা নুর উদ্দীন আহমদ শায়খে গহরপুরী, ফখরে বাঙাল মাওলানা তাজুল ইসলাম, কুতুবে দাওরান শায়খ লূৎফুর রহমান বর্ণভী, খতীবে মিল্লাত মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আবদুর রহমান শায়খে দিঘলবাগী, মাওলানা গিয়াস উদ্দিন শায়খে বালিয়া, কুতবে বাঙাল মাওলানা আমিন উদ্দিন শায়খে কাতিয়া, আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা আব্দুর রহমান শায়খে মাধবপুরী, চরমোনাই পীর সৈয়দ ইসহাক, মাওলানা ফজলুল করিম চরমোনাই, মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী, আব্দুল হক শায়খে গাজিনগরী, দরগার ইমাম আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী, শায়খে আব্দুল্লাহ হরিপুরী, মাওলানা আব্দুল গফ্ফার মামরখানী, মাওলানা মোশাহিদ আহমদ বায়ুমপুরী, মাওলানা আব্দুল হাই দিনারপুরী, (রাহিমাহুমুল্লাহ তায়ালা) প্রমুখ বুযুর্গানে দ্বীন নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে দেশের আনাচে-কানাচে সফর করতেন। হাল আমলেও এদেশে অনেক বুর্গযু আলেম আছেন, যারা এখলাসের সাথে চুক্তিছাড়া বা টাকা ছাড়া ওয়াজ করেন। কিন্তু বাণিজ্যিক বক্তাদের ডামাডোল আর প্রচারণায় তারা আজ কোণঠাসার মতোই অবস্থা বদলে হয়।
বাংলার মানুষদেরকে দ্বীনের পথে আনার জন্য খেয়ে- না খেয়ে (পারিশ্রমিক-হাদিয়া ব্যতিত) মাহফিলগুলোতে হাজির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ নসিহত পেশ করতেন। সে যুগের মাহফিলগুলোর অভূতপূর্ব প্রভাব এখনকার মাহফিলগুলোতে আর নেই। তাদের প্রতিটি কথা ধর্মপ্রাণ মুসলমান লুফে নিয়ে আমলে পরিণত করতেন। সাদামাটা সহজ সরল লৌকিকতাহীন সে ওয়াজগুলো দ্বীনি শিখার পরিবেশ ও আমলের স্পৃহার স্ফুরণ ঘটতো। তখনকার মাহফিলগুলোর বনের উপর বসে জান্নাতি আবহে মুগ্ধ হতেন শ্রোতারা। মাফলে এক নুরানী হেদায়তের রোশনী ছিল। মানুষ বুর্জুগদের মুখে যা শোনত তাই আমল করত। ওয়াজে রুহানীয়তের প্রভাব ছিল। আজও আহলুল্লাহদের মজলিসগুলো সেরকমই। কিন্তু বাজারি বক্তাদের দাপটে তাদের খোঁজ রাখেন কজনা।
আজ যখন বক্তা মাহফিলে এসে আবার সুর করে কানে হাত দিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বলেন, আমার নবী তিনদিন তিন রাত নাখেয়ে থেকেছেন, নবীর চুলায় আগুন জ্বলে নাই”। আর শ্রুতারা হু হু করে তার সাথে কাঁদেন। আর যাবার সময় ঠিকই চুলায় আগুন ধরানোর জন্য এই বক্তা অগ্রিম চুক্তি করা ৬০হাজার টাকা দুঘন্টায় নিয়ে যান, তখন এটাকে ওয়াজ না বলে নাটক বলাটাই শ্রেয়।
হযরত সিদ্দিকে আকবর রা. এর বিবি মিষ্টি খাবার জন্য কিছু চাল প্রতাদিন বাচিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। পরের মাস থেকে সিদ্দিকে আকবর এই পরিমান চাল বায়তুল মাল থেকে নেয়া বন্ধ করে দিলেন, যে এটা ছিল আমার অতিরিক্ত। কিন্তু আজ আমাদের বাজারি বক্তারা কতরিক্ত নিচ্ছেন তার কি হিসাব আছে। গতকাল আমারকাছে এক মাহফিলের চাঁদার জন্য লোকজন এল। পোষ্টারে নাম দেখি ঢাকাইয়া এমন বক্তার। যাকে আমি ঘনিষ্টভাবে চিনি। নিজে পর্দার ওয়াজ করলেও মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ে। বিলাসবহুল এ্যপাটমেন্টে থাকেন। বাসায় আছে ডিস এন্টিনা সহ সবকিছু। আমি বললাম ভাই আপনাদের টাকা দিলে গোনাহ হবে। আপনারা বক্তাকে গোনাহের জন্য টাকা দিবেন। সে ঢাকা শহরে মেয়েকে ভার্সিটিতে পড়াবে। এর চেয়ে আমার দশটি টাকা প্রতিবেশি গরীব মানুষটিকে দিলে সে বেশি উপকৃত হবে।
চুক্তিতে পুঁথিপাঠ
২৫ হাজার, ৩৫ হাজার, ৫০হাজার…
আগাম ফরম ফিলাপ, এডভান্স—বকেয়া…
গাড়ির তৈল, ড্রাইভারের হাদিয়া, পিএসের বকশিশ, বিমানের টিকেট…
দু’ঘণ্টা পুঁথি পাঠের জন্য এতটাকা খরচ করে উম্মতের কি উপকার হবে। পুথি পাঠ বললাম কারণ, তারা যে হাসি কান্নার ডায়লগ ছুড়েন মাহফিলে এসে তাকে পুথিপাঠ বলা ছাড়া আমার অন্যকোন ভাষা জানা নেই। এছাড়া এদের যে ভাব। এটা কেবল যারা মাহফিলের দাওয়াত দেন তারাই ভাল বলতে পারবেন। ফোন দিলে কয়জন পিএসের হাত ঘুরে কয়দিন পরে তাদের মোবারক জবানের সন্ধান পাওয়া যায় ভুক্তভোগীদের মুখে শুনেছি। আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের চেয়ে বহুগুণ তাদের ডিমান্ড। বড়বড় বুযুর্গ আলেমরা নিজে মোবাইল রিসিভ করলে, জনগণের সাথে সহজে সাক্ষাৎ দিলেও তাদের কত যে পাইক-পেয়াদা হিসাব রাখা দায়।
ইসলামের নাম ব্যাবহার করে এদেশে মাত্র গুটি কয়েক প্রাণীর (প্রাণী বললাম, এদের আমি মানুষ বলতে নারাজ, বড়জোর দ ‘পায়া জানোয়ার বলতে পারি) আখের ঘোছানোর কাজ চলে। এদের হাতেই সব নিয়ম, সব আইন, সব কিছু জিম্মি। টাকা ছাড়া এরা কিছুই বুঝে না। টাকায় নিজেরা যেমন যে কারো কাছে বিক্রি হয়, তেমনিভাবে দ্বীনকেও এরা যেমন পারে তেমনভাবে, যেখানে সেখানে বিক্রি করে। এরাই আমাদের আকাবির-আসলাফ আর বুযুর্গদেরর নাম ভাঙ্গিয়ে সব কুকর্ম করে থাকে। বড়দের পর্যন্ত ধোকা দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। এরা টাকার জন্য উম্মাদ। এই লুটেরাদের দল আর স্বার্থপর কথিত আল্লামা নামক ভণ্ডদের হাতে আজ আমাদের সব নেতৃত্ব বন্দি। কেবল গলা ফাটানো চিৎকার আর মাইকবাজির কারিশমায় এরা ইসলাম ও দ্বীনকে তছনছ করে দিচ্ছে।
এভাবে যারা কন্টাক্টের মাধ্যমে দরদাম করে সারাদেশে বয়ান করে বেড়ায় (বেড়ান নয়), সময় এসেছে এদেরকে চিহ্নিত করে দৌড়ান দেওয়ার। সারাদেশে অবাঞ্চিত ঘোষণা করার। আর এ জন্য সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমকে ভালোভাবেই কাজে লাগানো যায়। এখন সচেতন না হলে আগামি দিনে তাদের উৎপাত আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। ওয়াজের দাওয়াত দিলে যারাই আগাম টাকার গান গাইবে, তাদেরকে মুখের উপর বলে দিতে হবে, বাটপার রাখ তোর ওয়াজ! তারপর সবাইকে তার কথা জানিয়ে দিতে হবে। বলতে হবে অমুক তক্তা ওয়াজ করার জন্য আমাদের কাছে এতটাকা দাবি করেছেন। আমরা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। আপনারাও করুন। এভাবে শিক্ষা দিলে যদি একটু শিক্ষা হয়! খাসলত যদি একটু পালটায়।
ইমাম গাজালী রাহ. তাঁর লিখিত ‘’আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে ওয়াইজদের সম্পর্কে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া হতে আখেরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে অল্পে তুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তাগণ শ্রোতাদেরকে পরকালীনমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস করা। ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা। সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করা। এটাই হলো প্রকৃত ওয়াজ।
আর যে বক্তা এরুপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানগণ যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে। (মাজালিসূল আবরার : ৪৮২)
বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্য
১. ইলম, কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম।
২. আল্লাহর সন্তুষ্ট এখলাস ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য।
৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা।
৪.বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা।
৫. বিনা পরিশ্রমিকে বয়ান করা। বিনিময়ছাড়া দ্বীনের কথা বলবেন। (ফাতওয়ায়ে আলমগীরি ৪/১১০)
ওয়াজের উদ্দেশ্য যদি উম্মতের হেদায়াত হয়ে থাকে তাহলে ‘দরাদরি’ ‘চুক্তিবাদি’ উচিত নয়। আর যাদের ‘দরাদরি’ করা ছাড়া চলেনা তাদের ওয়াজ করা উচিত নয়। কন্টাকের এখলাসপরিপন্থী, আর এখলাস ছাড়া ওয়াজের দ্বারা শ্রোতাদের একপয়সার হেদায়াতের আশা তেমন করা যায় না। ভাড়াটে বক্তা এনে হেদায়তের পসরা সাজানোর চেয়ে এলাকার মুহাক্কিক উলামাদের দ্বারা ওয়াজ করানো সময়ের ও দ্বীনের দাবী। কওমি মাদ্রাসাগুলোতে হক্কানী,বুজুর্গ আলিমের কি অভাব আছে, যারা কওমকে বুঝিয়ে কুরআন-হাদীসের দলীলসমেত কথা বলতে পারেন? আয়োজকরা চাইলে নিজ নিজ এলাকার কওমি মাদ্রাসাগুলোর দীনদার ও মুখলিস উস্তাদগণকে দিয়ে দীনের দাওয়াতের এ মহৎ কাজটি করিয়ে নিতে পারেন। দ্বীনী মাহফিলে সুর ও রং চড়ানো বক্তৃতার প্রাধান্য থাকবে কেন। থাকবে দরদমাখা মুখলিসানা ওয়াজ। যেমন তাবলীগী ভায়েরা করে থাকেন। ইজতেমাতে বক্তার নাম বলা হয়না। চাদা কালেকশন নেই। মানুষ কি কম হয়। এখলাস হলে আল্লাহ বরকত দান করবেন। কন্টাকে, দরকষা, ভাড়াটে বক্তার কুকিলকন্ঠী পুথিপাঠে উম্মতের হেদায়ত আসতে পারে না।
কুরআন কি বলে?
কুরআনের তাফসিরে এসব দুনিয়ালোভি বাজারি বক্তাদের এনে মানুষের মাঝে কুরআনের হেদায়ত বিলানোর চেষ্টা করা হয়। এখন প্রশ্ন হল আসলে কুরআনকি এরকম বক্তাদের বয়ান শুনতে নিষেধ করেছে না উদ্বোদ্ধ করেছে?
চলুন দেখি কোরআনে কারিমে ওয়াজের মূলনীতি কী দেয়া আছে।
১) ﻳﺎﻗﻮﻡ ﻻ ﺃﺳﺄﻟﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﺃﺟﺮﺍ ﺇﻥ ﺃﺟﺮﻱ ﺇﻻ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺬﻱ ﻓﻄﺮﻧﻲ
হে জাতি! আমি তোমাদের কাছে(ওয়াজের) বিনিময় চাচ্ছি না। আমার বিনিময় আমাকে আমার আল্লাহই দেবেন। (সুরা হুদ, আয়াত-৫১)
২) ﺍﺗﺒﻌﻮﺍ ﺍﻟﻤﺮﺳﻠﻴﻦ ﺍﺗﺒﻌﻮﺍ ﻣﻦ ﻻ ﻳﺴﺄﻟﻜﻢ ﺃﺟﺮﺍ
নবীদের অনুস্মরণ করো। অনুস্মরণ করো তাদের যারা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় বা প্রতিদান চান ন(সুরা ইয়াসিন, আয়াত-২০,২১)
৩) ﻗﻞ ﻣﺎ ﺃﺳﺄﻟﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﻣﻦ ﺃﺟﺮ ﻭﻣﺎ ﺃﻧﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﻤﺘﻜﻠﻔﻴﻦ
বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না আর আমি লৌকিকতাকারীও নই। (সুরা সোয়াদ, আয়াত-৮৬)
৪) ﻗﻞ ﻣﺎ ﺳﺄﻟﺘﻜﻢ ﻣﻦ ﺃﺟﺮ ﻓﻬﻮ ﻟﻜﻢ
বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। বরং তোমরাই রাখো। (সুরা সাবা, আয়াত-৪৭)
৫) ﻗﻞ ﻣﺎ ﺃﺳﺄﻟﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﻣﻦ ﺃﺟﺮ ﺇﻻ ﻣﻦ ﺷﺎﺀ ﺃﻥ ﻳﺘﺨﺬ ﺇﻟﻰ ﺭﺑﻪ ﺳﺒﻴﻞ
বলুন, আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। যার ইচ্ছা সে তার পালনকর্তার পথ অবলম্ভন করুক। (সুরায়ে ফুরকান, আয়াত-৫৭)
৬) ﻗﻞ ﻻ ﺃﺳﺄﻟﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﺃﺟﺮﺍ ﺇﻥ ﻫﻮ ﺇﻻ ﺫﻛﺮﻯ ﻟﻠﻌﺎﻟﻤﻴﻦ
বলেদিন, আমি তোমাদের কাছে এ জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এটি সারা বিশ্বের জন্য উপদেশ মাত্র। (সুরা আনআম, আয়াত-৯০)
৭) ﻭﻣﺎ ﺃﺳﺄﻟﻜﻢ ﻋﻠﻴﻪ ﻣﻦ ﺃﺟﺮ ﺇﻥ ﺃﺟﺮﻱ ﺇﻻ ﻋﻠﻰ ﺭﺏ ﺍﻟﻌﺎﻟﻤﻴﻦ
আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না। আমার যা পাবার রাব্বুল আলামীনের কাছেই পাব। (সুরা শুয়ারা, আয়াত-১০৯)
কিন্তু যারা মুফাসসিরে কুরআন নাম ভাঙ্গিয়ে লাখ লাখ টাকা চুক্তি করে কুরআনের তাফসির করে বেড়ান, তারা এই কুরআনের মর্মবাণী থেকে আমরা কতটুকো দূরে, বিচারের ভার প্রিয় পাঠকের উপর।
আল্লাহ আমাদের ও পুরো উম্মতকে দ্বীনের সহী বুঝ দান কর। সকল নব্য ফেৎনা থেকে হেফাজত কর। আমিন।