নোয়াখালীর আদি নাম ভুলুয়া। প্রাচীনকালে ত্রিপুরা ও ভুলুয়া সমতট নামে পরিচিত ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দ্বাদশ শতকে মিথিলার রাজা আদিশুরের পুত্র বিশ্বম্ভর শুর ভুলুয়া জয় করেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলক চতুর্দশ শতকে ত্রিপুরার রাজা রত্ন মাণিক্যকে পরাজিত করলে ত্রিপুরাসহ ভুলুয়া সর্বপ্রথম মুসলিম অধিকারে আসে।
১৩৫৩ সালে সোনারগাঁর সুলতান ইলিয়াস শাহের শাসনামলে রাজা প্রতাপ মানিক্য পরাজিত হলে চট্টগ্রাম ও ভুলুয়া সোনারগাঁর অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৬৬৬ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁন পর্তুগীজ ও আরাকান দর্স্যুদের দমন করে চট্টগ্রাম জয় করেন। ফলে চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও ভুলুয়া মোগলদের অধীনে আসে। মুসলিম শাসন শুরু হওয়া মাত্রই ভুলুয়ায় ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মিত হতে থাকে।
নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ হতে ৬ মাইল উত্তরে বজরা শাহী মসজিদ মোগল আমলের অসাধারণ স্থাপত্য। ইরান হতে সুফি সাধক উমর শাহ বজরা অর্থাৎ নৌকাযোগে ইসলাম প্রচারের মানসে এখানে তশরীফ আনেন। তিনি বজরায় আগমন করেন বলে এ স্থানের নাম হয় বজরা।
১৭২২ সালে বাংলার নবাব মুরশীদ কুলী খানের আমলে সোনারগাঁও সরকারের অধীনে বজরার নাম ছিল আমুরাবাদ নোয়াবাদ ভুলুয়া পরগনা। মোগল বাদশাহ মোহাম্মদ শাহ তাঁর রাজত্বকালে (১৭১৯-৪৮) আমানুল্লাহ ও থানাউল্লাহ ভ্রাতৃদ্বয়কে বজরার জায়গীর প্রদান করেন। ১৭৪১ সালে বজরার মোগল জায়গীরদার আমানুল্লাহ ৩০ একর জমিতে এক দীঘি খনন করেন। দীঘি খননকালে একটি গম্বুজ পাওয়া যায়। এতে ধারণা করা হয় এ স্থানে আগেও মসজিদ ছিল। আমানুল্লাহ এ দীঘির পশ্চিম পার্শ্বে উঁচু ভিত্তির ওপর তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে মাঝের গম্বুজটি আকারে বেশ বড়। এ মসজিদ বজরা শাহী মসজিদ নামে পরিচিত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,আয়তাকার মসজিদটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। এর দৈর্ঘ্য ১৮.৬ ফুট ও প্রস্থ ৪.৬ ফুট অর্থাৎ ৮৫.৫৬ বর্গফুট। মসজিদের পূর্বে ৩টি, উত্তরে ও দক্ষিণে ১টি করে মোট ৫টি দরজা রয়েছে। মসজিদের পূর্বদিকের মধ্যের দরজায় একটি ফারসি ফলকে এর নির্মাণ কাল ও নির্মাতার নাম লেখা রয়েছে। মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে ৩টি মেহরাব অত্যন্ত কারুকার্যময়। মসজিদের চার কোণে ৪ টি সুন্দর মিনার আছে। মসজিদের চার পাশে ছোট ছোট সুসজ্জিত সরু মিনার রয়েছে যা এর সৌন্দর্যকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও জেলার প্রবীণদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বজরা শাহী মসজিদ নির্মাণে মোগল স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়। মসজিদের পূর্বদিকে আছে বিরাট তোরণ। তোরণের দোতলার উপরে মনোরম উঁচু মিনার রয়েছে। এর সৌন্দর্য ও অলংকরণের জন্য চীন দেশীয় গ্লাস কেটে মসজিদের গায়ে লাগানো হয়। ১৯১১ হতে ১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়কালে আমানুল্লাহর বংশধর আলী আহমদ ও মুজিব আলদিন বজরা মসজিদের অভ্যন্তর ভাগের অলংকরণ করেন। এমন কারুকার্যময় মসজিদ দিল্লী ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও নেই বলে জানান স্থানীয়রা।
উল্লেখ্য যে, বজরা শাহী মসজিদের সামান্য উত্তর পশ্চিমে মৌটুবি গ্রামে পাটোয়ারী দীঘির পূর্ব পাড়ে একটি মসজিদ রয়েছে। এর নাম মান্দারী পাটোয়ারী মসজিদ। বজরা মসজিদের অনুরূপ এ মসজিদটিও মোগল আমলে ১৮১৪-১৫ সালে নির্মিত হয়। ফারসি শিলালিপিতে লেখা রয়েছে মোহাম্মদ রিদা খান এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৯০১-০২ সালে মসজিদটিতে সংস্কার করা হয়। তিন দরজা বিশিষ্ট মসজিদের ছাদের উপর তিনটি গম্বুজ রয়েছে।