শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ১২:০০
Home / সমকালীন / টিপাইমুখ বাধ কাউকেই রেহাই দেবেনা

টিপাইমুখ বাধ কাউকেই রেহাই দেবেনা

Tipaimukh_046988

কলম হাতে তুলতেই মনের ভিতর একটি শব্দ বারবার ধ্বণিত হতে লাগলো- টিপাইমুখ! টিপাইমুখ!! হ্যাঁ, টিপাইমুখ বাঁধ, হুমকি যেখানে শানাচ্ছে বিষদাঁত। কার বিরুদ্ধে হুমকি? ভারত ও বাংলাদেশের কোটি মানুষের ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে, সুরমা-কুশিয়ারা-কালনী ও মেঘনার বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পানি-পলি, ফুল-ফল, জীব-জীবন, সেচ ও উর্বরতার বিরুদ্ধে, নদীতীরবর্তী ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের বিরুদ্ধে, এই অঞ্চলের ভৌগলিক ইকোসিষ্টেমের বিরুদ্ধে, উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের প্রকৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চিরায়ত সংস্কৃতি ও জীবনের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে। এই বাঁধ হুমকি সৃষ্টি করেছে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা অববাহিকার মিঠে পানির সুবিপুল প্রবাহের বিরুদ্ধে।

কেননা বাধ দিয়ে পানি আটকানো হলে এই নদীগুলোতে সমুদ্রের লোনা পানি চলে আসবে। ফলে মিঠে পানির মাছ ধ্বংশ হবে, কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে, জমিতে বাড়বে লবনাক্ততা, বিশুদ্ধ পানীয়জলের সংকটে পড়বে কোটি কোটি মানুষ। নিশ্চিতভাবে এই বাঁধ বাংলাদেশের জন্যে হয়ে উঠবে আরেকটি অভিশপ্ত ফারাক্কা। যা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ সহ ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিশাল অঞ্চলের পরিবেশকে শুধু ক্ষতিগ্রস্থ করবেনা, বরং অত্র অঞ্চলকে করে ছাড়বে মৃত্যুময় মরুভূমি। শত শত নদী-নালা, হাউর-বাউড়, বিল-ঝিল পরিণত হবে পানিশূন্য খালাখন্দে। বিঘিœত হবে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জলনির্ভর জেলে জীবন। দেশী-বিদেশী অসংখ্য ধরণের পাখ-পাখালী, লতা-গুল্ম, উদ্ভিদ, জলজ-স্থলজ প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল যাবে হারিয়ে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে চা শিল্প, বিপন্ন হবে বনাঞ্চল। হুঁ হুঁ করে বাড়বে পরিবেশ উদ্বাস্তুর সংখ্যা। আর যদি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় নির্মিতব্য এই বাঁধ ভূমিকম্পের ফলে ভেঙে যায়, তাহলে তো মহাসর্বনাশ!

সর্বনাশের এই শংকা এজন্যেই যে বিশ্বের সবচে’ বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ ও আশংকাযুক্ত বলয়ে অবস্থিত এই বাঁধ। সমুদ্রসমতল থেকে প্রায় ৫০০ ফুট উপরে অবস্থিত ৫০০ ফুট উচুঁ এবং ১৬০০ ফুট দীর্ঘ এই বাঁধটি যে অঞ্চলে পড়েছে, তা মূলত সুরমা গ্রুপের শিলা দ্বারা গঠিত। এর মধ্যে রয়েছে অসংখ্যভাজ ও চ্যুতি। পুরো এলাকাটিই বহু বিকশিত ভূতাত্তিক ভাঙন ও ভূগঠনিক অবিকশিত চ্যুতিতে ছেয়ে আছে। ভূতাত্তিক সাব হিমালয় জোনে অবস্থিত টারশিয়ারিং যুগের এ পার্বত্য অঞ্চলের নিকটেই ইন্ডিয়ান প্লেট ইউরোশিয়ান প্লেট এবং বার্মিজ প্লেটগুলোর মধ্যে নিরন্তর সাংঘর্ষিক প্রক্রিয়া চলমান। এই এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ব্লিন্ড ট্রাস্ট, যেগুলো থেকে ভূমিকম্পের নাভিকেন্দ্র সৃষ্টি হয়। পুরো বরাক নদীর জলনিস্কাশন অববাহিকাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চ্যুতিরেখার দ্বারা এতোটাই আকীর্ণ যে এই রেখাগুলোই বরাক ও তার উপনদীগুলোর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। টিপাইমুখ ড্যামের অক্ষটিও অবস্থিত বিপজ্জনক টাইথু চ্যুতির উপর। এই জাতীয় চ্যুতিই মূলত কাজ করে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে। এ ছাড়া ইতিহাস ও এই এলাকায় বিপজ্জনক বহু ভূমিকম্পের জানান দেয়। গত ২০০ বছরে রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার উপরে বহু ভূমিকম্প হয়েছে এ এলাকায়। টিপাইমুখের ১০০ কি.মি. ব্যাসার্ধ এলাকায় গত ১৫০ বছরে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়েছে ২৬টি। এই এলাকায় রিখটারের ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পও রয়েছে ১৮৯৭ সালে। ১৯৫৭ সনে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের উৎপত্তিকেন্দ্র ছিলো ড্যাম এলাকার একেবারে নিকটবর্তী পশ্চিম মনিপুর। ফলে এখানে ভূমিকম্প হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং শক্ত ভূমিকম্প বাধকে ভেঙে দিতে পারে। যদি তা হয়, তাহলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে। ভারতের শিলচর সহ আশপাশের সব জনপদ ৯.৮ থেকে ৩২.৮ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র সাড়ে ২৮ মাইল। সর্বনিম্ন ৫০ কি.মি. বেগে পানি নেমে এলে বাঁধ ভাঙার ১ ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে পানি চলে আসবে সিলেটের জকিগঞ্জে। দুই-তিন ঘন্টার মধ্যে সুরমা-কুশিয়ারার পাড়ে শুরু হবে মৃত্যুর তান্ডবলীলা। মৃত্যুর নগরীতে পরিণত হবে সিলেট মহানগরী। প্রাণ হারাবে লাখ লাখ মানুষ। টিপাইমুখ বাঁধের জলাধার ধারণ করবে ১৬ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি। বড় বন্যার সময় যদি বাঁধ ভাঙে, এবং পানি নেমে আসে, তাহলে কী ঘটবে, তা কল্পনাতীত। শুধু যে ভূমিকম্প এ বাঁধ ভেঙে দিতে পারে, এমন নয়। বরং এ অঞ্চলে নাগা বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা চাইছে। আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে বিদ্রোহী তৎপরতা। এদের কেউ বোমা মেরে বাধ ভেঙে দিয়ে সর্বনাশ কামনা করতে পারে।

সঙ্গতকারণেই টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে উদ্বিগ্ন এদেশের মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে জনগণ তাদের উৎকণ্ঠার কথা প্রকাশ করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা ভারত সরকারকে জানিয়েছেন। ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন- টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করবেন না। ২০১১ এর ১৩ই জানুয়ারী ঢাকার পত্রিকায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে এ ঘোষণা প্রকাশিত হয়। তারপর দেশের মানুষের উদ্বেগ কিছুটা হলেও প্রশমিত হতে পারতো। কিন্তু এই আশ্বাস থেকে জনগণ বুঝে নিলো,টিপাইমুখে একটি প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে, একথা ভারত স্বীকার করেছে। সেখানে নদীতে বাঁধ নির্মান করে পানি আটকানো হবে। একাজটাই কিন্তু বড় ক্ষতি ভাটির দেশের জন্যে। এই ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যেই মেক্সিকো আন্তর্জাতিক আদলতে মামলা দায়ের করছিলো আন্তর্জাতিক নদীর উজানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে। আদালত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ রায় প্রদান করেছিলেন। এই ক্ষতি যাতে না হয়, এজন্যে সেøাভাকিয়া ও হাঙ্গেরির মধ্যে দানিয়ুব নদীর পানি বণ্টন করে দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক আদালত। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সিন্ধু অবাহিকার পানি সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রেখেছিলো বিশ্বব্যাংক। এই ক্ষতি এড়াবার জন্যেই দেশে দেশে আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো একত্রে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঐতিহ্য রয়েছে। ইউরোপের রাইন নদী সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মান, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত। এই নদীব্যবস্থাপনার সব দেশ যুক্ত হয়ে গঠন করেছে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব রাইন রিভার ওয়াটার। যে সব অঞ্চলে আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম লংঘিত হচ্ছে সেখানে প্রবল হয়ে উঠেছে যুদ্ধের আশংকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এযরণ ওলাপ এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন বিগত শতাব্দীতে সংগঠিত যুদ্ধগুলোর পিছনে পানি সমস্যা ছিলো অন্যতম কারণ। এখনও আরব সাগর এলাকা, জর্ডান নদ, নীল নদ, টাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস এভং গঙ্গা অববাহিকায় নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিপদের জ্বালামুখ কখন জ্বলে উঠে, এই শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে। জ্বালামুখে যাতে আগুন না জ্বলে, এজন্যে ভারতের যে সব নদী একাধিক রাজ্যে প্রবাহিত, সেগুলোর ক্ষেত্রে নদীব্যবস্থাপনা কোনো রাজ্যই একা করেনা। এক্ষেত্রে যৌথতা সেখানে অপরিহার্য। এর ব্যতিক্রম হয়েছিলো বলেই কর্ণাটক ও তালিমনাড়– রাজ্য কাবেরী নদী নিয়ে যুগ যুগ ধরে সংঘাতে লিপ্ত। উভয় রাজ্যের পুলিশ বাহিনী এ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে বহুবার। এখনো বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।

টিপাইমুখ বাধ যে নদীর উপর নির্মিত হচ্ছে, সেই বরাক মনীপুর পাহাড়ে নানা ঝর্ণার মিলনস্থল থেকে উৎপন্ন হয়ে বরাক, সুরমা-কুশিয়ারা, মেঘনা প্রভৃতি নামে অভিন্ন নদীপ্রবাহ হিসেবে ৮৪৫ কি.মি. পথ অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই যাত্রাপথে ২৭৭ কি.মি. ভারত সীমান্তে এবং অবশিষ্ট ৬৬৯ কি.মি. পড়েছে বাংলাদেশে। বরাকসহ অভিন্ন নদীগুলোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার পারস্পরিক আচরণ কী হবে, তা উল্লেখ আছে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিচুক্তির মধ্যে। সেখানে স্পষ্ট লিখা আছে অভিন্ন নদীগুলোতে হস্তক্ষেপের পূর্বে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ করবে। দুই দেশের যৌথ সম্মতি ছাড়া অভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা যাবেনা। তাহলে বাংলাদেশের প্রতিবাদ সত্তেও টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে; ১৯৯৬ এর গঙ্গা পানি চুক্তির মস্ত এক ক্ষতির উপর দাঁড়িয়েই। বাংলাদেশ যতবারই এ প্রকল্পের বিষয়ে প্রতিবাদী হয়েছে ভারত আশ্বস্ত করেছে যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু তারা করবেনা। ১৯৭২ সালে বিষয়টি সরকারীভাবে আলোচনায় আসে। ২০০৩ সালে তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতির প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু করা হবে না। কোনো ব্যারাজ নির্মাণ করা হবেনা। বাংলাদেশের তখন বাঁধ সম্পর্কিত  তথ্য চাইলে ভারত বলেছিলো তথ্য দেবে। কিন্তু পরে আর দেয়নি। ২০০৫ সালে ভারতের তৎকারীন পনিসম্পদমন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাস মুন্সি বাংলাদেশে এসে পূণরায় বলেছিলেন তারা চাননা টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের জন্যে ক্ষতিকর কোনো কিছু করতে।

এ দিকে বাঁধ নির্মানের প্রক্রিয়া কিন্তু ঠিকই এগিয়ে চলছিলো। ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হয় এর জরিপ প্রক্রিয়া। ১৯৭৭ ও ৮৭ সালেও দুই দফা জরিপ করা হয়। ১৯৮৪ সালে এ প্রকল্পের জন্যে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ১ হাজার ৭৮ কোটি রুপি। ২০০৩ সালে ভারত সরকার অনুমোদন দেয় এ প্রকল্পের। পুরনো পরিকল্পনায় সংযোজিত হয় আরো বহুদিক। প্রকল্পের জন্যে তখন আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ৫১৬৩.৮৬ কোটি রুপি। ২০০৫ সালে প্রকল্পের পরিকল্পনা সম্প্রসারিত হয় আরোও। সম্ভাব্য ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় ৫৮৫৫.৮৩ কোটি রুপি। ২০০৫ সালে নেপকো প্রকল্পের জন্যে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করে এবং ২০০৬ সালের জুলাইয়ে টেন্ডারের প্রিবিট কোয়ালিফিকেশনের প্রথম ধাপ উন্মুক্ত হয়। ২০০৬ এর ১৬ ডিসেম্বর টিপাইমুখ বাহুমুখী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ভারতের কেন্দ্রীয় পাওয়ার মিনিস্টার সুশীল কুমার শিঙবে। যেদিন এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, মনিপুর সেদিন হয়ে উঠেছিলো উত্তাল। পালিত হয়েছিলো সর্বাত্মক বন্ধ। সরকারের মন্ত্রীরা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে তামেংলং জেলার থাংগলে পৌছলে প্রতিবাদী জনতা সরকারী অফিস-আদালতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তামেংলং জেলার সদর দফতরে ভাঙচুর চালায়। ২০০৬ এর ২রা ডিসেম্বর মনিপুর সফর করেন ড. মনমোহন সিং। সেদিনও বন্ধ পালিত হয়। ড. সিং প্রতিবাদীদের হুশিয়ার করে দেন এবং ঘোষণা করেন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মানে ভারত সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই বাঁধ নির্মিত হলে ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশংকায় মনিপুর ও মিজোরামের মানুষ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছে। কেননা বাঁধ নির্মিত হলে যে এলাকাগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে, এর ৯৪ শতাংশ মনিপুরে আর বাকি ৬ শতাংশ মিজোরামে পড়েছে। মনিপুর হারাবে ৪৭৬০ হেক্টর বাগান, ২০৫৩ হেক্টর ধানী জমি, ১৭৮.২১ বর্গ কি.মি. বনভূমি। আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম একত্রে হারাবে ৩১১ হাজার হেক্টর ভূমি। মনিপুরের ১৬টি গ্রাম সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে পানির নিচে। তলিয়ে যাবে উভয় রাজ্যের ৬৭টি গ্রাম। দেড় হাজারের অধিক মানুষ হারাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি ও পেশা। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবে ১৫ হাজার আদিবাসীর জীবন ও জীবিকা। আসামের কাছাড় ও করিমগঞ্জের ২০ লাখ মানুষের জীবন পড়বে হুমকির মুখে। ফলে বাধ নির্মাণ বন্ধ করার জণ্যে গণআন্দোলন ধারণ করেছে তুঙ্গরূপে। গড়ে উঠেছে সামাজিক ও বেসরকারী সংগঠনগুলোর ব্যাপক কোয়ালিশন দি এ্যাকশন কমিটি এগেইনস্ট টিপাইমুখ ড্যাম। তারা এ বাঁধকে অভিহিত করেছে জলবোমা হিসেবে, জ্ঞাপন করছে প্রবল প্রতিবাদ। এছাড়া আছে ৩০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত পিপলস এন্ড এনভায়রমেন্ট। সক্রিয় হয়ে উঠেছে কৃষক মুক্তি সংগ্রাম কমিটি, আসাম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন, সারা আসাম মনিপুরী ছাত্র সংস্থা, নাগা ছাত্র সংস্থা, আসাম গণপরিষদ, ইত্যাদি সংগঠন।

প্রতিবাদের ফলে সরকার ২০০৪ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৫টি পাবলিক হিয়ারিং এর আয়োজন করেছিলো। যেগুলোর কোনোটাই সফল হয়নি। ২০০৪ এর ৪ ডিসেম্বর মিজোরামে অনুষ্ঠিত প্রথম হিয়ারিং ব্যর্থ হয় নেপকো কর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধের ডিটেইলড প্ল্যান প্রকাশ না করা এবং প্রকল্পের এজাজমেন্ট না দেখানোর কারণে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিয়ারিং সম্পন্ন হয় ২০০৬ সালের ১৭ ও ২২ নভেম্বর তামেংলং জেলা সদরে। মোট ৩০টি গ্রামের প্রতিনিধিরা আসেন এতে অংশ নিতে। কিন্তু ১০-১২ জনকে নিয়ে সামরিক সৈন্যদের প্রহরায় রুদ্ধদার বৈঠক করে নেপকো ঘোষণা করে কোনো গ্রামপ্রধান টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে মত দেননি। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। সরকার বাধ্য হয়ে ৩১ মার্চ ২০০৮ সালে চুরাচাদপুরে ও ২৬ শে মার্চ কেইমাই গ্রামে আরো দুটি হিয়ারিং ঘোষণা করে। সেগুলোও ব্যর্থ হয়। এবং আন্দোলনকারীরা হিয়ারিংগুলোকে সরকারের সাজানো খেলা বলে অভিহিত করেন। এরপর যখন টিপাইমুখ বাঁধ এলাকায় ড্রিলিং সহ অন্যন্য নির্মাণ কাজ শুরু হয়, এর প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে একটি বিক্ষুদ্ধ সংগঠনের কর্মীরা বোমা মেরে কয়েকটি নির্মাণযন্ত্র উড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে সেখানে সেনাবাহিনীর প্রহরায় কাজ চলছে। কিন্তু বিক্ষোভ থামেনি একটি দিনের জন্যেও।

এই বিক্ষুদ্ধ মানুষগুলো কারা? এদের অনেকেই আদিবাসী, যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র, মর্যাদা ও সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এরা জন্মই গ্রহণ করেছে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতা, পার্বত্যাঞ্চলে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার কারণে নিজেদের মধ্যে জন্ম নেয়া বিভাজন ও উন্নয়নের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনামূলক নানা আচরণের মধ্যে। ফলে আদিবাসী হামাররা দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালিয়ে আসছে। হামারদের বসবাস টিপাইমুখে বেশি। এখানকার ৫৫টি গ্রামে প্রায় ২৪ হাজার আদিবাসী রয়েছে, যাদের মধ্যে হামার ছাড়াও জিলিয়াং গ্রং, গাংতে, পাইতে ভাইকে ইত্যাদি রয়েছে। এ এলাকায় রয়েছে মোট ৭টি নদী অববাহিকা। এ অঞ্চলের ৭২ ভাগ এলাকা পর্বতসঙ্কুল হওয়ায় আদিবাসীরা জুম চাষ করে। এলাকাটিতে যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্গম। এখানে কোনো সরকারী সংস্থার শাখা নেই, পাবলিক হেলথ সার্ভিস নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা, টেলিফোন ব্যবস্থা কিছুই নেই। কোনো বিদেশী পর্যটক এ এলাকায় আসতে চাইলে মুম্বাই, দিল্লী অথবা কলকাতা থেকে ছাড়পত্র আনতে হয়। ৪ জনের ১টি দলকে ট্রেভেলস এজেন্টের তত্তাবধানে থাকতে হবে। সর্বোচ্চ দশদিন থাকা যাবে, এর বেশি নয়। এ নিয়ম প্রযোজ্য বিদেশে জন্ম নেয়া মনিপুরীদের জন্যেও। ফলে এই এলাকা অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ উভয় অর্থে বঞ্চনা ও প্রান্তিকতার মধ্যে রয়েছে। এই বঞ্চনাবোধ থেকে জন্ম নিয়েছে স্বাধীন মনিপুর প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যা সশস্ত্র রূপ ধারণ করেছে অনেক আগ থেকেই।

এখন যদি টিপাইমুখ বাঁধের জলধার এই এলাকাকে ডুবিয়ে দেয়, তাহলে ভারতের জন্যে উদ্বেগজনক একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যা আমাদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে ১৯৫৭-৬৩ কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করার পর। এই প্রকল্প নির্মানের ফলে ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে ডুবে যায়, ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ওই অঞ্চলের মানুষ জমি হারায়, চাকমা রাজার প্রাসাদ ডুবে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৮ থেকে ১০ লাখ লোক। সেই থেকে জন্ম নেয়া চাকমা বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত এখন বাংলাদেশের অখন্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করে চলছে। যদিও কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্থদের অনেককেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সমস্যা যেটা হবার, হয়ে গেছে। কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট। অপরদিকে টিপাইমুখ জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হবে ১৫০০ মেগাওয়াট। এতো বড়ো প্রাপ্তির কাছে ভারত হয়তো এর ক্ষতিকে ছোট হিসেবে দেখছে। কিন্তু এই ছোট ক্ষতিটি যখন বিষ ছড়াবে, নাগা বিদ্রোহের সাথে যুক্ত হবে, উলফাদের সাথে কৌশলগত একাত্মতায় যুক্ত হবে, তখন কিন্তু আসাম-মিজোরাম মনিপুর মিলে এ অঞ্চলটি ভারতের জন্যে আরেকটি অগ্নিময় সেভেন সিস্টার হয়ে উঠতে পারে।

অন্তত এ বিষয়টার প্রতি খেয়াল করলে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে পারে। বর্তমান বিশ্বে ড্যাম নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের রীতি বন্ধ হয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ৫০০টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প অচল করে দিয়েছে। কেননা নদীতে বাঁধ নির্মান করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেলেও এর উজান ও ভাটি অঞ্চলের জনবসতি, প্রাণ ও পরিবেশ রেহাই পায়না ক্ষতি থেকে। নিশ্চয়ই বিদ্যুতের চেয়ে মানুষ ও পরিবেশের মূল্য বেশি। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে হয়তো নিরাপদ হবে বাংলাদেশ ও ভারতের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যত।


About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

প্যান্ডেলের বাইরে সাউন্ড ব্যবহার করা নাজায়েয!

মুহিউদ্দীন কাসেমী: কিছুদিন আগে কী এক কাজে যেন ঢাকায় গেলাম। এশার সময় ট্রেনে ফিরলাম। স্টেশনে ...