কুতায়বা আহসান
পূর্ব প্রকাশের পর
কুকোর শাসনকর্তা ইবনে কাজির পুত্র এবং তার সেনাদলের প্রধান দুই জেনারেল শহরপ্রাচীরের একটি চৌকিঘরে বসে রয়েছেন। তাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলেন। তাঁদের প্রত্যকের চেহারায়ই গভীর চিন্তার ছাপ। উবাদা বিন তামাম হুসাইন এবং আলকামাকে খেতাব করে বলছিলেন:
আমার বন্ধুগণ! কুকোর পার্শ্ববর্তী বাকদুরার মাঠে আমাদের পরাজয় থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ। আমাদের উচিৎ স্পেনীয়দের সহায়তায় লড়াই পরিত্যাগ করে বারবারুসার সাথে ঐক্য গড়ে তুলা। উচিৎ স্পেনীয়দের আমাদের সরজমিন থেকে তাড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে শামিল হওয়া।
আমারতো নিজেকে ধীক্কার দিতে মনে চাইছে। কেননা আমি একজন মুসলমান হয়ে মুসলমানদের শত্রুর হাত মজবুত করার লক্ষে আমারই মুসলমান ভাইয়ের সাথে লড়ে যাচ্ছি। অথচ আমাদের প্রতিপক্ষ বারবারুসা আলমে ইসলামের এমন এক নিঃস্বার্থ মহান খাদেম যিনি ইসলামের জন্য নিজের জীবন যৌবনকে ওয়াকফ করে দিয়েছেন।
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মুসলমানদের কেন্দ্রীয় সুলতান সুলায়মানও তাঁর পক্ষে। ইতোপূর্বে তাঁর পিতা সুলতান সেলিমও ছিলেন তাঁর পক্ষে। এ হিসেবে বারবারুসার বিরুদ্ধে দাড়ানোর অর্থ দাঁড়াচ্ছে আলমে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। একজন মুসলমানের জন্য এরচেয়ে দুর্ভাগ্য, এর চেয়ে জঘন্য অপরাধ, এরচেয়ে লজ্জাজনক কাজ আর কিছু হতে পারে না।
এই পর্যন্ত বলে উবাদা একটু বিরতী নিলেন, এরপর হুসাইনকে সম্বোধন করে বললেন: ইবনে কাজির পুত্র! মনে কিছু নেবেন না। আমি আর ভাই আলকামা আলমে ইসলামের বৃহত্তর ঐক্যের পক্ষে। আপনার পিতা মুসলমানদের প্রকাশ্য শত্রু মুনকিডের অন্যায় খায়েশ বাস্তবায়নের আড়কাটি হয়ে ভূয়া সম্মান এবং ফালতু খ্যাতি আর মিথ্যে প্রতিপত্তির স্বপ্ন দেখছেন।
এই হিস্পানীয় শক্তি আমাদেরকে তাদের সাথে জড়িয়ে মূলত আমাদেরকে লোহার পিঞ্জিরায় বন্দী করে নিতে চাইছে। আমাদের মৃত্যুর বর্শা তৈরি করছে। এরা আমাদের আত্মা ও কায়ার অংশ মিল্লাতে মুসলিমা থেকে আমাদেরকে জুদা করে ফেলতে চাইছে। মুসলিম জাতিসত্তার প্রতি আমাদের জযবা, আমাদের চাওয়া আর আমাদের আত্মার প্রশান্তিকে ওরা হিংসার আগুনে পুড়ে ফেলতে চায়।
ভাই হুসাইন! ইতোপূর্বেও আমরা উভয়ে তোমাকে বলেছিলাম তুমি তোমার পিতাকে বুঝাও। তুমি বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছো, তিনিও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে। সৈন্যদের মনের খবর কিছুটা আমরা জানি। আমার ভয় হচ্ছে তিনি এভাবে চলতে থাকলে হয়ত অচিরেই আমাদেরকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে।
ইবনে কাজির সাহেবজাদা! শুনুন! আমরা খতম হয়ে যেতে পারি কিন্তু মুসলিম জাতিসত্তার সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক খতম হবার নয়। খাইরুদ্দীন বারবারুসা আর তাঁর সালাররা কেবল আফ্রিকার স্থলভাগে নয় বরং সাগরেও মিল্লাতের রাহনুমা, রাহবার, কমান্ডার এবং সেনাপতি হিসেবে বিবেচিত। তিনি অসহায় মুসলিম উম্মাহর অভিভাবক, তাদের ইজ্জত আব্রুর উত্তম নিগাহবান।
ইবনে কাজির বেটা! বারবারুসা যখন কুকোর পার্শ্ববর্তী বাকদুরার মাঠে আমাদের প্রতিপক্ষে আগুনের লাভা উদ্গীরণ করছিলেন। আমাদেরকে দলিত মথিত করছিলেন, কসম আল্লাহর; তখনও আমি নিজের মধ্যে আনন্দ অনুভব করছিলাম। আমার অন্তর থেকে তখন অজানা এক আবেগ বেরিয়ে আসছিল। আমার ভেতরে প্রশান্তির অচেনা এক অনুভূতি জেগে উঠেছিল। আমার মন চাইছিল ইবনে কাজির পক্ষ থেকে সেনাপতিত্বের দায়িত্ব পরিত্যাগ করে বারবারুসার সাধারণ এক সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। আমার মন চাইছিল আমার তলোয়ারটা তাঁর পায়ের কাছে রেখে বলি— আমীর! আমি আমরণ আপনার সাথে আছি। আপনিই আমার রাহবার, আপনিই আমার মানযিলে মাকসূদের রাহনুমা।
আফসুস! আমি আমার হাত পা, আমার শরীরটাকে দীলের অনুভূতির অনুগামী বানাতে পারিনি।
এ পর্যন্ত বলে উবাদা থেমে গেলেন। আবেগে তাঁর চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল। তাঁর মাথা নিচের দিকে ঝুকে পড়েছিল। উবাদার এ আবেগ হুসাইন এবং আলকামাকেও স্পর্শ করেছিল। তারাও উদাস এবং বিষন্ন হয়ে উঠেছিলেন।
নীরব কয়েক মুহূর্ত কেটে যাবার পর আলকামাও হুসাইনকে খেতাব করে বলে উঠলেন: বন্ধু হুসাইন শুনো! উবাদার কথাগুলো আমার দীলের আওয়াজ। আমার অনুভবের ভাষান্তর। আমার আবেগের প্রতিবিম্ব। আমরা নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তিতে লিপ্ত হয়ে কেবল স্পেনীয়দের হাতকে শক্তিশালী করে যাচ্ছি। এটা অন্তহীন ঘৃণিত অপকর্ম। এ শক্তিশালী হাতগুলোই কিন্তু একদিন আমাদের টুটি চেপে ধরবে।
বাকদুরার মাঠে খাইরুদ্দীন আমাদেরকে পরাজিত করেছেন। আমাদের কেন্দ্রীয় শহর কুকোতে তিনি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছেন। আমরা আত্মরক্ষার তাগিদে বূনায় এসে অবরুদ্ধ হয়ে আছি। কিন্তু স্মরণ রাখবেন আমরা যেভাবে কুকো শহরের নিরাপত্তা ধরে রাখতে পারিনি বূনাও আমাদের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি হবার উপযুক্ততা রাখে না। আমি স্পষ্টভাষায় আপনাকে জানাচ্ছি, আপনি আপনার পিতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আত্মঘাতি এ লড়াই থেকে যেন নিজেকে আলাদা করে নেন। অন্যতায় তার এ জেদের মোকাবেলায় আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হবো। আর এই বিদ্রোহ ঘোষণাকে আমরা অপরাধ মনে করবো না। মনে করবো আলমে ইসলামের জন্য আমাদের এ বিদ্রোহ ঘোষণা পূন্যের কাজ।
ভাই হুসাইন! আপনার আব্বাকে বলবেন, তিনি যেন এটা মনে না করেন যে, কুকো শহর দখল করে খাইরুদ্দীন সেখানে বেকার পড়ে থাকবেন। আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি— সপ্তাহ এবং মাস নয় বরং অল্প ক’দিনের ভেতরেই শুনা যাবে তিনি বূনা আক্রমণের জন্য কুকো থেকে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছেন। আপনার পিতা যতই হামছায়া শক্তি গুলোর দিকে কাসেদ প্রেরণ করুন না কেন, যতই তারা তাকে সেনা ও অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য পাঠাক না কেন, আমার বিশ্বাস আর অভিজ্ঞতা বলছে যদি বূনা শহরের পাশের মাঠে যুদ্ধ বাধে তাহলে পরিণতিটা বাকদুরার মাঠের পরিণতির চে’ ভিন্নতর হবে না। বরং এখানকার পরিণাম ওখানকার পরিণামের চে’ আরো করুণ হতে পারে।
একটা একটু থামলেন এরপর কথার ধারা অব্যাহত রেখে বললেন:
ভাই হুসাইন! আমি আরো শুনতে পেয়েছি বাকদুরার পরাজয়ের সংবাদ শুনে স্পেন সম্রাট চার্লস মুনকিডের সহায়তায় সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য প্রেরণ করছে। সে বাহিনীর সাথে যথেষ্টসংখ্যক সুন্দরী ললনাদেরও পাঠাচ্ছে। এরা নাকি তার সৈন্যদেরকে মাঠে জমে থেকে লড়াইয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করে যাবে।
অপরদিকে সুলতান সুলায়মানও বাকদুরার মাঠে খাইরুদ্দীনের কৃতিত্ব দেখে যারপরনাই আনন্দিত। তিনি খাইরুদ্দীনের হাত আরো শক্তিশালী করার জন্য তুর্কি সৈন্য ও অস্ত্র সাহায্য প্রেরণ করছেন। আমার বিশ্বাস সুলতানের সাহায্য পেয়ে বারবারুসা আরো দুর্বার ও দুর্জয় হয়ে উঠবেন। স্পেনের মূল বাহিনীও যদি এখানে ছুটে আসে তবুও তারা বারবারুসাকে পরাজিত করতে পারবে না।
আলকামা তাঁর কথা বলে থামতেই ইবনে কাজির ছেলে হুসাইন অত্যন্ত ব্যথিত ও বিষন্ন কন্ঠে বলতে শুরু করলেন: আমার প্রিয় সাথীরা! আমি আরেকবার পিতাকে বুঝাবার চেষ্টা করবো। তবে লশকরের মধ্যে যে সব জওয়ান আমাদের চিন্তাধারার সাথে একমত তাদেরকে সংগঠিত করার কাজ দ্রুত চালিয়ে যেতে হবে। সেটা আরো জোরদার করে তুলতে হবে। পিতার সাথে আলোচনার পরও যদি দেখি অবস্থা যেই সেই, তাহলে আমি অঙ্গিকার করছি আপনাদের সাথে মিলে আমি পিতাকে শাসন ক্ষমতা থেকে হঠানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। এরপর নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করে আফ্রিকাতে যতো মুসলিম শক্তি রয়েছে তাদেরকে স্পেনীয়দের পক্ষ থেকে সরিয়ে বারবারুসার পক্ষে নিয়ে আসার জন্য প্রয়াস চালাব।
হুসাইন কথা বলে থামার পর উবাদা আর আলকামা নীরব হয়ে গেলেন। উভয়ে মাথা নুইয়ে অনেক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলেন, বেশ কিছুক্ষণ পর উবাদা মাথা উঠিয়ে হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে সিদ্ধান্তকর জবাব দিয়ে বললেন:
হুসাইন আমরা তোমার পিতাকে অনেক বরদাশত করেছি। কিন্তু দেখতে পেয়েছি তিনি আফ্রিকান মুসলমানদের ঐক্যের ঘোর বিরোধী। তিনি মুসলিম স্বার্থে আঘাত হানতে যেমন আরাম বোধ করেন তেমনি গৌরববোধও করেন। তিনি একটা মিথ্যে বিশ্বাসের চোরাবালিতে আটকা পড়ে আছেন। মনে করছেন মুনকিড যতক্ষণ তার পৃষ্ঠপোষকতায় আছে ততক্ষণ কোনো শক্তি তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।
প্রিয় ভাই! শুনো! তুমি যদি কাল আমাদের পক্ষ ত্যাগ করে তোমার পিতার পক্ষ নিতে চাও তাহলে দয়া করে আজই তুমি তার পক্ষে চলে যাও। তবে শুনে রেখো, কেবল আমি আর আলকামাই নই, বরং সেনাবাহিনীর অসংখ্য মুজাহিদ অন্তর দিয়ে তোমার পিতার সিদ্ধান্তকে ঘৃণা করে। তাদেরকে কেবল একটি ইশারা দিলেই শিখা মেলা আগুনের মতো তোমার বাবার বিরুদ্ধে জ্বলে উঠবে যে আগুন নির্বাপন করার সাধ্য তোমার পিতার নেই।
কিছু মনে করো না হুসাইন! আমরা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যদি তোমার পিতা মুসলিম স্বার্থ আর মুসলিম ঐক্যে আঘাত হানা থেকে বিরত না হন, তাহলে প্রয়োজনে তোমার পিতার মাথা কেটে নিতেও আমরা দ্বিধা করবো না।
আমাদের অন্তর যদি স্বাক্ষ্য দেয় যে, ইবনে কাজির হত্যার মধ্যেই রয়েছে আফ্রিকান মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্য তাহলে আমরা তাকে হত্যা করতে একটুও পিছপা হবো না। এবার তুমি ভালোভাবে চিন্তা ফিকির করে বলো তুমি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গ দিতে রাজি আছো কী না।
হুসাইন অনেক্ষণ ভেবে মাথা উঠিয়ে বললেন: আমার প্রিয় সাথীরা শুনো! আমি তোমাদের সাথে আছি। তবে আমার একটা আবেদন শেষ বারের মতো পিতাকে সুপথে নিয়ে আসার অবকাশ আমাকে দেয়া হোক। আমি আখেরি চেষ্টা করে দেখি। যদি ফলাফল পূর্বের মতোই থাকে তাহলে আমি ওয়াদা দিচ্ছি শেষ পর্যন্ত আমি আপনাদের সাথেই থাকবো। মিল্লাতের উপর পিতার ব্যক্তি স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবো না।
আমার বন্ধুগণ! এরপরও আমার একটা আখেরি গোজারিশ থাকবে। আর সেটা হলো পিতা যদি পথে না আসেন এবং পরিণামে তিনি আমাদের হাতে ধরা পড়েন তাহলে তাঁর জীবনের শেষ পরিণতির মুহূর্তে আপনারা আমাকে অকুস্থলে ডাকবেন না। কারণ শত হলেও তিনি পিতা। তাঁর সে পরিণতি দর্শন আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি— মিল্লাতের মাথা উঁচু রাখার গরজে, মুসলিম ঐক্যের উদ্দেশ্য শুধু পিতাকে নয় পরিবারের সকল সদস্য সহ সকল আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবকেও যদি কোরবান করতে হয় তাহলেও আপনারা হুসাইনের মুখ থেকে কখনো “আহ!” শুনতে পাবেন না। এটাই আমাদের শেষ সিদ্ধান্ত, মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে আমরা পিতা ইবনে কাজিকে বরদাশত করবো না।
হুসাইনের এ দ্ব্যার্থহীন উত্তর শুনে উবাদা বিন তামাম এবং আলকামা বিন সা’দ নিশ্চিন্ত হয়ে যান। এরপর তাঁরা সেখান থেকে উঠে শিবির অভিমুখে এগিয়ে চলেন।