বদরুদ্দীন উমর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে যে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা, সেই চুক্তির (এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক) খসড়ার পূর্ণ বিবরণ ইংরেজি দৈনিক The Independent-এ প্রকাশিত হয়েছে ১৩ মার্চ, ২০১৭ তারিখে প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম খবর হিসেবে।
ধরে নেয়া যেতে পারে, চুক্তির এই খসড়া তারা সরকার থেকে পেয়েছে। অর্থাৎ এটি সরকারের তরফ থেকে তাদের কাছে দেয়া হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, অন্য কোনো পত্রিকায় এই চুক্তির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়নি অর্থাৎ তাদের এটা দেয়া হয়নি। The Independent শিল্পপতি সালমান রহমানের মালিকানাধীন পত্রিকা এবং সালমান রহমান হলেন শেখ হাসিনার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা। কাজেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শুধু এই পত্রিকাটিতে কেন এ চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করার জন্য দেয়া হল, এটা ভেবে দেখার বিষয়। একে তাৎপর্যহীন মনে করার কারণ নেই। হতে পারে এটা এক কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন চীনের থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র কিনে থাকে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী চীনের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারেই অভ্যস্ত। তাছাড়া চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গাঁটবন্ধন বেশ শক্তিশালীই বলতে হবে। চীন যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে, তার ওপরই বাংলাদেশের অধিকাংশ উন্নয়নমূলক ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টগুলো নির্ভরশীল। কিছুদিন আগে চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে সফরে আসার সময় যে বিশাল অঙ্কের ঋণ ও সাহায্য বাংলাদেশকে দেয়ার জন্য চুক্তি করেছে, ভারতের থেকে পাওয়া ঋণের পরিমাণ তার কাছে তুচ্ছ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ভারতের চাপে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সম্পাদন কোনো সুখের ব্যাপার নয়। এর দ্বারা চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সম্ভাব্য অবনতির বিষয়টি অগুরুত্বপূর্ণ মনে করার কারণ নেই। এ কারণে সরকারের মধ্যেই ভারতের প্রস্তাবিত সামরিক চুক্তিতে বাংলাদেশের আবদ্ধ হওয়ার বিরোধিতা আছে। এই বিরোধিতার চাপ নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আছে। কাজেই তার আসন্ন সফরে জনগণের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তির বিরোধিতাও যে আছে, এ বিষয়টি সামনে আনার জন্যই সরকারের নিজস্ব লোকের মালিকানাধীন পত্রিকাটিতে এই চুক্তির বিবরণ প্রকাশ বা ফাঁস করা হয়ে থাকতে পারে।
ভারত কর্তৃক প্রস্তাবিত যে সামরিক চুক্তিটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে পারে, The Independent পত্রিকায় প্রকাশিত তার বিবরণের দিকে তাকালেই বাংলাদেশের জন্য এর ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর দিকটি খুব সহজেই চোখে পড়বে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একতরফাভাবে ভারতকে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এসেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারত সরকারের থেকে কিছুই পায়নি। মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস সরকার এবং এখন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার তিস্তার পানির হিস্যা বাংলাদেশকে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা করেনি। এক্ষেত্রে শুধু আশ্বাস ছাড়া তারা বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। কাজেই বাংলাদেশ পানির অভাবে কৃষিসহ পরিবেশ ইত্যাদির দিক থেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের এমনই অবস্থা যে, ভারতের এই অবন্ধুসুলভ আচরণ সত্ত্বেও তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সবকিছুই করেছে। ভারতকে বাংলাদেশ সমুদ্র ও নৌবন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। জনগণের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তাদের পরিবহনের সুবিধা দিয়েছে। ভারত নিজের সুন্দরবন অঞ্চল রক্ষার জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করেছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিএসএফ বেপরোয়াভাবে হত্যা করে চলা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে এ কাজ থেকে বিরত করার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও ভারত নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছে। এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এখন দিল্লি যাচ্ছেন ভারতের সঙ্গে এমন এক সামরিক চুক্তি করতে, যার ফলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ে ভারত কর্তৃক সবকিছু জানার ব্যাপারে আর কোনো বাধা থাকবে না! ‘বন্ধু দেশ’ হিসেবে ভারত এর পর থেকে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে যাবে। ভারত সরকারের কোনো কোনো মুখপাত্র বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ছাড়া আর কোনো দেশেরই সীমান্ত নেই, যে কারণে বাংলাদেশের বড় ধরনের কোনো সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন নেই! অন্যদিকে আসন্ন ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির সঙ্গে ভারত বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার প্রস্তাব করেছে তাদের কাছ থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্রসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য! একে এক ভেল্কিবাজি ছাড়া আর কী বলা যায়?
সরকারি সূত্র অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কিত কোনো চুক্তি দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই (The Independent, 13.03.2017)। অথচ বাংলাদেশের জন্য তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। ভারত সরকার যে বাংলাদেশের প্রয়োজনের ব্যাপারে স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন, এর থেকে তার বড় প্রমাণ আর কী আছে? এবং বাংলাদেশ যে ভারতের ওপর এ নিয়ে চাপ সৃষ্টির কোনো ক্ষমতাই রাখে না, তিস্তার পানির হিস্যা আদায়কে ভারত সরকারের সঙ্গে অন্যান্য চুক্তির পূর্বশর্ত হিসেবে দরকষাকষি করতে সম্পূর্ণ অক্ষম, এই সত্যও এর দ্বারাই প্রমাণিত হয়। এর থেকে সহজেই প্রমাণিত হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থই প্রধান বিবেচ্য বিষয়!!
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশের পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু নানা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই বিপজ্জনক ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সফরের ‘সাফল্য’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, এ সফরে নয়াদিল্লি গিয়ে তিনি স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে থাকবেন, যে সম্মান পূর্ববর্তী কোনো বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়নি (The Independent, 13.03.2017)। দেশের স্বার্থ রক্ষা ও ‘সম্মানবোধের’ এটাই যদি নমুনা হয়, তাহলে তুচ্ছ ‘সম্মান’ লাভ করে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া আর কাকে বলা যাবে?
এবার আসা যেতে পারে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির একটু বিস্তারিত বিবরণে। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারতের সীমানা। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের দুটি নতুন সাবমেরিন কমিশন করা উপলক্ষে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় দেশ। কিন্তু কোনো দেশ তাকে আক্রমণ করলে তার উপযুক্ত জবাব দেয়া হবে (The Independent, 13.03.2017)। এই সম্ভাব্য দেশ কোনটি। চীন নিশ্চয় নয়। তার কারণ চীন থেকে সাবমেরিন কিনে সেগুলোর কমিশন উপলক্ষেই এ কথা বলা হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পর তাদের মধ্যে যুদ্ধের কোনো ব্যাপার নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ আক্রমণ করে মিয়ানমারের কোনোই লাভ নেই। এ অবস্থায় বাকি থাকে ভারত, যার দ্বারা বাংলাদেশের তিন দিক পরিবেষ্টিত। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যে সামরিক চুক্তি করতে যাচ্ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রান্ত হওয়া এক হাস্যকর ব্যাপার ছাড়া আর কী? এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্যকে একটি ফাঁকা ও অর্থহীন কথা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? ভারত-বাংলাদেশ সম্ভাব্য সামরিক চুক্তির দিকে তাকালে এ বিষয়ে অন্যকিছু ভাবার অবকাশই নেই।
এই চুক্তিতে যা থাকছে তা হল- ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা শিল্প, স্পেস টেকনোলজি, টেকনিক্যাল সহযোগিতা এবং সমুদ্র অবকাঠামো ক্ষেত্রে সহযোগিতা। উভয়েই একে অন্য দেশে সমরিক প্রতিনিধি দল পাঠানোর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। উভয় দেশ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, সামরিক বিশেষজ্ঞ বিনিময়, ট্রেনার ও পর্যবেক্ষক, সামরিক বিষয়াদি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করবে। সামরিক সরঞ্জাম তদারকি, চিকিৎসা, খেলাধুলার ব্যবস্থা করবে। দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও ত্রাণ ব্যবস্থায় সহযোগিতা করবে। আর্মি, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীতে স্টাফ পর্যায়ে উভয় দেশ আলোচনার ব্যবস্থা করবে। আলোচনার মাধ্যমে সামরিক বিষয়ে সমস্যার সমাধান করবে। উভয় দেশের সামরিক বাহিনী নিজেদের মধ্যে বার্ষিক আলোচনার ব্যবস্থা করবে। উভয়পক্ষ একই সময়ে সামরিক জাহাজ ও বিমান বাহিনীর সফরের ব্যবস্থা করবে। আন্তর্জাতিক সীমান্তে যৌথ পাহারা ও নজরদারির ব্যবস্থা করবে। উভয় দেশ যৌথ উদ্যোগে সামরিক শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যবস্থা করবে। উভয় দেশ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। সামরিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফরের মাধ্যমে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়ে তথ্য বিনিময় ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। সামরিক বাহিনীর প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার (চঝঙ) ও দেশরক্ষা সচিব পর্যায়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হবে প্রস্তাবিত চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে (The Independent, 13.03.2017)।
এছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে যার বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এসব চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকার বাংলাদেশের দেশরক্ষা বিষয়ে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে হস্তক্ষেপ করবে না। এমন কোনো সামরিক তথ্য থাকবে না, যার খবর ভারত সরকারের অজানা থাকবে। এই চুক্তিতে ‘উভয় দেশ’, ‘উভয় দেশ’ বলে যা কিছু বলা হয়েছে তা অর্থহীন। কারণ ভারত বাংলাদেশে যা করবে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে সেটা করা সম্ভব হবে, এটা চিন্তা করা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও চরম দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কিছু নয়। দুনিয়াতে শক্তিশালী ও দুর্বল দেশের মধ্যে যেসব সামরিক চুক্তি হয় তার প্রতিটিতেই ‘উভয় দেশের’ কথা বলা হলেও সব সুবিধা সব সময় শক্তিশালী দেশই পেয়ে থাকে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত এই সামরিক চুক্তিও এদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। কাজেই এই চুক্তি আগামী মাসে দিল্লিতে স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবস্থা কী দাঁড়াবে? যা দাঁড়াবে সেটা অতি মূর্খ ও বোকার পক্ষেও বোঝা খুব সহজ।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল