সালাহ উদ্দিন শুভ্র :
সম্প্রতি বাংলাদেশের নামকরা রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মঞ্জুরুল আহসান খানের ওমরাহ হজ পালন নিয়ে কিছু বিতর্ক ও আপত্তি চোখে পড়েছে। একজন কমিউনিস্ট যেনবা ‘নাস্তিক, ফলে তার ধর্ম পালন সাজে না- এমন আপত্তি ছিল। অথবা কেউ কেউ এই বলেও তর্ক করেছেন যে বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল কেউ কেন হজ করবেন। তাদের মতে মার্ক্সবাদ বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে ধর্ম পালন, পরকাল, অদৃষ্ট, ভাগ্য এসব নেই। কমিউনিস্ট মাত্রে তিনি বিজ্ঞানবাদী হবেন এবং সকল ধর্মাধর্ম মুক্ত থাকবেন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে ধর্মের যোগাযোগ বা তাদের ধর্ম বিচার নিয়ে বাংলায় বিস্তর আলোচনা নেই। তবে একেবারেই যে নেই তা নয়। কিছু কিছু হয়েছে। সেগুলো সামান্যই বলতে গেলে। কিন্তু বিস্তারিতভাবে, গভীর মনযোগের সঙ্গে, এখানকার কমিউনিস্টদের মূল আচরণগুলো ধরে ধরে, একজন একাডেমিশিয়ানের অ্যাপ্রোচ নিয়ে যে বাংলায় কেউ এ বিষয়ে সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় আলাপ করতে পারেন তা পিনাকী ভট্টাচার্যের দুটি বই না পড়লে অন্তত আমার জানা হতো না। আমি নিজেও এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টা করি। অন্যান্য দেশ ও ভাষায়ও ধর্ম এবং কমিউনিজমের যোগাযোগ, দৃষ্টিভঙ্গিগুলো অবজারভ করি। বাংলাদেশেও আমার জানাশোনার বাইরে পিনাকী ভট্টাচার্যের এ-সংক্রান্ত লেখালেখি পড়তে পারাটা সৌভাগ্যের বলতে হবে। কারণ অপ্রস্তুতভাবেই আমি তার লেখা পড়তে গিয়ে অবাক হয়েছি। তিনি অনেক পড়াশোনা করেছেন, খেটেছেন, আমাদের সময়ের সাইকোলজিটা বুঝার চেষ্টা করেছেন। এবং সেসব বিষয়ে নিজের মতামতটা হাজির করেছেন।
তার বই দুটি হলো, ‘ধর্ম ও নাস্তিকতা বিষয়ে বাঙালি কমিউনিস্টদের ভ্রান্তি পর্ব’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’। বই দুটি আমি পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন সূত্র থেকে। আলোচনার বিষয়বস্তু এক হলেও তারা একে অপরের পরিপূরক। কমিউনিস্ট বলতে বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ার বাংলা অংশ কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত এক সংজ্ঞা পিনাকী ভট্টাচার্য হাজির করেছেন। যে কমিউনিস্ট পার্টির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার ইতিহাসও লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন, কী সেটা উল্লেখ করছি, ‘দেশভাগের পরে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি হারানোর মানে সাথে সাথে হিন্দুদের সব পুরোনো বয়ানও হারিয়ে অকেজো হয়ে যায়। তাই নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য সে নতুন বয়ান গঠনের সন্ধানে নামে। আর নিধর্মী এক সমাজের অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে সেই নতুন বয়ানটা সে হাজির করেছিল যে-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে হলো কমিউনিস্ট পার্টি বা এর নাম আজকের সিপিবি।’ (মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ)
আমাদের এখানে কমিউনিস্ট কারা, এ বিষয়ে পিনাকীর প্রস্তাবনা তুলে ধরার জন্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি আপাতত। একই বইয়ে তিনি বলছেন, ‘পূর্ববঙ্গে থেকে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জমিদারি হারানো পুরোনো জমিদার বংশের ছেলেরা ও অভিজাত হিন্দু মধ্যবিত্তরা এই পার্টিতে দলে দলে ঢুকতে থাকে। কমিউনিস্ট রাজনীতির কয়েকজন আইকনকে দেখলেই এ কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। কমরেড মণি সিংহ, বরুণ রায়, ইলা মিত্র, রবি নিয়োগী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, অমল সেন, গুরু দাশ তালুকদার, ধীরেন শীলসহ আরও অসংখ্য নেতার নাম করা যায়, যারা সবাই প্রত্যক্ষভাবে জদিার এবং একজন নায়েব পরিবারের সন্তান।’
এই ‘হিন্দুরা’ আবার সবসময় কমিউনিস্ট পার্টিতে থাকল না। পিনাকী মনে করেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভাঙন এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালে নাইন-ইলেভেন এর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যুগে ‘হিন্দু সম্প্রদায়’ এর সমর্থক হয়ে উঠল। এবং আমেরিকার কোলে চড়ে হিন্দুরা সিপিবি থেকেও দূরে চলে গেল। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থানের কালে আন্তর্জাতিকভাবে ওয়ার অন টেরর প্রকল্পে সংশোধনী আসলেও স্থানীয়ভাবে তা শক্তিশালী হয়। এবং হিন্দুরাও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হয়।
এখানে পিনাকী গুরুতর যে অভিযোগ তুলছেন যে, শ্রেণি বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ মার্ক্সের মূল প্রশ্নগুলোর মধ্যে না থেকে সম্প্রদায়ের স্বার্থ বা ইজ্জত রক্ষাই এখানে কমিউনিস্টদের মূল মিশন। আজো তারা এর মধ্যেই আছে। ফলে অর্থোডক্স কমিউনিস্ট এখানে নেই। এখানে আছে ‘বাংলার কমিউনিস্ট’। এই বিষয়টি শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে।
পিনাকী স্পর্ধার সঙ্গে এ প্রসঙ্গটিও তুলেছেন। ‘যখন কৃষক প্রজা পার্টি পূর্ববঙ্গে জমিদারি উচ্ছেদের লড়াই করছে এবং যে কারণে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; পূর্ববঙ্গের কৃষকরা জমির মালিকানার দাবিতে প্রত্যক্ষ শ্রেণিসংগ্রামে যুক্ত, তখন পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্টরা তেভাগার লড়াই করছেন। অর্থাৎ কৃষক যেখানে আধাভাগ দিতেন জমিদারকে, সেখানে তিনভাগের এক ভাগ দেওয়ার লড়াই করছেন কমিউনিস্টরা। সেই লড়াই কার্যত কৃষকের লড়াই ছিল না; মূলত এটা ছিল জমিদারি হারানোর ভয়ে ভীত জমিদারদের জমিদার রক্ষার একটা বিকল্প চমৎকার পথ।’ (ঐ)তার মানে দাঁড়াচ্ছে কমিউনিস্টদের যে মূল কাজ শ্রেণি প্রশ্নের রাজনীতি ও সেই সংক্রান্ত কর্মসূচি দেওয়া তা এখানকার কমিউনিস্টরা দেয়নি। পিনাকী নিজেই প্রশ্ন করছেন, ‘এখনো কি বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা সমাজের প্রধান দ্বন্দ্বকে ধরতে পেরেছেন?’
তার মতে, ‘আধুনিকতাকে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধ সব বামপন্থী বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছেন এবং এভাবেই পুঁজিবাদের হাতকে তারা নিজের অগোচরে শক্তিশালী করেছেন।’ অন্যদিকে বামপন্থীরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে সে বিষয়ে পিনাকী জানাচ্ছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্রপঞ্চ একটি বুর্জোয়া ভাবাদর্শ-এতে নিশ্চয় কোনো দ্বিমত নেই। যদিও এই রেডিমেড ভাবাদর্শকে কোনো দীর্ঘ লড়াই ছাড়াই এ দেশের বুর্জোয়ারা ডিক্রি করে চাপিয়ে দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চায়। এই বুর্জোয়া ভাবাদর্শকে বামপন্থীরা কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটার বিচার মার্ক্স করে গেছেন। মার্ক্সের দেখানো পথে ধর্মের এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে বাংলাদেশের বামপন্থীরা হাঁটেন না…’
এতক্ষণের উদ্ধৃতির উল্লেখের কারণ আগেই বলেছি, এখানকার কমিউনিস্টদের যে চেহারা পিনাকী ভট্টাচার্য দেখাতে চেয়েছেন তা উপস্থাপন করা। নিঃসন্দেহে পিনাকী যৌক্তিক, ঐতিহাসিক এবং ন্যায্য উপায়েই রাজনীতির এই ধারাটিকে বিচার করেছেন। এই বিষয়টি নিয়ে এমন অভিনিবেশ সচরাচর দেখা যায় না। পশ্চিমা ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়েও তার বিস্তর জানাশোনা রয়েছে। এই দুটি বই পড়লে নিরন্তর এক বিতর্কে জড়িয়ে যাবেন পাঠক। আমাদের এখানে চিন্তার যে এলেবেলে পরিস্থিতি তাতে সূত্রধরের ভূমিকা নিয়েছেন পিনাকী। তার আলোচনা উপাদেয়।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আর তা হলো ধর্ম। ‘ধর্ম ও নাস্তিকতা বিষয়ে বাঙালি কমিউনিস্টদের ভ্রান্তি পর্ব’বইটি পিনাকী শুরুই করেছেন এই বাক্য দিয়ে- ‘ধর্ম ও নাস্তিকতা নিয়ে বাংলাদেশে বামপন্থীদের যে অবস্থান তা মোটেই ধ্রুপদি মার্ক্সবাদের সাথে যায় না।’ ধ্রুপদী মার্ক্সবাদে ধর্ম বিষয়ে কী বলা আছে তা পিনাকীর নিজের অনুবাদে আমরা পড়ে নিতে পারি এই অবসরে।
‘…ধর্ম হচ্ছে সেই মানুষের নিজের সম্পর্কে চৈতন্য, তার নিজের গৌরবচেতনা। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার বাইরে ল্যাপ্টা মেরে বসে থাকা কোনো বিমূর্ত সত্তা নয়। মানুষ মানে হচ্ছে মানুষের এই জগৎ, রাষ্ট্র, সমাজ। এই রাষ্ট্র, এই সমাজই জন্ম দেয় ধর্মকে, যা হলো জগৎ সম্পর্কে মাথা নিচে পা ওপরে ওল্টানো চেতনা। কারণ জগৎটা আসলেই মাথা নিচে, পা ওপরে তোলা। ধর্ম হলো এই জগতেরই সাধারণ তত্ত্ব, এর বিশ্বকোষ; এই জগতেরই লোকপ্রিয় যুক্তি তর্ক, এর আধ্যাত্মিক মর্যাদা, এর জোশ, এর নৈতিক আদেশ, পরিপূরক আচার-অনুষ্ঠান, সান্ত্বনা প্রতিপাদনের সর্বজনীন ভিত্তি। …
ধর্মের মর্মযাতনা অতএব বাস্তবের সেই একই আর সমান যাতনার অভিব্যক্তি, বাস্তবে কষ্ট পাওয়ার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। ধর্ম হচ্ছে নির্যাতিত জীবনের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। এটা হচ্ছে জনগণের জন্য আফিম।’ (পৃষ্ঠা-৩৭)
এখানে আফিমের ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন- ‘১৮০৪ সালে মার্ক্সের জন্মের মাত্র কয়েক বছর আগে জার্মানিতেই ফ্রেডারিখ স্ট্রুনার আফিম থেকে এ যাবতকালের শ্রেষ্ঠ ব্যথানাশক আবিষ্কার করেন।’
ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ অনুযায়ী ধর্ম ‘ব্যাথানাশক’। যে ব্যাথার উপশম মার্ক্সবাদ দিতে চায় তা ধর্মে আছে। মানুষ যে সামাজিক শান্তি চায় তা বাস্তব জগতে ধর্মের মাধ্যমে নয় মার্ক্সবাদের মাধ্যমে হাসিল করতে হবে। তবে ধর্মকে বাদ দিয়েও নয়। রাশিয়ান বিপ্লবের নেতা লেনিনও এমনটা বলেছেন দেখতে পাই পিনাকীর অনুবাদে। ‘… মার্ক্সবাদ বলে আমাদের জানতে হবে কিভাবে ধর্মের মোকাবিলা করতে হয়। আর তার জন্য জনগণের মধ্যে ধর্ম ও বিশ্বাসের উৎপত্তি কেন হল, বস্তুবাদী পদ্ধতিতে তার একটা ব্যাখ্যা তাকে পেশ করতে হয়। ধর্ম ও মোকাবিলার ব্যাপারটাকে বিমূর্ত কায়দায় মত-প্রচারের ওয়াজ বানিয়ে ফেললে চলবে না। ধর্মের সামাজিক শেকড় উপড়ে ফেলার জন্য শ্রেণি আন্দোলনের কংক্রিট চর্চার সঙ্গে তাকে যুক্ত করতে হবে।’ (পৃ : ৩৪)
এ বিষয়ে আমাদের লেখক কী বলেছেন তা পড়ে নেই- ‘নাস্তিকেরা যেহেতু মনে করে ধর্ম ব্যক্তির মাথা থেকে এসেছে, তাই ধর্মকে আক্রমণ মূলত ধর্ম-প্রবর্তকের ওপর আক্রমণে পর্যবসিত হয়। ধর্মের বিরোধিতা করতে গিয়ে তাকে তাদের প্রমাণ করতে হয়, ধর্ম-প্রবর্তক একজন প্রতারক। কমিউনিস্টরা ধর্ম-প্রণেতাদের প্রতারক মনে করে না। বরং সকল ধর্ম-প্রচারককে ইতিহাসের সেই কালপর্বে অনন্য গুণসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে।’ (পৃষ্ঠা ৩৮)
এর মানে দাঁড়ায় বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষিতে ধর্ম তৈরি করে মানুষ। এটা একক ব্যক্তির মধ্য দিয়ে প্রস্ফূটিত হলেও সামাজিক প্রেক্ষিত ছাড়া সেই ফুল বিকশিত হয় না। লেনিনও এমনটা বলেছেন, ‘মানুষের ওপর চেপে থাকা ধর্মের জোয়াল আসলে সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থারই ফল।’ তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, ‘পরলোকে স্বর্গ সৃষ্টি নিয়ে মানুষের ঐক্য তৈরির চেয়ে পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির ঐক্য আমাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ লেনিন একই লেখায় বলেছেন, ‘এর অর্থ মোটেই এই নয় যে ধর্মের প্রশ্নকে আমাদের সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া উচিত, যা তার প্রাপ্য নয়।; (পৃ : ২৬)
ধর্মের সঙ্গে ফলে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের বিরোধ দেখা যায় না। পুঁজিবাদ যেমন ধর্মকে প্রয়োজনে উস্কে দিয়েছে এবং দমিয়েছে। মার্ক্সবাদ মোটেও তেমনটি করতে চায় না। সততা এবেং আন্তরিকতার সঙ্গে এই মতবাদ ধর্মকে গ্রহণ ও তার জমায়েতে সামিল করতে চায়।সমাজতাত্ত্বিকভাবেও তারা ধর্মকে খারিজ করছেন না। এঙ্গেলস বলছেন, ‘শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের মতোই খ্রিষ্ট ধর্ম আদিতে ছিল নির্যাতিত মানুষের সংগ্রাম; প্রথমে তা দাসদের, মুক্তি লাভ করা দাসদের, সকল অধিকার বঞ্চিত সর্বহারা আর রোম যাদের অধিনস্ত আর ছত্রভঙ্গ করে রেখেছে সেই মানুষগুলোর ধর্ম ছিল। যিশু খ্রিষ্টের ধর্ম আর শ্রমিকদের সমাজতন্ত্র দাসত্বের শৃঙ্খল আর দুর্দশা থেকে আসন্ন মুক্তির বার্তা ঘোষণা করে, খ্রিষ্ট ধর্ম সেই মুক্তি পাবার কথা বলে পরকালে। সমাজতন্ত্র সেই মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয় এই পৃথিবীতে ইহলোকে, সমাজকে বদল করে।’ (অনু: পিনাকী ভট্টাচার্য, পৃ: ১৯)
এঙ্গেলস বিষয়টিকে আরো পরিষ্কারকরেছেন। ধর্মের আর সমাজতন্ত্রের একটা অন্তর্গত মিল, মানবিক ঐক্য মার্ক্সবাদ স্বীকার করে বলে তিনি জানাচ্ছেন। সমাজতান্ত্রিক মতবাদ আসার আগে ধর্ম মানুষের মুক্তির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে তিনি জানাচ্ছেন। কিন্তু ধর্ম সার্বিক বাস্তবিক মুক্তির দেখা দিতে পারছে না। তা দিতে পারবে মার্ক্সবাদ। ধর্মকে এখানে পিনাকীও বলছেন ‘চৈতন্য’। এই চৈতন্য কী তা বুঝার জন্য সাব অল্টার্ন বুদ্ধিজীবী গৌতম ভদ্রের একটি মন্তব্য তিনি পেশ করেছেন। সেটি হলো- ‘ধর্মভাব চৈতন্যের এক বিশেষ স্তর। কিন্তু প্রাক-ধনতান্ত্রিক বা আধা-ধনতান্ত্রিক সমাজে চৈতন্যের মধ্যেই মানুষ তাঁর পরিদৃশ্যমান জগতের অভিজ্ঞতাকে বোঝার সূত্র খুঁজে বের করে আবার সময় সময় তার নিজের ও চারপাশের সমাজের নানা কর্তব্য বা ইতিকর্তব্যকে ধরার চেষ্টা করে। বারবার আমরা দেখব পাপ/পূণ্য, ন্যায়/অন্যায় বোধ কিভাবে ধর্মবোধের মধ্যে নিহিত আছে।’ (পৃ : ২৩)
মানে দাঁড়াচ্ছে অনেকটা এমন যে পুঁজিবাদ আসার আগ পর্যন্ত মানুষ তার জগত-জীবন-বঞ্চনাকে বুঝবার ও তা থেকে মুক্তি পাবার আশায় যে বিশেষ চৈতন্যের দেখা পেয়েছিল তা ধর্ম। এবং এই ধর্ম সংগ্রামবিহীন নয়, মুক্তির আকাঙক্ষাহীন নয়। এঙ্গেল বলেছেন, ‘এমমনকি ষোল সতকের যেগুলিকে ধর্মযুদ্ধ বলা হয় সেগুলিতেও প্রধানত জড়িত ছিল বিভিন্ন স্পষ্ট বৈষয়িক শ্রেণিস্বার্থ; সেগুলি ছিল শ্রেণিযুদ্ধও…’
আর বেশি কিছু বলার দরকার পড়ে না আশা করি এই স্বল্প পরিসরের। ধর্মকে মার্ক্সবাদ যে চোখে দেখেেেছ সেই চিন্তা চর্চা আমাদের দেশের বামপন্থীদের নেই এই সমালোচনাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে পিনাকী একটি পথের দিশা দিয়েছেন। মার্ক্সবাদীরা ধর্মকে বুঝতে চাওয়ার যে পশ্চিমা বা পুঁজিবাদী পদ্ধতি তা অবলম্বন করেননি বলেই পিনাকী জানাচ্ছেন আমাদের। যেমন মার্ক্স একজায়গায় বলেছেন, ‘ কোনো এককালে একজন ভালো মানুষের মনে হলো মানুষ জলে ডোবে, কারণ তাদের মাথা অভিকর্ষের তত্ত্বের বোঝায় ভারী হয়ে আছে। যদি ঐ ধারণাটি, ধরা যাক, কুসংস্কার বা ধর্মীয় ধারণাটি তাদের মাথঅ থেকে বের করে দেয়া যায় তাহলে তারা চিরকালের জন্য জলের সব বিপদ থেকে সুরক্ষিত হয়ে যাবে। সারাটা জীবন সে অভিকর্ষের মায়ার বিরুদ্ধে লড়ল, সমস্ত তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে অভিকর্ষের ভয়াবহতা সম্পর্কে নতুন নতুন বহুমুখী সব প্রমাণ হাজির করল। জার্মানির নতুন বিপ্লবী দার্শনিকেরা ঐ ভালো মানুষটার মতো।’ (পৃ:৩৮)
পিনাকী বলছেন, ‘এই নির্বোধেরা বোঝাতে চায়, ধর্মই সকল জাগতিক দুর্দশার জন্য দায়ী। তাই তারা মনে করে এই ধর্মের সবলে উচ্ছেদই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।’ অর্থাৎ, মানুষের ধর্মজাত আচার, নিষ্ঠা, বিশ্বাসকে আধুনিকতাবাদীরা, নাস্তিকরা যে উপায়ে ডিল করবেন বলে ভাবেন মার্ক্সের বরাতে পিনাকী তাদের নির্বোধ বলছেন। বস্তুত কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কারের মতদ্বৈততা মূল সংকটকে আড়াল করে এমনটা মার্ক্স অথবা লেনিন বলতে চেয়েছেন।
মার্ক্সের এই মত এই বিষয়টিও খোলাসা করে যে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ধর্মকে রিপ্লেস করবে না। এখানে ধোঁকা অথবা চালাকির কিছু নেই। বরং মানবিক দরদের জায়গাটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পুঁজিবাদ তার উপযোগী ধর্মকে যেমন প্রমোট করে এবং বিরোধী ধর্মকে বিনাশের দিকে নিয়ে যায়, মার্ক্সবাদ তা করছে না বলে প্রতিভাত। এই তত্ত্ব শোষিত শ্রেণীর সব কিছুকেই সঙ্গে নিয়ে কর্মসূচি সাজাতে চাইছে। আগে মাথা পরিষ্কার করে, অনন্ধতা, কুসংস্কার ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে তারপর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে যাওয়ার নীতি এই দার্শনিকদের নেই, যা পিনাকী দেখাতে চেয়েছেন। বরং সব শুদ্ধই, ধর্ম তো বটেই সঙ্গে করে কর্মসূচিতে আসতে হবে, পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, রাজনীতিকে গড়ে তুলতে হবে- এমন রণনীতি বা রণকৌশলও তাত্ত্বিক মার্ক্সবাদে আছে।
কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট রাজনীতি চর্চায় পুঁজিবাদী, এনজিও, দাতা সংস্থার এজেন্ডাই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যা শুরুতে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। পিনাকীও তার বইয়ের এসব বিষদ বলেছেন। বাস্তবিক শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে গাঁটছড়া না বাঁধায় এমেনটা হয়েছে বলে ইশারা করেছেন পিনাকী। শ্রেণি সংগ্রাম যত বলবান হবে তত এসব বিষয়ে সংশয় দূর হবে বলে একটি রাজনৈতিক গন্ধ তার দুটি বই পাঠে পাওয়া গেল।
লেখক বাংলার স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেও তার কাজ আরো প্র্যাকটিক্যাল হয়েছে বলে আমি মনে করি। ফরহাদের তুলনায় দার্শনিক বিস্তৃতি কম হলেও কার্যকর পন্থা বুঝে নিতে বরং এই দুই বই সহায়ক হবে বেশি। পাঠক, সমালোচকসহ এই সময়ের রাজনীতিতে আগ্রহী, দর্শন চর্চায় যারা রত ও সময় এবেং সমাজকে বুঝতে চান তারা এমন তুখোড় বইগুলো সংগ্রহে নিতে পারেন।
পিনাকী ভট্টাচার্যের ধর্ম ও নাস্তিকতা বিষয়ে বাঙালি কমিউনিস্টদের ভ্রান্তিপর্ব বইটি প্রকাশ করেছে ভাষাচিত্র। আর মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটি এবারের মেলায় নিয়ে এসেছে আদর্শ। আমাদের সময়ের ও সমাজে এমন বিজ্ঞ একজন বুদ্ধিজীবীর উপস্থিতি বোদ্ধা সমাজকে চাঙ্গা করারই কথা।