হযরত মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক :
বিশ্বব্যপি দাওয়াতের মহান মিশন পরিচালনাকারী তাবলীগ জামাত এক কঠিন সময় পার করছে ৷ সমস্যার কেন্দ্রমূলে অবস্থান করছেন জামাতের বর্তমান শীর্ষ মুরব্বী মাওলানা সা’দ কান্ধলভী হাফিজাহুল্লাহ ৷ দুটি বিষয়কে নিয়ে ঘনিভূত চলমান সমস্যা ৷
প্রথমটি হল কিছু দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য, যা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে ৷ জামাতের সাথীদের মধ্যকার তো বটেই, এমন কি স্বয়ং সা’দ সাহেবের বেশ কিছু বক্তব্য বিতর্কের ঝড় তুলেছে ৷ উপমহাদেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রেক্ষিতে দারুল উলূম দেওবন্দ দীর্ঘ সময় ধরে চুল-চেরা বিশ্লেষনের পর এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি ঘোষনাপত্র জনসম্মুখে প্রকাশ করেছে ৷
চলমান সংকটের দ্বিতীয় বিষয় হল, বিশ্বব্যপি পরিচালিত তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাঠামোগত মতপার্থক্য ৷ মাওলানা সা’দ সাহেবের অনুসারীগণ সা’দ সাহেবকে বর্তমানে তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রীয় আমীর মনে করেন ৷ অপর দিকে জামাতের বয়জৈষ্ঠ অধিকাংশ মুরব্বীগণ মনে করেন একক ব্যক্তির এমরত নয়, বরং গঠিত আলমী শূরা বা আন্তর্জাতিক পরামর্শ পরিষদের মাধ্যমেই তাবলীগ জামাতের কাজ পরিচালিত হতে হবে ৷ কিন্তু সা’দ সাহেব এই শূরা মানেন না ৷
শূরা এবং এমারতের টানা-পড়েনে নেযামুদ্দীনের কেন্দ্রীয় মারকাযে হট্টগোল, গণ্ডগোল হয়ে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে ৷ এরপর নেযামুদ্দীনে সা’দ সাহেবের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৷ এই পরিস্থিতিতে হযরত ওমর পালনপুরী রহঃ, মুফতী জয়নুল আবেদীন রহঃ প্রমূখ বুযুর্গ মুরব্বীদের পর বর্তমানে বিশ্ব তাবলীগের সবচেয়ে বড় ইলমী মুরব্বী আহমদ লাট সাহেবসহ নেযামুদ্দীনের মুকীম অনেক মুরব্বীগণ নেযামুদ্দীন ছেড়ে চলে গেছেন ৷ রায়বেণ্ড মারকাজ ইতিমধ্যে নেযামুদ্দীন থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৷ তারা শূরার অধিনেই কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন ৷
দুই
তাবলীগ জামাতে চলমান এই অস্থিরতার মধ্যে বিষয়টিকে বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম অতীব গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনেন ৷ দেশের একক শীর্ষ মুরব্বী আল্লামা আহমদ শফী হাফিজাহুল্লাহ অন্যান্য ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে দ্বীনের এই আযীম মেহনতকে তার সঠিক ধারায় রক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহন করেন ৷ হযরতের পক্ষ থেকে দেশের শীর্ষ ওলামাদের বড় একটি প্রতিনিধি দল আল্লামা আশরাফ আলী সাহেবের নেতৃত্বে কাকরাইলে যান এবং কাকরাইলের মুরব্বীদের সাথে আলোচনা করেন ৷ কাকরাইলকে রায়বেণ্ডের পথ ধরে আলমী শূরার অধীনে চলার পরামর্শ দেন এবং দেওবন্দের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে দেওবন্দকে আস্থায় না আনা পর্যন্ত সা’দ সাহেবকে বাংলাদেশের এজতেমায় না আনার জন্য ওলামায়ে কেরাম সাফ কথা জানিয়ে দেন ৷
এহেন প্রেক্ষিতে দূর থেকে অনুমান করা যায় যে, কাকরাইলের মুরব্বীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন ৷ কাকরাইলের অধিকাংশ আলেম মুরব্বীগণ ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ মেনে নেন ৷ কিন্তু গায়রে আলেমরা ভিন্ন পথেই হাটতে থাকেন ৷ তারা ওলামায়ে কেরামকে উপেক্ষা করে চলার নীতি গ্রহন করেন এবং যে কোনো মূল্যে সা’দ সাহেবকে এজতেমায় আনার চেষ্টা করতে থাকেন ৷ এ পর্যায়ে ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে সবরকম চেষ্টা করা হয় যেন, সা’দ সাহেব সমস্যা সমাধানের আগে বাংলাদেশে না আসেন ৷
তিন
দারুল উলূম দেওবন্দের মত এলমী নেতৃত্বের প্রধান মারকাজ তার সকল মুরব্বীদের সর্বসম্মত মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিল একজন ব্যক্তির ব্যপারে ৷ আর এব্যপারে দারুল উলূম একাই নয়, বরং তাবলীগের সবচেয়ে বড় এলমী মারকাজ মাযাহেরুল উলূম সাহারানপুর এবং নদওয়াতুল উলামাও একই চিন্তার ধারক ৷ ওদিকে শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানীসহ শীর্ষ ওলামায়ে কেরামের বড় আরেক জামাত ৷ এদিকে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেম খলীফায়ে মাদানী আল্লামা আহমদ শফীসহ ওলামায়ে কেরাম ৷ এ তো এজমায়ে উম্মতের মত অবস্থা! এটাকে মামুলি বিষয় ভাববার কী কোনই অবকাশ আছে? কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এগুলোকে থোড়াই কেয়ার করছেন অভিযুক্ত মহল ৷
তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে বিগত প্রায় শতাব্দীকাল যাবৎ দ্বীনের যে ব্যপক খেদমত হয়েছে তা অন্য কোনো জামাতের দ্বারা হয় নি, একথা বলা যায় অনেকটা নির্দ্বিধায় ৷ তবে এ খেদমত আর অবদানের পিছনে আল্লাহর রহমত তো ছিলই ৷ আল্লাহর নুসরত আসার পিছনে বাহ্যিক যে সকল বিষয় নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল, ওলামায়ে দেওবন্দের সর্বাত্মক সমর্থন, সহযোগিতা ও অংশগ্রহন ৷
তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইলিয়াস রহঃ জামাতের কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, তা হল- কোনো কারণে কখনো এই কাজে ওলামায়ে কেরামের ব্যপক অংশ গ্রহন ও নেতৃত্বের পথ যেন রুদ্ধ না হয়ে যায় ৷ তিনি উপলব্ধি করতেন, ওলামায়ে কেরামের নেগরানী দুর্বল হয়ে গেলে জামাত ভুল পথে ধাবিত হবে ৷
প্রকৃত অর্থেই মাদারিসে দ্বীনিয়া ও ওলামায়ে কেরামের সাথে তাবলীগ জামাতের কাজের সম্পর্ক হল তেমন, রেলগাড়ীর ইঞ্জিনের সাথে ডাব্বা বা বগির যেমন সম্পর্ক ৷ ইঞ্জিন খুব বড় থাকে না ৷ সেই তুলনায় বগির সিরিয়াল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে ৷ পিছনের বগিগুলো থেকে তো ইঞ্জিনের অস্তিত্বই টের পাওয়া যায় না ৷ মনে হতে পারে যে, বগিগুলো নিজ শক্তিতে চলছে ৷ আর কোনো কোনো অপরিণামদর্শী অর্বাচীন মনে করতেই পারে, ইঞ্জিনের সাথে সম্পর্ক রেখে চলার কী দরকার? বগি তো অনেক দ্রূতগতিতেই চলছে! আজ তাবলীগ জামাতের অবস্থাও অনেকটা সে দশা! নেযামুদ্দীনকে দেওবন্দ-সাহারানপুর-নদওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে ৷ আর কাকরাইলকেও হাটহাজারী ও মাদারিসগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার আয়োজন সম্পন্নের পথে ৷
পাঁচ
হযরত মাওলানা সা’দ কান্ধলভী হাফিজাহুল্লাহকে কেন্দ্র করে দেওবন্দ থেকে বাংলাদেশের এজতেমা পর্যন্ত যা হয়ে গেল তাকে তাবলীগ জামাতের জন্য এক ভয়ংকর অশনি সংকেত ছাড়া বলার কিছু নেই ৷ একজন ব্যক্তির এমারতকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়া খুবই অনভিপ্রেত ৷
যার এমারত নিয়ে এত তুলকালাম, তাকে যদি বিতর্কিত বলা হয়, সামান্যও বাড়িয়ে বলা হবে না ৷ তার দৃষ্টিভঙ্গী ও অব্যাহত বক্তব্যের উপর পাক-ভারতের শীর্ষ প্রায় সকল ওলামায়ে কেরাম সরল পথ থেকে বিচ্যুতির অভিযোগ এনেছেন ৷ এর চেয়েও বড় আক্ষেপের বিষয় হল, তার দৃষ্টিআকর্ষনের পরও কোনো সুরাহা হয় নি ৷ শেষ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষনা দিতে হয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দকে ৷ এমন ঘটনা তো একজন প্রতিষ্ঠিত আমীরের অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার কথা ৷
এহেন প্রেক্ষিতে দেওবন্দের সাথে সুরাহা ছাড়া এজতেমায় না আসতে অনুরোধ জানানো হল বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে ৷ কিন্তু খুবই দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হল, বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলেন তিনি এবং তার অনুসারীরা ৷ তিনি এলেন বাংলাদেশে ৷ তার আগমনকে কেন্দ্র করে মানুষ দেখল তাবলীগ জামাতের শতবর্ষের ঐতিহ্য লংঘণের সমারোহ ৷ রাজনৈতিক নেতাদের মত মোটর শোভাযাত্রার শোডাউন হল বিমানবন্দর থেকে ৷ আর ওনার স্টেইজে যাওয়ার জন্য সারিবদ্ধ বাহিনী দাড় করিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হল ৷ স্টেইজেও থাকল নিরাপত্তার দৃষ্টিকটু আয়োজন ৷ এভাবেই তাবলীগ জামাতের বিনীত ফকিরী হালতের কাজকে ক্যাডার বাহিনীর দৌরাত্মে গ্রাস করে নিল ৷
দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম এজতেমায় গেলেন না ৷ এতে মনে হয় তারা খুশিই হলেন ৷ আলেমদের এ জঞ্জাল না থাকলেই যেন তারা আরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন! দারুল উলূম দেওবন্দের মুফতী সাহেব এজতেমায় গিয়ে তাচ্ছিল্যের শিকার হলেন ৷ ওলামাদের উদ্দেশ্যে সা’দ সাহেবের বয়ানের ফয়সালা করে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে এক হাত নেয়া হল ৷ কাকরাইলের মুরব্বী ওলামায়ে কেরামের অসহায় হয়ে তামাশা দেখা ছাড়া উপায় রইল না ৷ তাদের কেউ কেউ রাগে-ক্ষোভে এজতেমার ময়দান ছেড়ে চলে গেলেন ৷ কেউ কেউ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হাসপাতালে ভর্তি হলেন ৷
ছয়
জানিনা এখন কাকরাইলের লোকজন হাটহাজারী যাবেন কোন মুখে?
প্রতি বছর হাটহাজারীসহ মাদরাসাগুলো থেকে যে ফারেগীনদের তাশকীল হয় সেটারই বা কী হবে?
সকল মুরব্বী ওলামাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে ময়দান দখলের এ লড়াই তাবলীগ জামাতের কাজকে কোথায় নিয়ে দাড় করাবে?
ওলামায়ে কেরামকে দূরে সরিয়ে দিয়ে তাবলীগ জামাত কি সঠিক পথে চলতে পারবে?
এক ব্যক্তির এমারতের কি এত প্রয়োজন?
সব ধ্বংসের বিনিময়ে কী হবে এই এমারত দিয়ে?
পুনশ্চ:
বিষয়গুলো জনসম্মুখে আলোচনার উদ্দেশ্য হল, সমস্যা সমাধানে সকলকে যারযার জায়গা থেকে এবং তাবলীগের কাজের মেযাজ ঠিক রেখে ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানানো ৷ দ্বীনের এ মহান খেদমত যেন তার স্বকীয় ধারায় চলতে পারে সেজন্য দোয়া ও মেহনত জারি রাখা চাই ৷
বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কাকরাইলকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে দওবন্দের সাথে সুরাহা ছাড়া মাওলানা সা’দ সাহেবকে বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম গ্রহন করবেন না ৷ সেইসাথে আলমী শূরাকেও মেনে নিতে হবে, এছাড়া সমঝোতার আর কোনো পথ নেই ৷