ড. আবদুস সালাম আজাদি :
কথাটা গল্পচ্ছলে আমাদের ক্লাসে বলেছিলেন ড. আব্দুল বাসেত বদর। যিনি আরব বিশ্বের খ্যাতনামা সাহিত্যসমালোচক ও ইসলামী পণ্ডিত।
তিনি তার মিষ্টি অথচ অর্গলভেদী, বর্ণনামূলক অথচ কাব্যিক ঢংগে ক্লাসে বলে চলেছেন এক মহান ব্যক্তির কথা। আর আমরা গোগ্রাসে না হলেও মোহাবিষ্টের মতো তার কথাগুলো গিলে খাচ্ছি। তার সুচয়নিত শব্দের ঝংকারে হোক বা সেই ব্যক্তিত্বের নিষ্পাপ চেহারার কথা মনে করে হোক আমাদের নয়ন দিয়ে পানির ঝরণা বেয়েছে অস্থির মুখাবয়বে।
বললেন, ছুটি কাটাতে নানা দেশে যেতাম। ক’বন্ধু সেবার ভাবলাম ভারতে যাবো। আমি, ড. হাবান্নাকাহ ও ড. ইমাদুদ্দীন খলিল। খুব সুন্দর হাদিয়া কিনলাম আমাদের প্রিয় মানুষটির জন্য। গেলাম। ঐ দিনেই গেলাম বন্ধুর কাছে। তিনি নাদওয়াতুল উলামার দেয়া সুযোগ না নিয়ে তার ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রুমে ঢুকলাম। যে খাটে তিনি থাকতেন তাকে রূপক অর্থে খাট বলে। নড়াচড়া করছে দেখে নিচে চোখ দিলাম। তিনটি পায়া অক্ষত, একটা ভাঙ্গা, কিছু ইট দিয়ে নকল পায়া লাগানো। আমি সৌম্যমূর্তির আমার শায়খের দিকে তাকালাম। লক্ষ টাকা যার পায়ের কাছে পড়ে থাকে প্রতিদিন অনাহারী বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের খাওয়ানো বা শিক্ষকদের বেতনের জন্য। যার হাতে টাকা দিতে পৃথিবীর বড় বড় কোটিপতিরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তার খাটের দৈন্যদশা আমার চোখে পানি নিয়ে এলো।
কথা হলো, বন্ধুর সাথে বন্ধুর, শায়খের সাথে ছাত্রের, জেনারেলের সাথে সহযোদ্ধার। আমি হিসেব করলাম তার সারা ঘরের জিনিসপত্রের দাম। দামী জিনিসের মধ্যে ভারতে নির্মিত একটা অতি কম দামের টেলিফোন, চায়নায় তৈরি খুব পুরাতন একটা ফ্যাক্স মেশিন, আর কিছু ভালো ভালো বই। সবচেয়ে যত্নে আছে কুরআন মাজিদটা তার পাশেই। বুঝাই যাচ্ছে শায়খের হাতের ছোঁয়ায় কুরআন কত খুশী। আমি গুনলাম, কানলাম আর ভাবলাম সব মিলিয়েও কি একহাজার রিয়ালের সম্পদ হবে এই ঘরটিতে?!
আবুল হাসান আলী নদভী ছিলেন সেই রকম একজন সালাফের উত্তরসূরি যাকে দেখে সাহাবীদের না দেখতে পারার অভাব পূরণ হয়েছে। আমি ও ড. আবুল কালাম আজাদ মদীনায় তার সাথে দেখা করেছি। তার ছাত্রের ছাত্র ছিলাম আমরা; কিন্তু তিনি আমাদেরকে মনে করেছিলেন তার আপন ছেলে। আমার বুকে লাগা তার বুকের সেই উষ্ণতা জীবনের এ পড়ন্ত বেলার শরীরে যেন জান্নাতী সুরভী ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কষ্ট পাবেন না তাকে সাহাবী চরিত্রের বলেছি বলে, আমি বুঝে-শুনে বলেছি। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিনের জুমাবারে তিনি ইন্তেকাল করেন। সাধারণত তিনি জুমাবারে সূরা কাহাফ পড়তেন, সেদিন তিনি ভুল করে হোক অথবা ইচ্ছে করে হোক সূরা ইয়াসিন পড়েছিলেন; আর ইয়াসিন নিয়েই তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। রাহিমাল্লাহু আবাল হাসান।
ঈষৎ সম্পাদিত।