|
পৃথিবীর আর কোথাও শুনিনি সংলাপকে রাজনীতিকেরা ভয় পান। কিন্তু বাংলাদেশে পাচ্ছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত। বিরোধী দল বিএনপি যখন রাষ্ট্রপতির এই অভিপ্রায়কে স্বাগত জানিয়েছে, তখন আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করতেই হবে। সাধারণ সম্পাদকসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনার প্রয়োজন নেই। তঁাদের ভাবসাব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আলোচনা বা সংলাপ একটি খুবই খারাপ কাজ। এটি যত পরিহার করা যায় ততই মঙ্গল।
আওয়ামী লীগ নেতারা এ-ও স্মরণ করিয়ে দেন যে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তারা আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। অতএব এখন তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হতে পারে না। অতীতে বিএনপি আলোচনায় আসেনি বলে রোজ হাশরের আগে তাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না, এটি যুক্তির কথা নয়। জেদের কথা। আমরা যদি ধরেও নিই যে বিএনপি সেই সময়ে আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে ভুল করেছিল, তাহলে এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করা কি শুদ্ধ হতে পারে? আলোচনার দরজা বন্ধ করা কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী যে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সেটি ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে। এখন আলোচনা হবে আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচন এবং সেই নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে কমিশন গঠন করা হবে, তা নিয়ে। ক্ষমতাসীনেরা যদি সেই নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে চান, তাহলে আলোচনা করতে আপত্তির কী আছে? আলোচনার টেবিলে বসে আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁদের যুক্তি তুলে ধরুন, বিএনপি নেতারা তাঁদের যুক্তি তুলে ধরবেন। প্রয়োজনে সেটি সরাসরি টিভিতেও দেখানো যেতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যম সারির নেতারা তো প্রায় প্রতিদিনই টিভি টক শোতে কথা বলছেন। যে কথা তাঁরা টিভিতে বলতে পারেন, সে কথা নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসা যাবে না কেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক আশ্চর্য ঘটনাই ঘটে, আলোচনায় না বসার জন্য ধনুর্ভঙ্গপণও এ রকম একটি আশ্চর্য ঘটনা। ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের সঙ্গে বসতে পারে, কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান কথা বলতে পারে, কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনা হতে পারে না!
তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে রাখতে হবে যে আলোচনার বিকল্প হলো শক্তি প্রদর্শন। সংঘাত-সংঘর্ষ। আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও। বাসে-ট্রাকে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা। এক নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। সারা দেশে ধরপাকড় হবে। নেতা-নেত্রীরা জেলে যাবেন। আবার সেই নৈরাজ্যকর অবস্থার সুযোগে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাতে রাজনীতিকদের জেদ বজায় থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ, অর্থনীতি ও উন্নয়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা না করার পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রধান যুক্তি হলো, বিএনপি রাজাকারের দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কুঠারাঘাত করেছে। কিন্তু এই কাজটি কী শুধু বিএনপি করেছে? সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির মন্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন উপদেষ্টা। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদই তাঁকে মন্ত্রী করেন।
আগে-পরে যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন, যে স্বৈরাচারের হাত সেলিম, দেলোয়ার, তাজুল, নূর হোসেন, মিলন, বসুনিয়া, ময়েজউদ্দিনসহ অসংখ্য মানুষের রক্তে রঞ্জিত, সেই স্বৈরাচারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা দেশ শাসন করবেন? তাঁকেই ক্ষমতার ভাগীদার করবেন? রাজাকারের সঙ্গে হাত মেলানো গর্হিত অপরাধ হলে, পতিত স্বৈরাচারকে কোলে টেনে নেওয়াও পুণ্যের কাজ নয়।
আওয়ামী লীগের যে নেতৃত্ব মনে করেন মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর দোসর বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, তাঁদের অনুগ্রহ করে নিজের সঙ্গে সংলাপ করতে বলব। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ‘দিনবদলের সনদ’ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে দুটি সনদ দিয়েছিল। তারা রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছিল। এসব ঘোষণায় অনেক ভালো ভালো কথা আছে, কিন্তু গত আট বছরে সরকার কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে বা পারেনি, সেটি নিয়ে একটি সংলাপ হতে পারে।
যেকোনো বৃহৎ প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী প্রভাব যাচাই করতে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নিজের সঙ্গে সংলাপের পাইলট প্রকল্প হতে পারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও টাঙ্গাইল। দুই জেলার আওয়ামী লীগ কমিটি থেকে দুটি প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নেতৃত্ব কমিটির উপদেষ্টা ছায়েদুল হককে অব্যাহতি দিয়েছিলেন কয়েক মাস আগে, যিনি একজন পূর্ণ মন্ত্রীও বটে। আর টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগও সম্প্রতি সাংসদ আমানুর রহমান রানা ও তাঁর তিন ভাইকে বহিষ্কার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
সাংসদ রানা বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে আছেন। কিন্তু তাঁর দুষ্কর্ম এখানেই শেষ নয়। সেই কারাগারে বসেও এই সাংসদ আরেক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যার জন্য ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। ভাগ্য ভালো ওই ছাত্রলীগ নেতা গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু ফারুক আহমদ বাঁচতে পারেননি। সাংসদ রানাকে আদালতে নেওয়া হলে মাননীয় বিচারকের অনুমতি নিয়ে ফারুক আহমদের স্ত্রী তাঁকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তুই আমাকে বিধবা করলি কেন?’
আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি ও মন্ত্রী একে অপরকে দুষছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগে একাধিক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঘটনার শিকার অসহায় রসরাজ দাস জামিন পেলেও মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে সংলাপে অস্বীকৃত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ওই দুই জেলার সাধারণ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংলাপ করলে অনেক নির্মম সত্য বেরিয়ে আসবে।
এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দুটি পড়ে দেখলেই পরিষ্কার হবে জনগণের কাছে তারা কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে? আগে অভিযোগ শোনা যেত যে আগেরবার সরকার দেশে প্রভূত উন্নতি করলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় এসে সেটি ভন্ডুল করে দিয়েছে। কিন্তু এবারে আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই নালিশ করার সুযোগ নেই। অর্থমন্ত্রী বৃহস্পতিবার এক সেমিনারে বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনটি নাকি ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ হয়েছে এবং বিএনপি সেই নির্বাচনে এলে জিততেও পারত।’ তাহলে বলতে হয়, বিএনপি নির্বাচনে না এসে আওয়ামী লীগকে সুবিধা করে দিয়েছে। সে জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিএনপির প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত নয় কি?
যেকোনো সরকারের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নও জরুরি। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশ অপরিহার্য। আওয়ামী লীগের বিঘোষিত নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ১.১ ধারায় বলা হয়েছিল, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান, তাদের কাজের ও চলাফেরার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে। ১.২ ধারায় রয়েছে, ‘সংবিধান সুরক্ষা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা হবে।’ ১.৩ ধারায় উল্লেখ ছিল, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সিভিল সমাজসহ দলমত-নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আরও বলা হয়েছিল, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গৌরব সমুন্নত রাখা হবে এবং সব ধর্মের সমানাধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও উপজাতিদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ধর্মীয় ও জাতিসত্তার সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে।’ বাস্তবে আমরা তার উল্টোযাত্রাই লক্ষ করছি।
তাই বলব, আওয়ামী লীগ অন্য কারও সঙ্গে সংলাপ না করুক অন্তত আয়নায় নিজের মুখ দেখুক। নিজের সঙ্গে সংলাপ করুক। দলের গঠনতন্ত্রে কী আছে এবং কীভাবে দল চলছে, সেটিও তারা পরখ করে দেখুক। মন্ত্রী-সাংসদ-নেতা পাতি নেতা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে সংলাপ করুন।
আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে সংলাপে অনাগ্রহী। কিন্তু নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কি সংলাপ হয়? আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের মধ্যে কি সংলাপ হয়? যুবলীগের মধ্যে কি কোনো সংলাপ হয়? আমরা প্রায়ই ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের চাপাতি, কিরিচ, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি। কিন্তু সংলাপ করতে দেখি না। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যকার বিরোধ মেটাতে দলের সাধারণ সম্পাদক প্রাতরাশ বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু তাতে গ্রুপিং কমেছে বলে মনে হয় না। সেখানে এখনো ছাত্রলীগের দুই পক্ষ দুই নেতার পক্ষ হয়ে মুখোমুখি অবস্থানে। এটি কেবল চট্টগ্রামের দৃশ্য নয়, সারা দেশের।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে বিজ্ঞানমনস্ক একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি চালু করে বাহবা নিয়েছিল। দেশের প্রগতিশীল লেখক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীরা এই শিক্ষানীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় বছর পর এসে আমরা দেখি, সেই শিক্ষানীতির আলোকে প্রণীত পাঠ্যবইয়ে হেফাজতে ইসলাম নামে মৌলবাদী সংগঠনটি যেসব লেখার বিষয়ে আপত্তি করেছে, তার সবই বাদ দিয়েছে। এটি কি মৌলবাদের প্রতি সেক্যুলার ও মুক্তিযুদ্ধের সরকারের আত্মসমর্পণ নয়? আওয়ামী লীগের আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় এবার হেফাজতের আঁচড় পড়েছে। এ কারণে দেশের ৩৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক শিক্ষাব্যবস্থাকে হেফাজতীকরণের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com