তানজিল আমির :
পৃথিবী থেকে চলে যাওয়াটাই আসল। পৃথিবীতে কেউ ইচ্ছে করলেও থাকতে পারবে না। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটি অবধারিত। এক নির্ণম সত্য। গত ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ রোজ সোমবার মাগরিবের কিছুপর (বাংলাদেশ সময়) ইন্তিকাল করেন শায়খুল আরব ওয়াল আজম হজরত আবদুল হাফিজ মক্কী রহ.। এ মহান ব্যক্তির ইন্তেকাল গোটা বিশ্বের মুসলমানের জন্য দুঃখের। তিনি ছিলেন গোটা ইসলামি বিশ্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার আলোয় আলোকিত হতো লক্ষ মানুষ। জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও শৈশবেই তার পিতা স্বপরিবারে মক্কায় হিজরত করেন। শায়খুল হাদিস জাকারিয়া র. এর সাহচর্যে হজরত আবদুল হাফিজ মক্কী রহ. পরিণত হন এক আলোকিত মানুষে। পুন্যভূমি মক্কার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে তিনি আকাবিরে দেওবন্দের মাসলাককে আরবদের সামনে ফুটিয়ে তুলেছেন স্বার্থকভাবে।
হজরত আবদুল হাফিজ মক্কী রহ. ছিলেন সর্বমত ও সর্বপন্থার সমন্বয়ক। ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও কর্মে মধ্যপন্থা ছিলো তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য। উদারতা ছিলো তাঁর স্বভাবজাত। পিতার সুবাদে হযরতজি ইলিয়াস রহ. এর খান্দান ও তাবলিগের সাথে সম্পর্ক ছিলো শৈশবকাল থেকে। মক্কার বিখ্যাত সওলতিয়া মাদরাসায় দীর্ঘদিন বুখারি পড়িয়েছেন।
শায়খুল হাদিস জাকারিয়া রহ. এর নিকট আধ্যাত্মিক দীক্ষা হয়। তার হাত ধরে পৌঁছেছেন তাসাওউফের উচ্চ মর্যাদায়। দীনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন আলোকমশাল। তালিম,তাবলিগ,তাজকিয়া, জিহাদ প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রম ও অবদান রয়েছে। দীন প্রচারে ছুটে বেড়াতেন দেশ হতে দেশান্তরে। তিনি ছিলেন মক্কা মুকাররমার তাবলিগের আমির ও বিশ্ব তাবলিগের আন্তর্জাতিক শুরা সদস্য। খতমে নবুওয়তের আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজুড়ে।
দীনি দাওয়াতের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ ছিলো হজরত রহ. এর অন্যতম পছন্দের দেশ। বিশ্বের যে কটি দেশে তিনি বেশি সফর করতেন, বাংলাদেশ তার অন্যতম। আগে কয়েকবার হজরতের আগমন হলেও ২০১০ সনের পর থেকে বাংলাদেশ সফর নিয়মিত হয়েছে। বাংলাদেশে কয়েকজন আলেম হজরতের হাতে বাইয়াতও ছিলেন। ২০১১ সনে বরেণ্য আলেম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ দা.বা. এর আমন্ত্রণে রমজানের ইতিকাফ করেন। এ সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের আলেম সমাজ হজরতের পরিচয় লাভ করেন। সে রমজানে ইকরার মসজিদে বিভিন্ন শ্রেণির আলেমগণ দলে দলে আগমন করেন। কাকরাইল মসজিদ থেকে তাবলিগের শীর্ষ দুই মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের সাহেব ও মাওলানা রবিউল হক সাহেব হজরতের খেদমতে ছুটে আসেন। বড় বড় আলেমগণ বাইয়াত গ্রহণ করেন হজরতের হাতে। এ বছরই রাজধানীর ওসমানী স্বৃতি মিলনায়তনে শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী র. কে প্রধান অতিথি করে আন্তর্জাতিক একটি সেমিনার আয়োজন করেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। বর্তমান রাষ্ট্রপতি তৎকালীণ স্পিকার এ্যডভোকেট আবদুল হামিদ সে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ব্যক্তিও উপস্থিতি হয়। হজরতের দিকনিদের্শনামূলক ভাষণ বেশ প্রশংসীত হয়েছিলো। এ বছরের শেষের দিকে হজরত আবার ঢাকা সফরে আসেন । রাজধানীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কয়েকটি ইসলামে মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে আসল অলঙ্কৃত করেন। তখন সম্ভবত দুদিন বিমানবন্দর বাবুস সালাম মাদরাসায় অবস্থান করেছিলেন। সেবারও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে ওলামায়ে কেরামগণ দলে দলে ছুটে আসেন হজরতের খেদমতে। এ সময়ই জামিয়া রাহমানিয়ার মুহতামিম মুফতি হিফজুর রহমান, ঢালকানগরের মুহতামিম মুফতি জাফর সাহেবসহ বহু ওলামায়ে কেরাম নতুন করে হজরতের তাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। এর আগে জামিয়া রহমানিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা নোমান আহমদ রহ., ড. মুশতাক আমদ দা.বা.সহ আরো কিছু আলেম হজরতের খেলাফত লাভ করেন। এ অধমও হজরতের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করে। মূলত শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ আলেমের মুরব্বির মর্যাদা লাভ করেন।
হজরত ২০১২ ও ২০১৩ সনে ইজতেমা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আসেন। পাশাপাশি ইসলাহি সফরও অব্যহত রাখেন। টংগী ইজতেমায় হজরতের কামরা ছিলো নিজামুদ্দিনের মুরব্বিদের কামরার পাশে। ২০১৩ সনে বিমানবন্দর বাবুস সালাম মাদরাসায় শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী হাদিসে মুসালসালাতের দরস প্রদান করেন।
২০১৪ সনের সফরটি ছিলো হজরতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাদিয়ানি মতবাদের মূলোৎপাটন ও তাদের সহি পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের আকাবিরগণ দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। আকাবিরে উম্মতের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেহে শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী র.ও নিজেকে এ পথে উৎসর্গিত করেন। তিনি আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মুভমেন্টের আমির ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে তিনি ছুটে যেতেন কাদিয়ানিদের সঠিক পথের দাওয়াত দিতে।
পাঠককে একটি তথ্য জানানোর প্রয়োজনবোধ করছি। গত জোট সরকারের আমলে আমাদের দেশে কাদিয়ানি বিরোধী ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিলো। আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে বিশাল অর্থের প্রয়োজন হয়েছিলো তার সিংহভাগই দিয়েছিলেন আবদুল হাফিজ মক্কী রহ.। হজরতের তত্ত্বাবধানে বনশ্রীতে প্রতিষ্ঠিত হয় খতমে নবুওয়ত মারকাজ বাংলাদেশ। রাজধানীর বনশ্রী কেন্দ্রীয় মসজিদে এক বৃহস্পতিবার রাতে এর শুভসূচনা হয় শায়খ মক্কীর হাত ধরে।
শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী রহ. এর সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর ছিলো গতবছর অর্থাৎ ২০১৬। এ বছর তিনি দশ দিনের সফরে বাংলাদেশ আসেন। ঢাকা, কুমিল্লা, বি-বাড়িয়া জেলায় কয়েকটি ইসলামি মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। গত সফরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলো হজরতের চরমোনাই গমনের বিষয়টি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত চরমোনাইর বার্ষিক মাহফিলে শায়খ মক্কীকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানান পীর সাহেব চরমোনাই ও তার ভ্রাতাগণ। ওলামায়ে কেরামের বিশাল জামাত সাথে নিয়ে হজরত চরমোনাই মাহফিলে অংশ নেন। মাহফিলের প্রথম দিন বাদ মাগরিব লাখো মুসল্লির উদ্দেশ্যে বয়ান পেশ করেন। চরমোনাইর পীর সাহেব ও তাদের ভক্তকূল সেদিন আপ্লুত হয়েছিলো হজরতকে কাছে পেয়ে। মাহফিলে নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো হজরতের আগমন।
শায়খ আবদুল হাফিজ মক্কী রহ. এর সাথে সব সময় আলেম ও সালিকদের বিশাল জামাত থাকতো। হজরতের আান্তরিকতা, কাছে টেনে নেওয়ার অপার ক্ষমতা মুগ্ধ করতো সকলকে। ছোট কোনো ছাত্র বা সাধারণ মানুষ দেখা করলেও হযরত তাকে খুব মূল্যায়ন করতেন। কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। আগামি ফেব্রুয়ারিতে হজরতের বাংলাদেশ সফর নির্ধারণ হয়েছিলো। সফরসূচিও ছিলো প্রস্তুত। কিন্তু পুরো উম্মাহকে কাঁদিয়ে হজরত রওয়ানা হয়েছেন জীবনের মহাসফরে। রফিকে আলার সাণ্নিধ্যে। আল্লাহ আমাদের হজরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আলা’ মাকাম দান করুন। হজরতের অসমাপ্ত কাজগুলো চলুক অব্যাহত গতিতে। করুণাময়ের কাছে এই প্রত্যাশা।
লেখক : তরুণ আলেম ও সাংবাদিক