মুহাম্মদ নোমান :
কায়রো, মিসর।
মরুভূমির চোরাবালিতে আপনি আটকা পড়েছেন। প্রতিমুহূর্তে একটু একটু করে গেঁড়ে যাচ্ছেন। দুহাত প্রসারিত করে পাশের বালিতে ভর দিয়ে পতন ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। আপনার অবস্থা দেখে এক বিশালকায় বোকা বন্ধু আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসলো। তার পায়ের চাপে আপনার হাতের নিচের মাটিটুকুও সরে গেলো। ব্যাস, আপনি আর আপনার বন্ধু দুজনই ইতিহাস হয়ে গেলেন।
এক লোকের সাথে এক ভল্লুকের বন্ধুত্ব ছিল। একদিন লোকটি ঘুমাচ্ছিল। তার পাশেই ছিল ভল্লুকটি। একটি মাছি বারবার তার মুখের উপর বসছিল আর তার ঘুমে ডিস্টার্ব করছিল। ভল্লুক বেচারা চিন্তা করতে লাগলো কীভাবে তার বন্ধুকে এই বেয়াদব মাছির জ্বালাতন থেকে মুক্তি দেয়া যায়। পাশ থেকে বিশাল এক পাথর কুঁড়িয়ে নিয়ে আসল। ব্যাস, তারপর বাকীটা ইতিহাস।
আঙ্কারায় রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কার্লোভ হত্যার বিষয়টি যদি বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাঁচে না ঢুকে সহজে বুঝে নিতে চান। অথবা যদি মনে করে থাকেন যে, হত্যাকারী ইসলামের একজন মুজাহিদ। সে বীরের মতো একটা কাজ করেছে। লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। মাজলুমদের অন্তরকে ঠাণ্ডা করেছে। তাহলে তার এই জিহাদের মাজেযা বুঝতে উপরের কাহিনীদুটি আপনাকে সাহায্য করবে।
আপনি যেভাবে বুঝতে চাচ্ছেন ঘটনা যদি বাস্তবেই সেরকম সহজ হতো তাহলে বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবার প্রয়োজন হতো না। আমাদের মুজাহিদীনদের আরও দশটি জিহাদি কম্মের মতো এটাকেও মারহাবা বলে স্বাগত জানিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা তো এখানেই যে, আপনি যতো তরল করে সরলভাবে বুঝতে চাচ্ছেন আদতে ঘটনাটি সেরকম নয়।
বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী যে কোন ঘটনার শেকড় অনুসন্ধান করার মূলনীতি হচ্ছে দুটি। (১) নিখুঁতভাবে ঘটনার সময়টা বুঝার চেষ্টা করা। (২) ঘটনা থেকে উপকৃত পক্ষগুলো কারা- তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করা। ট্রিগার কে চাপল? তার পরনে কী কী ছিল? তার মুখে দাঁড়ি ছিল কি-না? “আল্লাহু আকবর” কয়বার বলেছে? এই বিষয়গুলো এখানে খুবই গৌণ।
রাষ্ট্রদূত হত্যার সময়কাল এবং এর দ্বারা উপকৃত হবে এমন পক্ষ কারা- তা বুঝতে হলে কয়েকটি পয়েন্টের উপর দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
এক.
তুরস্ক ও রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবেই দুটি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। খেলাফাতে উসমানীয়া এবং জার সাম্রাজ্যের মধ্যে ১৭ টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জয়-পরাজয়ের পাল্লা কোনোসময় এদিকে আবার কোনোসময় ঐদিকে ঘুরত। সর্বশেষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দুই দেশ একে অপরের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের পর খেলাফাতের পতন ঘটলে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে আসে। কিন্তু মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব আবার পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তোলে। স্ট্যালিন বসফরাসের উপর রাশিয়ার অধিকার দাবী করে বসে। তুরস্ক রুশ হুমকি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ১৯৫২ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। এরপর চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের সম্পর্ক অপরিবর্তিত থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে মধ্য এশিয়ার সদ্য স্বাধীন হওয়া তুর্কি উপজাতীয় রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে দুদেশের সম্পর্ক আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এরপর ২০০২ সালে এরদোগানের নেতৃত্বে এ-কে পার্টি ক্ষমতায় আসলে ধীরে ধীরে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। তুরস্ক রাশিয়ার সাথে দ্রুত তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করে। তুরস্ক রাশিয়ার কৃষিজাত পন্যের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা হয়।রাশিয়ার নির্মাণ ও প্রকৌশল বাজার তুর্কি কোম্পানিগুলো দখল করে নেয়। বিপরীতে রাশিয়া তুরস্কের প্রধান জ্বালানি রপ্তারকে পরিণত হয়। মধ্যএশিয়ায়ও দুদেশের রাজনীতি অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ হয়ে আসে। এভাবেই চলে আসছিল।
কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে সেই সম্পর্ক আবারও হুমকির মুখে পড়ে। তুরস্ক রাশিয়ান আগ্রাসনের নিন্দা জানায় এবং এতে সিরিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এরই মধ্যে ঘটে এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। দুটি তুর্কি যুদ্ধবিমান একটি রুশ যুদ্ধবিমানকে তাড়া করে ভূপাতিত করে। রুশ বিমানটি তুরস্কের সীমানা অতিক্রম করেছে বলে তুরস্ক দাবী করে। কিন্তু রাশিয়া তুরস্কের এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবী হচ্ছে তুরস্ক সিরিয়ার সিমান্তে ঢুকে রুশ বিমানটি ধংস করে। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও পদক্ষেপে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। এই ঘটনার ফলে তুরস্ক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে তুরস্কের সম্প্রসারমান অর্থনীতি চরমভাবে হোঁচট খায়। তুরস্কে রাশিয়ান পর্যটকদের আগমন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। আর রাজনৈতিকভাবে সিরিয়ায় তুরস্কের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। রাশিয়ার এস-৩০০ আর এস-৪০০ এর হুমকির কারণে সিরিয়ায় তুরস্কের বিমান উড্ডয়ন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এতে তুরস্ক তিনটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। (১) প্রতিশোধ নিতে রাশিয়া সিরিয়ার তুর্কি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করে। কিন্তু তুরস্ক তার জ্ঞ্যাতীভাইদেরকে রক্ষা করার জন্য কিছু করতে পারেনি। (২) তুরস্কের অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে কুর্দিরা তাদের প্রভাবকে আরও সম্প্রসারণ করে এবং পূর্ব ও উত্তর সিরিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল করে তুরস্কের অখণ্ডতাকে চরমভাবে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। (৩) সিরিয়ান বিপ্লবীদের প্রতি তুরস্কের সহায়তা চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। এর সুযোগ নেয় আসাদ আর ইরান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তুরস্ক কোণঠাসা হয়ে পড়ে। জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে রাশিয়া তুরস্ককে সন্ত্রাসের মদদদাতা হিসেবে প্রচার করে। পশ্চিমা মিডিয়াগুলো আগে থেকেই এই অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল। এখন রাশিয়ার যোগদানে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠে।
রুশ-তুর্কি সম্পর্কের অবনতিতে রাশিয়াও অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি এমনিতেই ধংসের দ্বারপ্রান্তে। তাদের এই দুর্দিনে তুরস্ক ছিল তাদের সহায়ক শক্তি। এখন তুরস্কের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের অর্থনীতি আরও ভঙ্গুর হয়ে উঠে।
পরে প্রমানিত হয় যে, রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার সিদ্ধান্ত তুর্কি সরকারের ছিল না। প্রেসিডেন্ট বা সেনাপ্রধান কেউই এই অপরিণামদর্শী কাজের নির্দেশ দেয়নি। বরং সেনাবাহিনীতে ঘাপটিমেরে থাকা গুলেনপন্থীরাই বাইরের শত্রুদের ইশারায় এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যাতে রুশ-তুর্কি দুপক্ষকে মুখোমুখি করে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখী শিকার করা যায়। ঘটনার আসল চিত্র সামনে আসার পর দুপক্ষই বুঝতে সক্ষম হয় যে, দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এইরকম সাপে নেউলে সম্পর্ক কোন পক্ষের জন্যই কল্যাণকর নয়। তাই দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সূর নরম করে। ঘটনার জন্য তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে। ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে।
এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কুচক্রীরা (আমেরিকা ও তার দেশীয় এজেন্টরা) আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। তারা এরদোগানকে বাগে আনতে না পেরে তাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ই জুলাই গুলেন নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় এরদোগানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা চালায়। এরদোগানের বিশাল জনপ্রিয়তা ও দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে তাদের সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় রাশিয়ার পদক্ষেপ ছিল খুবই ইতিবাচক। পুতিন ক্যুর রাতেই ফোন করে এরদোগানকে আশ্বস্ত করে এবং গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি রাশিয়ার পূর্ণ সমর্থন ব্যাক্ত করে। এতে রুশ-তুর্কি সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। এর কিছু দিন পর এরদোগানের রাশিয়া সফরের মাধ্যমে সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নকে তুরস্ক রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সিরিয়ায় তাদের হারানো প্রভাব পুনরুদ্ধার করার জন্য রাশিয়ার সাথে বুঝা পড়ার মাধ্যমে সিরিয়ায় সরাসরি সামরিক অভিযান শুরু করে। ‘জারাবলুস’ এবং ‘বাব’ শহরদুটি দখল করে কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আপাতত রুখে দিতে সক্ষম হয়। এভাবে সিরিয়ার ভাঙ্গন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হতে দেখে আমেরিকা ও ইসরাইল তুরস্কের উপর চরমভাবে ক্ষেপে উঠে। আর তাই তুর্কি-রুশ সম্পর্কে আবারও ফাটল ধরানো তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। “তারপর আঙ্কারায় রুশ রাষ্ট্রদূত নিহত হয়”।
দুই.
পঞ্চাশ বছর ধরে তুরস্ক ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে ইইউর সদস্যপদ লাভ করা তুরস্কের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এতে দুপক্ষেরই লাভ। তাই তুরস্ক ইইউর শর্তানুসারে রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিচারব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করেছে। এর সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু তুরস্কের শত প্রচেষ্টার পরেও তাদের প্রতি ইইউর বিমাতাসুলভ আচরণে কোন পরিবর্তন আসেনি। ইইউ বিভিন্ন টালবাহানার মাধ্যমে তাদের দরজা তুরস্কের সামনে বন্ধ করে রাখে। আসল কথা হচ্ছে ইইউ একটি অল ক্রিশ্চিয়ান ফোরাম। সেখানে তারা তুরস্কের মতো একটি মুসলিম শক্তিকে কোনোদিনই গ্রহণ করবে না। ভিয়েনা আর বুদাপেস্ট পর্যন্ত যারা ইয়োরোপীয়ানদেরকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাদেরকে কোনোভাবেই ইইউ তাদের আঙিনায় আমন্ত্রণ জানাবে না। কিন্তু ইইউ তুরস্কের সাথে “মুয়াবিয়ার চুল নীতি” গ্রহণ করে। সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্নও করে না, আবার আবার আলোচনায়ও কোন ইতিবাচক মনোভাব দেখায় না। আন্তর্জাতিক কোন ইস্যুতে তারা তুরস্কের পক্ষ নেয় না। সর্বশেষ ব্যর্থঅভ্যুত্থানে ইইউর প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। তারা জোর গলায় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা তো জানায়নি, উল্টো এই ঘটনায় তাদের ভাষায় ‘গণগ্রেপ্তারের’ নিন্দা জানায়। মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে তুরস্ককে অভিযুক্ত করে।
ইইউর এমন দ্বৈতনীতিতে তুরস্ক চরমভাবে ক্ষুদ্ধ হয়। এরদোগান চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে যোগ দেবার হুমকি দেয়। রাশিয়া ও চীনের সাথে এই ব্যপারে আলোচনাও শুরু করে। রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া মিলে। এতে ইইও নড়েচড়ে বসে। তারা এরদোগানকে বাহ্যিকভাবে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু পর্দার আড়ালে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজার চেষ্টা করে। ইইউ নেতাদের বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার খাতিরে তুরস্কের পূর্বমুখী নীতির লাগাম টেনে ধরা দরকার। রুশ-তুর্কি ক্রমবর্ধমান সম্পর্কে ফাটল ধরানো ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোন পথ খোলা নেয়।
তিন.
সিরিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনে তুরস্কের সমর্থন প্রদান গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। তবে, এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে- তুরস্ক ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে, সিরিয়া সংকটের লাগাম যাদের হাতে তারা কেউই আসাদের পতন চায় না। সিরিয় জনগণের দাবীর প্রতি তাদের বিন্দুমাত্রও সহানুভূতি নেই। তারা বরং নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই ইস্যুটি নিয়ে খেলছে। এই বহুমুখী যুদ্ধে তুরস্ক সম্পূর্ণ একা। এমনকি আরব রাষ্ট্রগুলোও তার পাশে নেই। আর এতোগুলো পক্ষের বিরুদ্ধে এককভাবে লড়াই করাও তুরেস্কের সাধ্যের বাইরে। তাই তুরস্ক তার নীতি দ্রুত পরিবর্তন করে। আমেরিকার দিকে আর তাকিয়ে না থেকে নিজেই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়। আপাতত দুটি লক্ষ্য তারা নির্ধারণ করে। (১) রাশিয়ার সাথে বুঝাপড়ার মাধ্যমে সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষা করা। উত্তর সিরিয়ায় কুর্দিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মার্কিন-ইসরাইলী প্রচেষ্টাকে রুখে দেয়া। (২) রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সিরিয়া যুদ্ধের দ্রুত অবসান ঘটানো। সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা। সিরিয়ার বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে যতোটুকু পারা যায় ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। হালাবের পরিণতি তাদের ইচ্ছাকে আরও দৃঢ় করে। আর এই কাজটি রাশিয়া ও ইরানের সম্মতি ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইরান পোড়ামাটিনীতি গ্রহণ করেছে। তারা সিরিয়াকে পুরোপুরি সুন্নিমুক্ত করতে চায়। আর রাশিয়া হচ্ছে ইরানকে থামানোর তুরস্কের একমাত্র ট্রাম্পকার্ড। তুরস্ক সেটা খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহারও করে। তারা পূর্ব হালাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে রাশিয়ার মাধ্যমে ইরানের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত ইরান তা মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং হালাবের দুই লক্ষ বাসিন্দা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। হালাবের আংশিক সাফল্য তুরস্ককে আরও আশান্বিত করে তোলে। তারা গোটা সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে রাশিয়াকে রাজী করায়। এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ২০শে ডিসেম্বর মস্কোতে তুরস্ক, রাশিয়া ও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের কথা ছিল।
অতএব, যারা সিরিয়া সংকটের দ্রুত সমাধান চায় না, তাদের জন্য তুরস্কের এই প্রচেষ্টাকে থামানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি তুরস্ককে এই বার্তাও দেয়া দরকার যে, বিশ্বরাজনীতির কোন সংকট এককভাবে সমাধান করার যোগ্যতা এখনও তার হয়ে উঠেনি, অথবা তা তারা করতে দিবে না।
চার.
তুর্কি-ইরান সম্পর্ক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ইরানের সাফাভী সালতানাত ছিল খেলাফাতে উসমানীয়ার চরম শত্রু। সাফাভী শিয়ারা উসমানীদের বিরুদ্ধে লেগেই থাকতো। খেলাফতের প্রত্যেকটা বিদ্রোহের পেছনে এদের হাত থাকতো। উসমানী খলীফা সুলতান সেলিম ক্ষুদ্ধ হয়ে সাফাভীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ২৩ শে আগস্ট ১৫১৪ সালে Chaldiran যুদ্ধে সাফাভীদেরকে পরাজিত করে সাফাভীদের রাজধানী তাব্রীজসহ ইরাক ও আজারবাইজান দখল করেন। কিন্তু তাতেও তাদের শিক্ষা হয়নি। তারা বিভিন্ন ভাবে উসমানীদেরকে উত্যেক্ত করতে থাকে। পরে সুলতান সুলাইমান কানুনি ১৫৩১ থেকে নিয়ে ১৫৫৫ সালের মধ্যে তিনবার পারস্যে অভিযান চালিয়ে আর্মেনিয়া, জর্জিয়াসহ গোটা ককেশাস এলাকা দখল করে পরবর্তী চারশত বছরের জন্য সাফাভী ফিতনাকে নির্মূল করেন। এরপর থেকে ইরান ককেশাস আর আরবের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায়নি।
কিন্তু সময় বদলেছে। উসমানী খেলাফাতও এখন নেই। সাফাভীরাও বিদায় নিয়েছে। কিন্তু উসমানীদের হাতে যেভাবে নাকানিচুবানি খেয়েছিল তা ইরান কোনোদিন ভুলতে পারেনি। পারবেও না। খোমেনীর বিপ্লবের পর ইরান আবারও সাফাভী সাম্রাজ্য পুনর্জীবিত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। আর তাদের এই স্বপ্নের একমাত্র বাধা হচ্ছে চিরশত্রু তুরস্ক। খালিজের রাষ্ট্রগুলো যত হাঁকডাকই করুক না কেন, সাদ্দামের বিদায়ের পর তাদেরকে ইরান তোড়াই কেয়ার করে। এক আব্দুল মালিক হাউসি দিয়েই সৌদিকে ব্যস্ত রেখেছে। তাদের মাথাব্যথা তুরস্ককে নিয়ে। তুরস্ক আর পশ্চিমাদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাতে ইরানের পোয়াবারো। কিন্তু তুর্কি-রুশ সম্পর্কের যে ডায়নামিক মোড় নিয়েছে তাতে খামেনীর কপালের ভাঁজগুলো আরও লম্বা হয়েছে। তুর্কি-রুশ সম্পর্কের একটা দফারফা করা ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যাল্যাঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে, তুরস্কের বিরুদ্ধে নতুনভাবে চটার কারণ হচ্ছে সিরিয়ার সর্বশেষ ঘটনাগুলো। তুরস্ক রাশিয়াকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, ইরান যদিও রাশিয়ার ঐতিহাসিক মিত্র, কিন্তু রাশিয়া এখন আর ইরানের একক মিত্র নয়। সেখানে রাশিয়ার স্থানে ভাগ বসিয়েছে আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। ইরান নিজ স্বার্থে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কে ভারাম্য আনতে আগ্রহী। পশ্চিমাদের সাথে সর্বশেষ পরমানু চুক্তি এবং ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের প্রত্যক্ষ সন্ত্রাসে পশ্চিমাদের নীরবতা পালন তার বড় প্রমাণ। তাছাড়া, সিরিয়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেখানে ইরান রাশিয়ার বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। সম্প্রসারণবাদী শক্তি হিসেবে উভয়েই চাইবে সিরিয়াকে নিজ প্রভাব বলয়ের বাইরে যেতে না দেয়া। এখান থেকে শুরু হবে রুশ ইরান দ্বন্দ্ব। ইরান চাইবে সিরিয়ার ডেমোগ্রাফিক চিত্র পালটে দিয়ে সিরিয়াকে সম্পূর্ণ শিয়া রাষ্ট্রে রূপ দিতে। এইজন্য তারা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর হালাবসহ সুন্নি শহরগুলোতে বিতাড়িত সুন্নি অধিবাসীদের প্রত্যাবর্তনে বাধা দেবে। তার পরিবর্তে শিয়াদেরকে সেখানে পুনর্বাসন করবে। কিন্তু রাশিয়া এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার শুন্যস্থান পূরণ করা। এমনিতেই সিরিয়ায় আগ্রাসন চালিয়ে তারা আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরাগভাজন হয়েছে। তাদেরকে আর নাখোশ করতে চাইবে না।
রুশ-ইরান দ্বন্দ্বের প্রথম পর্ব এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ইরানের দাবী হচ্ছে তুরস্ককে যেকোনো মুল্যে সিরিয়া থেকে দূরে রাখা। রাশিয়া এক্ষেত্রে ইরানকে সমর্থন করছে না। বরং তারা সিরিয়া সংকটের সমাধানের ক্ষেত্রে তুরস্কের অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় মনে করছে। আর তাই ইরানের আপত্তি সত্ত্বেও উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক অভিযানে সমর্থন দিয়েছে। ইরান এতে রাশিয়ার উপর চরমভাবে ক্ষুদ্ধ হয়। কিছুদিন পূর্বে সিরিয়ার ‘বাব’ শহরের কাছে অবস্থানরত তুর্কি সেনাদের উপর ড্রোন হামলা হয়। এতে তুরস্কের চার সৈন্য নিহত হয়। তুরস্ক পাল্টা পদক্ষেপের হুমকি দিলে পুতিন এরদোগানকে ফোন করে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় যে, এই আক্রমনের পেছনে রাশিয়া এবং আসাদের কোন হাত নেই। পরে তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ড্রোনটি ছিল ইরানের। এতে রাশিয়া চরমভাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য শিয়া মিলিশিয়াদের উপর কয়েক দফা বিমান হামলা চালায়। আর ইরানকে সীমালঙ্ঘন না করতে হুশিয়ার করে দেয়।
হালাবের ঘটনা রুশ-ইরান বিরোধকে আরও গভীর করে তোলে। ইরানের লক্ষ্য হচ্ছে কোনোভাবেই হালাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর না করা। সামরিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান করা। কারণ আলোচনার টেবিলে বসলে তাকে কোন না কোন মুল্য দিতে হবে। কিন্তু বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে তারা কোন মুল্য দিতে রাজী নয়। তাই দুই লক্ষ নারী-শিশুকে হত্যা করে হলেও তারা হালাবের দখল নিতে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে রাশিয়া আন্তর্জাতিক চাপ ও তার ভাবমূর্তির দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টায়। তারা হালাবের দুই লক্ষ নাগরিক হত্যার দায় নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেয়ার মতো বোকামি করতে রাজী নয়। তাই তারা ইরানকে বাদ দিয়ে তুরস্কের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এককভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয় এবং অবরুদ্ধ অধিবাসীদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য তুরস্ককে সুযোগ করে দেয়। এতে ইরান ক্ষুদ্ধ হয়ে তার মিলিশিয়াদেরকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করার নির্দেশ দেয়। সাথে সাথে শিয়া মিলিশিয়াগ্রুপগুলো অপসারণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। শতশত পরিবহণ বাসকে হালাবের দোরগোড়ায় আটকে দেয়া হয়। এতে হালাবের অবরুদ্ধ নাগরিকদের অবস্থা আবারও শোচনীয় হয়ে উঠে। ইরানের এই পদক্ষেপে ক্ষুদ্ধ হয়ে রাশিয়া শিয়া মিলিশিয়াদের উপর হামলার হুমকি দেয়। অন্যান্য সেক্টরে যুদ্ধরত আসাদের সৈন্যদেরকে বিমান সহায়তা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। এতে ইরান পিছু হটে। উদ্ধার প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হয়। ইরান তার ইচ্ছে মতো হালাব ইস্যু শেষ করতে না পারার কারণে মনে মনে ক্ষুদ্ধ হয় এবং সবকিছুর জন্য রুশ-তুর্কি সম্পর্ককে দায়ী করে। আর তাই যেকোনভাবে এই সম্পর্কের লাগাম টেনে ধরা ইরানের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। আর সময় মতো দুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছেও পোষে রাখে। এরই মধ্যে “রুশ রাষ্ট্রদূত আঙ্কারায় নিহত হয়”।
রাষ্ট্রদূত হত্যার পরিণতি হবে আরও ভয়ংকর। তুরস্ক দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর একটি। তুরস্কের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হচ্ছে তিনটি। রফতানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পর্যটনখাত। কিন্তু সিরিয়া ও ইরাকের যুদ্ধ পরিস্থিতি এই তিন খাতেই বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিগত দু’তিন মাসের মধ্যে ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রার রেকর্ড পরিমাণ দরপতন ঘটেছে। অর্থনীতি বাঁচাতেই এরদোগানকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তুর্কি লিরার দরপতন কিছুটা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো। উপর্যপুরি বোমা হামলায় এমনিতেই বৈদেশিক বিনিয়োগ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার উপর রাষ্ট্রদূত হত্যার মতো একটি ঘটনা বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পর্যটন শিল্পকে কোথায় নিয়ে যাবে তা সহজেই অনুমেয়।
রাজনৈতিকভাবেও ঘটনাটি তুরস্কের প্রভাবকে ক্ষুন্ন করবে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যু তাদেরকে এতো বেশী ব্যস্ত করে তুলবে যে, ইরাক সিরিয়ার দিকে তাকানোর সুযোগই হয়তো পাবেনা। ইরানের জয়যাত্রা আরও নিষ্কণ্টক হবে। আশার কথা হচ্ছে, রাশিয়া এই ঘটনার জন্য এখনও তুরস্ককে দায়ী করছে না। বরং তারা তুরস্কের “বৈদেশিক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব”কে আপাতত মেনে নিয়েছে। কিন্তু তারা এতো সহজে এই ঘটনাকে হজম করবেনা। যদি তুরস্ককে কোনোরকম সন্দেহ করে বসে, অথবা তুরস্কের অবহেলার প্রমাণ পায় তখন রগচটা পুতিনের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা বলা মুশকিল।
রুশ-তুর্কি সম্পর্কের অবনতিতে কারা লাভবান হবে তার একটি বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত হত্যার মতো এতো বড় পদক্ষেপ নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি বিশেষ নেয়নি। বরং এর নেপথ্যে রয়েছে বড় কোন শক্তি, যারা রুশ-তুর্কি সম্পর্ককে বানচাল করতে চায়। উভয় দেশকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। সম্ভাবনাময় মুসলিমরাষ্ট্র হিসাবে তুরস্কের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চায়। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে চরমভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে চায়।
মুসলিমরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হত্যা জায়েজ না-কি নাজায়েজ তার ফতওয়া কপচানো বালখিল্যতা বৈ কিছু নয়। হালাবে হত্যার একটা যুতসই প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে ভেবে বগল বাজানোর আগে একটু চিন্তা করা দরকার। ভালোমন্দ মিলিয়ে তুরস্কই এখনও পর্যন্ত মুসলিম জাতির সবচেয়ে খাঁটি ও কার্যকর বন্ধু- এই কথাটা আমাদের বুঝা দরকার। তুরস্ককে ধ্বংসের যে কোন প্রচেষ্টায় তালি বাজানোর আগে একবার ভেবে দেখা দরকার।