শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:৩৯
Home / প্রবন্ধ-নিবন্ধ / নিপীড়ক নয়, নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ান
রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে

নিপীড়ক নয়, নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ান

এম আদিল খান : ব্যাংকক পোস্ট ১৪ নভেম্বর লিখেছে, ‘সপ্তাহান্তে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, দুই দিনের লড়াইয়ে ৩০ “বিদ্রোহী” প্রাণ হারিয়েছে। গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালানোর প্রমাণ আছে।’
অন্যদিকে আরেক সংবাদপত্র মিয়ানমার অবজারভার বলেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের ওপর বৃষ্টির মতো বোমা ফেলেছে। এতে অনেকেই মারা গেছেন, বাড়িঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আবার মানুষ যখন জ্বলন্ত ঘরবাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে, তখন তাদের গুলি করা হয়েছে।
সম্প্রতি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় খবর এসেছে, মিয়ানমারের থায়ুঙটন নামের একটি গ্রামের প্রবেশমুখে একটি নতুন সাইন লাগানো হয়েছে: ‘মুসলমানরা এখানে রাত কাটাতে পারবে না। তাদের কাছে বাড়িভাড়া দেওয়া হবে না। তাদের সঙ্গে বিয়েশাদি নয়।’ আল-জাজিরাতেও খবর বেরিয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগঠিতভাবে উৎখাত ও ধর্ষণ করা হচ্ছে, তাদের ওপর লুটপাট চালানো হচ্ছে। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি অগ্নিসংযোগ করছে। ব্যাংকক পোস্ট–এর আরেক খবর অনুযায়ী, রাখাইন প্রদেশের শে কিয়া নামের এক গ্রামে সেনারা ‘রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আকস্মিক হামলা চালিয়েছে। তাদের সম্পদ লুটপাট করেছে। নারীদের বন্দুকের মুখে ধর্ষণ করেছে।’
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিনিধি নিশ্চিত করেছেন, ‘কথিত আক্রমণকারীদের ধরতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ যে অভিযান চালিয়েছে, তাতে খেয়ালখুশিমতো মানুষকে গ্রেপ্তার করা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে অনেক অভিযোগ এসেছে।’ এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, দেশটির এক নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে পরিকল্পিত ও সংগঠিতভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার এটা নিশ্চিত করছে না, আবার খারিজও করছে না। বরং তারা দাবি করছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ৪০০ বার প্রবল হামলা চালিয়েছে, তার জবাব দিতেই সেনাবাহিনী কিছু অভিযান চালিয়েছে।
কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে ‘বিদেশি সহায়তা নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের’ অভিযোগ তোলা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার মিয়ানমার সরকার এটাও বলেনি, কোন ‘বিদেশি’ শক্তি রোহিঙ্গাদের মদদ দিচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মিয়ানমারের সরকারপ্রধান অং সান সু চি এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু বলেননি বা করেননি। অথচ এই সু চি একসময় পশ্চিমের কাছে গণতন্ত্রের প্রতীক ছিলেন, তিনি নিজেও মিয়ানমারের সামরিক সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। একটি কারণে আমরা ধন্দে পড়ে যাচ্ছি, তিনি তো শুধু শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত মানুষ নন, তিনি এখন দেশটির কার্যকর সরকারপ্রধান। তাই তাঁর এ ব্যাপারে কিছু করার নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে, প্রশাসনিক ক্ষমতাও আছে।
অথচ তিনি এ ব্যাপারে একেবারেই নীরব। তিনি কিছু দেখতে-শুনতে পাচ্ছেন না। আরও আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হলো, তিনি নিজ দেশের মুসলমানদের দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন। সম্প্রতি মিয়ানমারের কিছু সচেতন নাগরিক যখন মুসলমানদের ওপর এই নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে, তখন সু চির পুলিশ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে তাদের লাঠিপেটা করেছে, ব্যাপারটা দুঃখজনক। বিশৃঙ্খলা দমনের অজুহাত একটা পুরোনো আপ্তবাক্য। মানুষের স্বাধীনতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দাবিয়ে রাখার জন্য কখনো কখনো জনশৃঙ্খলার মুখোশ ব্যবহার করা হয়।
মিয়ানমারের মুসলমানদের এই দীর্ঘ দুর্দশার প্রতি সু চির উদাসীনতার কারণ, তাঁর বিবেক মরে গেছে। তাঁকে পেয়ে বসেছে সুবিধাবাদ। তাঁর মনে হয়তো এই ভয় আছে যে মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি দেখালে তিনি এখন যে ক্ষমতার আরাম ও মর্যাদা ভোগ করছেন, তা হারাবেন। অনেকে এ কথাও বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার হরণের চেষ্টা করছে, এবং তার প্রতি সু চির সমর্থন আছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলোও এ ব্যাপারে কিছু করছে না। তারাও নগ্ন সুবিধাবাদের খপ্পরে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ভূরাজনীতির খেলায় চীনকে ঘেরাও করার নীতি বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমারকে তাদের প্রয়োজন। তাই তারা মিয়ানমার সরকার বা সেনাবাহিনীর সমালোচনা করবে না। এভাবেই সুবিধাবাদের যূপকাষ্ঠে প্রথম শহীদ হয় নীতি।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশও এ ব্যাপারে একদম নীরব। বাংলাদেশের শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসও নিশ্চুপ। হয়তো তিনিও ভয়ের কারাগারে বন্দী হয়েছেন। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজও (ওআইসি) কিছু করছে না। এই সংস্থার সদস্যদেশগুলো তো একে অপরকে কতল করতে ও দানব বানাতে ব্যস্ত। তারা নিজেদের মুসলমান ভাইদের হত্যা করছে।
শুধু জাতিসংঘই মাঝেমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু তারা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে আটকে গেছে। এই সীমাবদ্ধতার কারণে তারা শুধু প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে মিয়ানমারের যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মুসলমানদের জন্য কিছু করতে পারতেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বিশ্বের শত শত কোটি মানুষই এখন এই রোহিঙ্গাদের জন্য আশা-ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন, যাঁরা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে পারেন। তাঁদের এখন একত্র হয়ে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানাতে হবে, যা করতে হবে তা হলো, নিজ দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সিনেটর, কংগ্রেস সদস্য বা সাংসদদের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের কাছে জোর প্রতিবাদ জানাতে হবে। তাঁরা যদি সেটা না করেন বা ‘নিরপেক্ষ থাকেন’, তাহলে ডেসমন্ড টুটুর ভাষায় তাঁরা ‘নিপীড়কদের পক্ষে থাকবেন’।
কলকাতার ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
এম আদিল খান: অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

বিকৃত যৌনতায় দিশেহারা জাতি: সমাধান কোন পথে?

শাইখ মিজানুর রাহমান আজহারী: বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণ হচ্ছে। নারীকে বিবস্ত্র করা ...