যখন শাহ্ আবদুল আজিজ দিল্লী মহানগরীতে উত্তর ভারতের মুসলমানদের জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করছিলেন, সেই সময় বাঙলা দেশের মুসলমানেরাও চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে ইংরেজ ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, রাজা রাজভল্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, মহারাজা নন্দকুমার প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পলাশীর যুদ্ধে নওয়াব সিরাজদ্দৌলাকে সুবে বাঙলার মসনদ থেকে বিতাড়িত করেছিল। তারপর শুরু হয়েছিল কোম্পানীর শোষণ। লর্ড ক্লাইব থেকে শুরু করে কোম্পানীর ছোট বড় কর্মচারীরা ঘুষ নিয়ে নিজেদের তহবিল ভারি করেছিল, তার উপর কোম্পানীর তহবিলও ভর্তি করেছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে ইতিপূর্বে নওয়াব আলীবর্দী খানের আমলে মারাঠা বর্গীরা বারবার সুবে বাঙলা আক্রমণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছিল এবং প্রজাদের সম্পত্তি বেপরোয়া লুঠ করেছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সুবে বাঙলায় ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন চলেছিল। বেনিয়া শ্রেণীর হিন্দুদের সহযোগিতায় ব্যবসা বাণিজ্যের ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে কোম্পানীর ও সেই সঙ্গে হিন্দু বণিকদের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজস্ব আদায়ের অজুহাতে জমিদারি ও আয়মাদারি সম্পত্তি, লাখেরাজ, ওয়াক্ফ সম্পত্তি মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়। গোড়াতেই সামরিক বিভাগ থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ, পলাশীর যুদ্ধের পর ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যখন সুবে বাঙলার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন কোম্পানীর হাতের পুতুল মীর জাফরের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আশি হাজার মুসলমান সৈন্যকে বরখাস্ত করা হয়। এরাই তখন পূর্ব ও উত্তর বঙ্গের দূর দূরান্তে জীবিকার অন্বেষণে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে এদেরি বংশধরেরা সৈয়দ আহমদ শহীদ, বেলায়েত আলী ও এনায়েত আলী, হাজী শরিয়তুল্লা ও দুদুমিয়া এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে হাজারে হাজারে মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল।
ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছিল সুবে বাঙলায়। সুবে বাঙলার অর্থে কোম্পানীর তহবিল পূর্ণ হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে এই অঞ্চলের অর্থের জোরে উপমহাদেশে কোম্পানীর শাসন বিস্তার লাভ করেছিল। এর জন্য পুরো মাশুল দিতে হয়েছিল সুবে বাঙলার মুসলমানদের। সুবে বাঙলার মুসলমানদের সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং জমিদারী, আয়মাদারি, লাখেরাজ ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তার উপর কোম্পানীর আমলে গোড়ার দিকে এই অঞ্চলে যে হাজার হাজার মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, সেগুলিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
সুবে বাঙলার, বিশেষতঃ বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় এসেছিল মুঘল আমল থেকেই। নানা প্রকার ইসলাম বিরোধী প্রথা, আচার, আচরণ মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছিল। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কার্যতঃ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হয়ে যায়, তখন কাণ্ডারীহীন মুসলমান সমাজে অনৈস্লামিক আচার-আচরণ আরও অধিক পরিমণে প্রবেশ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে নানা প্রকার হিন্দু কুসংস্কার ও রীতি মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই দুনিয়ার সর্বত্র মুসলিম সমাজে নানা প্রকার কুসংস্কার ও ধর্ম বিরোধী প্রথা দেখা দিয়েছিল। শাহ্ ওয়ালী উল্লার কথায়, রোমের পতন যুগে রোমানদের মধ্যে যে সকল দুর্নীতি, বিলাসিতা ইত্যাদি দেখা দিয়েছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলমান তুর্কী সাম্রাজ্যে এবং মুঘল সাম্রাজ্যেও সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল।
এই পট ভূমিতে ও পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের পুনর্জীবনের প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র অনুভূত হয়েছিল। মক্কা হচ্ছে চিরকালের বিশ্ব মুসলিম কেন্দ্র। পৃথিবীর সকল দেশ থেকে মুসলমানেরা হজ্জের সময় একবার জমায়েত হয়। সেই সময় মুসলমান আলেমগণও জমায়েত হতেন। তাঁরা সকলেই মুসলমানদের পুনর্জাগরণের বিষয় আলোচনা করতেন। তাঁরা সাব্যস্ত করেছিলেন, মুসলমানদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও কার্যকলাপ আবার সেই স্বর্ণ যুগের মতো বিশুদ্ধ ও অনাবিল করা প্রয়োজন।
শাহ্ ওয়ালী উল্লা দিল্লী মহানগরীতে সেই কার্য আরম্ভ করেছিলেন।
তাঁর পুত্র শাহ্ আবদুল আজিজ পরে যখন সংস্কার ও সেই সঙ্গে জেহাদের বাণী প্রচার ও কার্যকরী করার ব্যবস্থা অবলম্বন করছিলেন, সেই সময় বাঙলার ফরিদপুরের হাজী শরিয়তুল্লা ও চব্বিশ পরগনার মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমীর এই অঞ্চলেও সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
সূত্র : সঞ্চারণ