মনযূরুল হক : সারা বিশ্বে এখন মুসলিম উম্মাহের সদস্য সংখ্যা বিপুল পরিমাণে মজুদ আছে। বলা হয় যে, এরা দুনিয়ার সমগ্র জনবসতি ছয় ভাগের একভাগ জুড়ে আছে। এমনিভাবে মুসলিমগণ অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতার অনুসারীদের তুলনায় সুবশিাল জাতি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। প্রতি নিয়তই এই সংখ্যা বেড়ে চলছে। কেবল আমেরিকাতেই রয়েছে প্রায় এক কোটি মুসলমান। তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একইভাবে ইউরোপের সকল দেশে এবং প্রাচ্যের ভূভাগেও ইসলামগ্রহণকারীদের সংখ্যায় অত্যন্ত দ্রুতগতি বৃদ্ধি ঘটছে। এর কারণ সম্ভবত এটাই যে, জাতিগত কৃষ্টি-কালচারের ছায়ায় যারা যাপিত জীবন পার করেছে এবং স্বচ্ছলতা ও বিলাসিতার সম্পূর্ণটাই উপভোগ করেছে, তারা সবকিছু পাওয়া সত্ত্বেও শান্তি নামের দুর্লভ বস্তু থেকে বঞ্চিত এবং এই অভাব দূর করার জন্যে তারা তাদের সকুল ফর্মুলা পরীক্ষা করে দেখেছে, কিন্তু সেই শান্তি তারা পায় নি, যা ব্যতীত জীবনের কোনো স্বাদ বা কোনো মূল্য বাকি থাকতে পারে।
অবশেষে তাদের ইসলাম অধ্যয়ন করা এবং ইসলাম প্রণীত জীবন বিধান গভীর দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ হয়েছে। ফলে তারা সেই হারানো সম্পদ পেয়ে গেছে। যার কারণে তাদের জীবনের গতিধারা বদলে গেছে। জগত ¯্রষ্টার প্রতি তাদের সুদৃঢ় বিশ^াস অর্জিত হয়েছে। তার প্রণীত জীবনের নীতিমালা তারা যাচাই করে দেখেছে। এই দেখতে যেয়েই সহসা তাদের ভেতরে এক বিপ্লব সাধিত হয়েছে।
এটাই ইসলাম স্বভাব ধর্ম হওয়ার নিদর্শন এবং মানসিকতার সঙ্গে পুরাপুরি সঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার প্রমাণ। আল্লাহ তায়ালা এর মর্ম ব্যাখ্যা করতে বলেছেন—
فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا ۚ لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴿٣٠
তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। এটাই আল্লাহর প্রকৃতি, যার ওপর তিনি মানব সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।
অতএব, যাদের কাছে এই মর্ম উন্মোচিত হয়ে গেছে, তারা একে গ্রহণ করতে এবং এই ধর্মকে নিজের জীবনের দিশারী বানাতে একমত হয়েছে। পৃথিবীর বড় থেকে বড় সম্পদ তাদের দৃষ্টিতে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। তারা এই প্রাপ্তির কারণে কেবল যে সীমাহীন আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত, তা-ই নয়, বরং এটাকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ ও উপহার ভেবে এ জন্যে গর্বিতও বটে এবং এটাকে তাদের জীবনের মূলধন মনে করে।
এক নওমুসলিম ইসলাম গ্রহণের পরে সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ করলে মুসলিম পথপ্রদর্শক তাকে অভিনন্দন জানালো। তখন নওমুসলিম বললো এই অভিনন্দন কিসের জন্যে? আমি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে সেই স্বভাব ধর্মকে পেয়েছি, যার ওপর আল্লাহ তায়ালা আদম সন্তানকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই স্বভাব ধর্ম হলো ইসলাম। সুতরাং আমি যেনো আজ আমাকে আবিষ্কার করেছি। এতদিন আমি পথহারা হয়ে ঘুরছিলাম এবং নিজের সত্তা সম্পর্কেই অজ্ঞাত ছিলাম।
এই চিত্রের অপর দিকটি হলো, আমরা মুসলিমরা নিজস্ব স্বভাব-প্রকৃতির বিপরীত পথে জীবনের গাড়ি চালিয়ে দিয়েছি। এই কারণেই আমাদের পদে পদে কঠিন অবস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে, আমাদের নি:শেষ করে দেয়ার প্রচেষ্টা এ জন্যেই প্রবল গতিতে চলছে এবং এর ফলেই আমরা সফলতা থেকে দূরে সরে পড়ছি।
রসূল স. সমগ্র জগতের জন্যে রহমত হয়ে এসেছেন। সেই আনখকেশ রহমতের দৃষ্টান্ত তার পবিত্র সীরাতে বিদ্যমান থাকার পরেও আমরা তা থেকে ভীষণভাবে অমুখোপেক্ষী হয়ে আছি এবং আমরা নানান কৃষ্টি-কালচারের নির্দয় বন্দিত্বে নিজেরাই নিজেদের বন্দি করে নিতে কোনো সঙ্কোচবোধ করছি না। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সবখানে আমরা এই ভাব ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি যে, এখন ইসলামী ন্যায় ও সামের নীতি এবং বিশ^ভ্রাতৃত্বের চিত্র একটি স্বপ্ন হয়ে আছে মাত্র, এবং বস্তুবাদী জীবন বিধানে তার কোনো জায়গা নেই।
নারীদের এই ইসলাম এক দীর্ঘ দাসত্ব ও নির্মম জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে সম্মান ও মর্যাদার সুউচ্চ অবস্থান দান করেছে এবং ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে তাদের কৃতিত্ব ও অবদান পার্থিব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে। আজ আমরা আমাদের সিরাতে মুসতাকিম থেকে সরে গিয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো নিদাগ বস্তুপূজারির পতাকাবাহী বনে গেছি। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কর্মপ্ল্যান কার্যকর করতে গিয়ে কোনো লজ্জাই অনুভব করছি না।
এটা এমন এক কঠিন বিপদ, আমরা এখনও যার মোকাবেলা গুরুত্বের সঙ্গে করতে পারি, যদি আমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামী সভ্যতা-ভব্যতা দেখিয়ে দিতে পারি। এই সভ্যতাই জীবন্ত ও চিরন্তন এবং সর্বযুগে এর নেতৃত্ব মানুষের মহত্তকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে পথের মশাল হয়ে কাজ করে। রহমাতুল্লিল আলামিনের উম্মত আজ দুটি পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং নিজের কর্মকা-কে রহমতের দর্পণের সামনে উপস্থিত না করে দূরে সরে আছে।