আলী আজাম::
“আজ থেকে গোটা হিন্দুস্তান আমাদের” কথাটি বলেছিলেন জেনারেল হার্স, যে দিন হিন্দুস্তানের বীর সেনানী হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। উনার এই শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বস্তুত গোটা হিন্দুস্থানের ওপর নেমে এসেছিল পরাধীনতার অন্ধকার।
হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যতদিন হায়াতে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন,দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন।কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়, গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়।
তাই হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্মরণীয় বীর। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের উদাসীনতায় এই মুসলিম বীর আমাদের কাছে হয় অপরিচিত থেকেছেন নতুবা এমন পরিচয় লাভ করেছেন যা উনার মতো মহান বীরের জন্য অবমাননার শামিল।
.
হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যখন জন্মগ্রণ করেন তখন বাংলা বিহার সহ ভারতের অনেক অংশই ব্রিটশরা দখল করে ফেলে। উনার নাম মুবারক ‘টিপু সুলতান’ রাখার কারণ হলো, উনার জন্মের পর উনার দেহ জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল বিখ্যাত বুযুর্গ, হযরত টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার রুহানী ফয়েজের ঝলক। যেন এই শিশুটি উনারই প্রিতিবিম্ব। তাই উনার নামের সাথে মিল রেখে এ শিশুটির নাম মুবারক রাখা হয় ‘টিপু সুলতান’।
হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার আলেম ও মুমিন ব্যক্তি। পিতা হযরত হায়দার আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি পুত্র হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জন্য উত্তম শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইলম ও জাগতিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি অল্প বয়সে যুদ্ধ বিদ্যা রপ্ত করেন।
১৭৬৭ সালে মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহীশুরের প্রথম যুদ্ধে সাত হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে ইংরেজদের পরাস্ত করেন। সেই সতের বছর বয়সে যে হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি ইসলামের দুশমনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলে নেন বেসাল শরীফ (শাহাদাৎ বরণ)-এর আগ পর্যন্ত উনার সেই হাতিয়ার বীরত্বের উজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকে।
হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি শুধু একজন শাসকই ছিলেন না,একজন আমলদার আলেমও ছিলেন। মুজাহিদে মিল্লাত হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ও বিশুদ্ধ আকীদার মুসলমান।সুন্নাতে নববীর অনুসরণে ছিলেন অনুপম দৃষ্টান্ত। বর্তমান কালে বিভিন্ন সময়ে উনার নামে প্রদর্শিত ফটো কশ্মিনকালেও তাঁর ছবি নয়। কারণ উনার মুখাবয়ব ছিল ঘন শ্মশ্রুমন্ডিত।
সাত-আট বছর বয়সে একদল শিশুর সাথে উনাকে দেখে জৈনিক দরবেশে উনারকে কাছে ডেকে নেন এবং ভবিষ্যত শাসক হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে উনার কাছ থেকে ওয়াদা নেন যে, তিনি শাসক হওয়ার পর ঠিক এই জায়গায় একটি শানদার মসজিদ নির্মাণ করবেন। শাসক হওয়ার পর ওয়াদা মাফিক তিনি মসজিদে আলা নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং ১২০৪ হিজরী মোতাবেক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর উদ্বোধন করেন।
এ উপলক্ষে তিনি দেশের ওলামা-মাশায়েখ এবং বুযুর্গানে কেরামগণকে দাওয়াত দেন। এবং ঘোষণা করেন,আজকের উদ্বোধনী দিনে সেই ব্যক্তি নামাজের ইমামতি করবেন যিনি সাহেবে তারতীব অর্থাৎ বালেগ হওয়ার পর জীবনে কখনো নামাজ কাজা হয়নি। কিন্তু কি আশ্চর্য ! কেউই তখন সামনে অগ্রসর হয়নি। অবস্থা দেখে হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নিজেই নামাজের ইমামতি করেন এবং বলেন “আলহামদু লিল্লাহ, আমি সাহেবে তারতীব।”
সারা জীবনে অব্যাহতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কখনো উনার নামাজ কাযা হয়নি দেখে উপস্থিত লোকজন যারপরনাই হয়রান হয়ে যান।
ইতিহাসের অকুতোভয় বীর সেনানী হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। উনার অনুপম লজ্জাশীলতা সম্পর্কে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উনার দু’পায়ের টাখনু, হস্তদ্বয় এবং মুখমন্ডল ব্যতীত গোটা শরীরই আবৃত থাকত। কখনও তিনি কারো সামনে অন্য কোন অঙ্গ অনাবৃত করতেন না।
একবার নেজাম ও মারাঠা বাহিনী তানগবাদড়া সাগরের পাড়ে সমবেত হয় হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য। হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ছিলেন সমুদ্রের অপর পাড়ে এবং সে সময় সমুদ্র ছিল ভংকর রকম উত্তাল।
সাগরের উত্তালতা দেখে উনার হযরত আমর ইবনুল আস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ও নীল দরিয়ার ঘটনার কথা মনে পড়ে এবং তিনি ভাবেন, সাচ্চা মুসলমানের জবানে মহান আল্লাহ পাক তিনি এখনো তাছীর রেখেছেন। এই বলে তিনি আল্লাহ পাক উনার কাছে কায়মনোবাক্যে দু’আ করেন এবং উনার আদেশে মুজাহিদরা সমুদ্রে একুশবার গোলা ছোঁড়ে। এর কিছুক্ষণ পর সমুদ্রের উত্তালতা থেমে যায়। হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কারামত দেখে মুজাহিদরা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে দুশমনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন ইলম জ্ঞান প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ছিলেন জ্ঞান আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জাওয়াহিরুল কোরআন(পবিত্র কোরআনের মুক্তামালা), যাদুল মুজাহিদীন (মুজাহিদের পাথেয়),মুফাররেহুল কুলুব(আত্মার প্রশান্তি) এসব প্রখর জ্ঞান সমৃদ্ধ কিতাবাদী উনারই একান্ত তত্ত্বাবধানে রচিত হয়। হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হিন্দুস্তানের এক বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শাসক। ভারত উপমহাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘ফাতহুল মুজাহিদীন’ নামে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটি তার তত্ত্বাব্ধানে প্রকাশিত হত এবং এতে মুজাহিদদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ থাকত।
আন্তর্জাতিক বিষয়েও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তিনি উনার শাসনাকালীন সময়ে ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেন। ইংরেজ বীরোধিতা তখন দু’টি দেশকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসে। সে সময় তিনি আফগানিস্তানের তৎকালীন বাদশাহকেও আপন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন।
ইংরেজরা একমাত্র তার প্রতিরোধের কারণেই গোটা হিন্দুস্তান কব্জা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। একারণে তারা তাঁর বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। হাজার হাজার লোককে গাদ্দারে পরিণত করে। মহীশুর বাহিনীর সাথে ইংরেজ বাহিনীর ফয়সালাকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৭৯৯ সালের মে মাসে। ৪ মে ফজরের নামাজ আদায় করে হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি শত্রু বাহিনীর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন।
গাদ্দার পরিবেষ্টিত হয়ে উনাকে যুদ্ধ করতে হয়। এমনকি উনার ব্যক্তিগত ও খাস খাদেম গোলাম রাজা খানও তার সাথে চরম গাদ্দারী করে। উনার কাছে পানি থাকা স্তত্বেও সে সুলতাকে পানি দিতে অস্বীকার করে এবং সুলতান সারা দিন পানির পিপাসায় ছটফট করেন। এই গাদ্দারই উনাকে দুশমনের হাতে আত্মসমর্পনের কুপরামর্শ দেয়। সে সময় তাকে লক্ষ করেই হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সেই বিখ্যত উক্তিটি করেন- “আমার কাছে সিংহের একদিন জীবন শিয়ালের শত বছরের জীবনের চেয়ে উত্তম।”
সকালে অব্যাহত লড়াইয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আসমানের বাসিন্দারা আল্লাহর এই মকবুল বান্দাকে ইস্তেকবাল করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বিকেলের কোন এক সময় মহীশুরের এক গাদ্দার ইংরেজদেরকে ইশারা করে বলে দেয় ইনিই হলেন হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি। তৎক্ষণাৎ দুশমনেরা বন্দুকের সকল নল তার দিকে তাক করে এবং চতুর্দিক থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে থাকে। একটি গুলি এসে তার বুকে বিদ্ধ হয় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
এসময় একজন সৈনিক তার কোমরে ঝুলানো হীরা খচিত শমসীর খুলে নিতে চাইলে তার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে,তখন তিনি তার সকল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং তলোয়ার দিয়ে তার উপর আঘাত করেন।সে বন্দুকের সাহায্যে আঘাত প্রতিহত করলেও অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক এতে প্রাণ হারায়। সে সময়ে নিকটে অবস্থিত অন্য একজন ইংরেজ সৈনিক তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তার কানে গিয়ে তা আঘাত করে। এই গুলিতে হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শাহাদাত বরণ করেন, সেই সাথে হিন্দুস্তানের আযাদীর সূর্যও অস্তমিত হয়। সে দিনটি ছিল ১৭৯৯ ইংরেজী সালের ৪ ই মে।
পরের দিন ৫ মে উনাকে গোসল ও কাফন দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান উনাকে শেষ বারের মত দেখার জন্য ভীড় করে। হিন্দু মহিলারা মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে শোক প্রকাশ করতে থাকে। লালবাগে পৌঁছানোর পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের কাজী জানাজার ইমামতি করেন। নামাযান্তে মহীশুর রণক্ষেত্র থেকে আট মাইল দূরে সেরিঙ্গা পট্টম নামক স্থানে পিতা হায়দার আলীর কবরের পাশে উনাকে দাফন করা হয়।
উনার সম্মানিত বাবা-মায়ের কবরের পাশাপাশি হযরত শহীদ টিপু সুলতান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে শায়িত করা হয়
এভাবেই ভারত উপমহাদেশের একজন স্বাধীনচেতা, দেশপ্রেমিক, লড়াকু সৈনিক ও অকুতোভয় আলেম শাসকের জীবনাবসান হয়। “তথ্য নেট এবং ইসলামী ইতিহাসের বই থেকে সংগ্রহীত।
অথচ আজ আমাদের সামনে টিপু সুলতান নিয়ে যে ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে তা মূলত ইংরেজদেরই বানানো বিকৃত ইতিহাস! যেখানে হযরত টিপু সুলতান (রহঃ) কে দাড়িহীন দেখানো হয়েছে! তাঁর ব্যক্তিত্বকে অনেকাংশে গোপন করা হয়েছে। পত্রপত্রিকাতেও সেই বিকৃত ইতিহাস স্থান পেয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম জানেনা প্রকৃত ইতিহাস! এই বিকৃত ইতিহাসের বিরুদ্ধে যদি আমরা কলম না ধরি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ইসলামী ব্যক্তিত্বদের সমস্ত অর্জনকে অকপটে অস্বীকার করবে! তাই সত্য প্রচারে সকলেই সহায়ক হোন।জাযা-কুমুল্লা-হ।