শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ২:৪২
Home / কওমি স্বীকৃতি- একটি বিশ্লেষণ। বেফাক ও চিন্তকদের জন্য বিশেষ দিক নির্দেশনা !

কওমি স্বীকৃতি- একটি বিশ্লেষণ। বেফাক ও চিন্তকদের জন্য বিশেষ দিক নির্দেশনা !

লিখেছেন: হাসান তানভীর 

কওমি মাদরাসার সিলেবাস ও সনদের স্বীকৃতি নিয়ে তো অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার যুগে সবাই যখন মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে তখন আমিও কিছু বলি। বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে প্রধানত তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা দেখা যায়। সাধারণ, আলিয়া ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থা। এই তিন ধারার কোনোটিই পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় মনুষ্যত্ব্যের বিকাশ ও মূল্যবোধের কিছু শেখানো হয় না। শুধু বস্তুবাদ ও পশ্চিমা অন্ধ অনুকরণই এখানকার মূল উপজীব্য। আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থা একটা সংকর খচ্চর কিংবা নপুংসক হিজড়া ছাড়া কিছু নয়। কারণ এখান থেকে না ভালো আলেম বের হয়, না ভালো জেনারেল এডুকেটেড। আমি তো এমন ছাত্রও দেখেছি আলিয়ায় যারা how are you? বললে I am fine. বলতে পারে না অথচ পরীক্ষার ফলাফল ঠিকই গোল্ডেন এ প্লাস। এখানে পড়ালেখার নামে শুধু ধোঁকাবাজি চলে।06

সবশেষে আসি আমাদের আবেগের জায়গা কওমি মাদরাসায়। এই ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো সেই কারিকুলাম ব্যবহার করা হয় যা আরো দুইশো বছর আগের জন্য উপযুক্ত ছিলো। এখানে উর্দু শেখানোর জন্যও ব্রিটিশ আমলে লিখিত কিতাব পড়ানো হয়। অথচ শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার আনতে হয়। এটার জন্য বোর্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় ও কমিটি গঠন করে দিতে হয় যারা প্রয়োজনমত পাঠ্যপুস্তকে সংস্কার আনবে। এটা কারো একার পক্ষে সম্ভবপর নয়। কেউ একা একা করতে চাইলে তার শ্রমের অপচয় হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ একটা কারিকুলাম বিশ বছর পর তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘদিন একটা সিলেবাস আঁকড়ে থাকা মানে আরেকটা গোঁড়ামির জন্ম দেওয়া।  সমস্যা হলো কওমিতে উর্দু কায়দা, মিজান মুনশাইব, মালাবুদ্দাকে বুজুর্গদের ফয়েজ হাসিলের মাধ্যম মনে করা হয়। এগুলো বাদ দিলে নাকি ইলম উঠে যাবে। আরবি থেকে ফার্সি ও উর্দুতে যখন ইলমের অনুবাদ হচ্ছিলো তখন কেউ ইলম উঠে যাওয়ার অনুযোগ করেছিলো কিনা আমার জানা নেই।  প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকগুলো ক্লাসিক সাহিত্যের মতো পড়ানো হলে সেই শিক্ষাব্যবস্থায় গোল বাঁধবেই। মনে রাখা দরকার, পাঠ্যপুস্তক আর সাহিত্য এক জিনিস নয়। এখন বাংলা ব্যাকরণ বোঝানোর জন্য সিক্স সেভেনে যদি রাজা রাম মোহনের গৌড়ীয় বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হয় তাহলে নিশ্চয়ই সেটা আদর্শ পাঠ্যপুস্তক হবে না।

এবার আসি স্বীকৃতির ব্যাপারে। প্রচলিত সিস্টেমে দাওরা হাদিস শেষ করে তাকে মাস্টার্সের সমমানের জন্য দাবি করা অযৌক্তিক। কারণ একে এতে শিক্ষা ও গবেষণার পরিধি খুবই কম। দ্বিতীয়ত অনেক মাদরাসা আছে যেখানে পাঁচ বছরেই দাওরা শেষ করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো হযরত তো মাশাল্লা কাফিয়া পড়েই দাওরায় ভর্তি হয়ে যান। এই যে হুটহাট দাওরা শেষ করে ফেলা এর জন্য দায়ি মূলত টিসির ব্যবস্থা না থাকা ও বোর্ড পরীক্ষাগুলোর মার্কশিট ও সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন না থাকা। কওমি সনদের স্বীকৃতি ও এর গুরুত্ব নিয়ে এবার কিছু কথা বলি। আচ্ছা আমরা তো এদেশের নাগরিক। সরকারকে কর দেই। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের অধিকার ভোগ করা আমাদের জন্য ন্যায়সঙ্গতই শুধু নয়, জরুরি। তাহলে আমরা কেনো রাষ্ট্রের অধিকার থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত হবো? সেই খেলাফতের যুগ থেকে নিয়ে এদেশের মুঘল আমল পর্যন্ত সব সময়ই শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়েছে। আলেমরা দেশ পরিচালনায় সহযোগিতা করেছেন।ডপ

ব্রিটিশ পিরিয়ডে রাষ্ট্রের অধিকার ভোগ করা সম্ভবপর ছিলো না কারণ তখন রাষ্ট্রটাই আমাদের ছিলো না। যখন পাকিস্তান হলো সেটা ছিলো আমাদের রাষ্ট্র। যখন বাংলাদেশ হলো সেটাও আমাদের রাষ্ট্র। তাহলে নিজ দেশের সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা কেনো বঞ্চিত হবো? আমরা কেনো এম্বাসেডর, সচিব হতে পারবো না? আরে কিছু মানুষকে যেমন দরবেশ হতে হয় তেমনি কিছু মানুষকে আমলাও হতে হয়। নইলে দেশ চলতে পারে না। আর যে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু দরবেশ তৈরি করে, আমলা তৈরি করতে পারে না তা কখনোই পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা নয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো কওমিতে সবাইকেই দরবেশ বানানো হয়। কেউ চাইলেও দরবেশ হতে হবে না চাইলেও হতে হবে। কারণ স্বীকৃতি, আমলাগিরি তো দুনিয়াবি কাজ। তাই আমাদের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই।  আমি মনে করি আমাদের স্বীকৃতি না থাকার পেছনে ইসলামবিদ্বেষীদের বিরাট সফলতা রয়েছে। কারণ এতে করে তারা আমাদের বঞ্চিত করে দেশটা লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদেরকে অধিকার বঞ্চিত করে আমাদের একশো বছর পিছিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় কাজে আমরা না এলেই তো ওরা খুশি। আজ যদি এনসিটিবির চেয়ারম্যান মাদরাসা পড়ুয়া হতো তাহলে নৈতিকতাবিহীন পাঠ্যপুস্তক বাদ দেওয়ার জন্য আন্দোলন করা লাগতো না। মনে রেখো কওমিয়ান, রাষ্ট্রের তহবিল থেকে বেতন নেওয়া তোমার অধিকার। এটা কোনো অনুদান বা সাহায্য নয়। এটাকে ছেড়ে দিও না। নিজের অধিকার ছেড়ে দেয় কেবল কাপুরুষেরাই। তুমি তোমার অধিকার জোর করে বুঝে নাও।Koumi-Ahmad+Shafi

এবার আসি স্বীকৃতি কিভাবে হতে পারে সে ব্যখ্যায়। এ নিয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু ভালো চিন্তাভাবনা এসেছে। তারপরও আমি আমারটা বলি। তাইসিরে যদি ক্লাস ফাইভের পড়া পড়ানো হয় তাহলে তাইসিরকে ধরা যাক পঞ্চম শ্রেণি। বাকি নিচের চার ক্লাস তো মক্তবেই শেষ হয়। শরহে বেকায়া পর্যন্ত বাংলা এসএসসি বা মাধ্যমিকের সমমান ধরা যেতে পারে। জালালাইন ও মিশকাতকে উচ্চমাধ্যমিক বা এইচএসসির সমমান ধরা যেতে পারে। দাওরা হাদিসকে এক বছর না পড়িয়ে চার বছর পড়ানো যেতে পারে। এটা তো সবাই স্বীকার করে যে দাওরার যে সিলেবাস তা এক বছরে কখনোই ঠিকমতো পড়ানো সম্ভব নয়। তাহলে নাকেমুখে গেলানো ইলম শিখে লাভ কি। এর চেয়ে হাদিসের কিতাবগুলোসহ সমসাময়িক আরো বিষয় যুক্ত করে চার বছরের কোর্স করাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের সিলেবাস ফলো করা যেতে পারে। দাওরার মান তাহলে ইসলামিক স্টাডিজের সমমান হতে কোনো সমস্যা থাকবে না। তারপর দুই বছরের তাখাসসুস হবে মাস্টার্সের সমমানের।

এবার আসি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও বোর্ড প্রসঙ্গে। বেফাক যেহেতু ঢাকাকেন্দ্রিক ও সর্ববৃহৎ বোর্ড, সুতরাং শিক্ষা পরিচালনা বেফাকের নিয়ন্ত্রণে হবে এ নিয়ে দ্বিমত থাকা উচিত নয়। তবে বেফাক কেবল মিশকাত বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কারিকুলাম ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। এরপর দাওরার জন্য স্বায়ত্তশাসিত আলাদা কওমি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে যারা দাওরা ও তাখাসসুস নিয়ন্ত্রণ করবে। দাওরা হাদিসওয়ালা মাদরাসাগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে থাকবে। অনেকটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। যারা মাদরাসায় সরকারি হস্তক্ষেপের ভয় পান তাদের জন্য বলি, একটা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটই সর্বেসর্বা। সেখানে সরকারের এক অক্ষর দাম নেই। তাই যারা সরকারি হস্তক্ষেপের ভয় পান কওমি বিশ্ববিদ্যালয় হলে সে ভয় থাকবে না। আরবে যারা আলেম হয় তারা সাধারণ বিদ্যালয়েই পড়ালেখা করে হয়। সেখানে আলেম বানানোর জন্য কওমি মাদরাসা নেই। তারা বিজ্ঞানও পড়ে ইসলামও শেখে। তার মানে কওমিতে বিজ্ঞান পড়ানো হলে ছেলেপেলে নাস্তিক হয়ে যাবে বা কওমির জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে ব্যাপারটা কখনোই এরকম নয়। কারণ সিলেবাস মানুষের মন যতটুকু পরিবর্তন করে তার চেয়ে বেশি করে পরিবেশ। নইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রকে দেখলে যে পুরো আলেমের মতো লাগে তার কারণ তাদের অনেকেই তাবলিগের দীনী পরিবেশে সময় কাটায়। তো কওমিতে পড়ালেখার পরিবেশ যেহেতু আগের মতোই আবাসিক ও উস্তাদদের নেগরানিতে হবে সেহেতু শরহে বেকায়া পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়ানো হলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। অনেকে বলবেন এতে সাবজেক্ট বেড়ে যাবে। তাদের জন্যে বলবো, ভাইরে এখনো যদি বিজ্ঞানের চেয়ে ফার্সি ভাষা ও উর্দু কিতাবের গুরুত্ব আপনার কাছে বেশি হয় তাহলে আমি লাচার। আমার দুঃখ সেক্ষেত্রে আরেকটু বাড়বে যে ইশ আরবের আলেমরা উর্দু ফার্সির ইলম থেকে মাহরুম হয়ে গেলো!!

 সুত্রঃHasan Tanvir “আসহাবে কাহাফ” ফেসবুক গ্রুপ

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

পুলিশি নির্যাতনে হত্যার বিচার চাইবেন কার কাছে?

ডক্টর তুহিন মালিক: (১) মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে যুবককে রাতভর নির্যাতন ...