দিল্লির হাতে বাংলাদেশীদের ভাগ্য ! পুরো দেশ গোলাম হতে আর কত দেরী ?
বিশেষ প্রতিবেদন::
দ্বিতীয় লন্ডন খ্যাত সিলেট । যুক্তরাজ্যে বাঙালি কমিউনিটির বিশাল জনগোষ্ঠি যাদের দুই তৃতীয়াংশ এই সিলেটের বাসিন্দা। পরবিার-পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজন বংশ পরস্পরায় পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। সিলেটীদের এই বৃটেন তথা লন্ডন আসক্তি এখন অনেকটা থমকে দাঁড়িয়েছে।
গত ১৬ মাসে আগে ইউকে ভিসা প্রসেসিং সেন্টার ঢাকা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয় । এরপর বাংলাদেশীদের ভিসাপ্রাপ্তির হার অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আগে যেখানে ৭০ শতাংশ আবেদনকারী ভিসা পেতেন এখন সেখানে মাত্র ১০ শতাংশও ভিসা পচ্ছেন না। তাছাড়া নানা কড়াকড়ির কারণে স্টুডেন্ট ও স্পাউজ ভিসা প্রাপ্তিও বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে ইমিগ্রান্ট আসার হার একেবারেই কমে গেছে। আর এসব কারণে পূর্ব লন্ডনের অধিকাংশ বাঙালি ইমিগ্রেশন ফার্ম ব্যবসা পরিচালনায় মারাত্মক হিমশিম খাচ্ছে। অনেকের ব্যবসায় ইতোমধ্যে লালবাতি জ্বলার উপক্রম হয়ে পড়েছে।
ভবিষ্যতে ইমিগ্রান্টস আসার পথ সুগম না হলে অনেক ইমিগ্রেশন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। হোয়াইটচ্যাপেল কেন্দ্রিক একটি ইমিগ্রেশন ফার্মের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা অনেকগুলো সেবা দিয়ে থাকেন। তন্মধ্যে ভিজিট ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা ও স্পাউস ভিসা প্রসেসিং উল্লেখযোগ্য ও বেশ লাভজনক। কিন্তু এখন এই তিনটি খাতে কাজ নেই বললেই চলে।
২০১৪ সালের ১ অক্টোবরে ইউকে ভিসা প্রসেসিং সেন্টার ঢাকা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরের পর ভিসা প্রাপ্তির হার কমে যাওয়ায় এখন আর প্রবাসীরা আত্মীয়-স্বজনকে লন্ডনে ভিজিটে আনতে স্পনসর করতে নারাজ। কারণ অধিকাংশ আবেদনই রিফিউজ হচ্ছে। তাছাড়া ইতোপূর্বে অ্যাপিল পদ্ধতি বাতিল করে দেওয়ায় এখন আর এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ নেই। তাই তারা যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটিই মেনে নিতে হয়। একসময় অ্যাপিল রাইট থাককালে অধিকাংশ স্পনসরই আবেদনকারীর পক্ষে অ্যাপিল করতেন।
তখন আদালতে গেলে বিচারক অধিকাংশ অ্যাপিলেই পক্ষে রায় দিতেন। ভিসা হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। আগে ভিজিটের জন্য আবেদন প্রসেস করে দেয়ার পর রিফিউজ হলে আবার অ্যাপিলের কাজ করার সুযোগ পাওয়া যেতো। এরপর ভিজিট ভিসায় বৃটেন আসার পর এখানে ওয়ার্ক পারমিট আবেদন করা কিংবা বিদ্যমান অন্য কোনো বৈধপদ্ধতির আবেদনের জন্যও মানুষ ইমিগ্রেশন ফার্মে আসতো। কিন্তু এখন একেবারে গোড়ায় কেটে দেয়া হচ্ছে। ভিজিটে আসার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, অ্যাপিল তো দুরের কথা। স্পাউজ ভিসায় বৃটিশ ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশে বিয়ে করে স্বামী স্ত্রীকে আনতে পারতেন।
কিন্তু বৃটেনে আনতে হলে ১৮ হাজার ৬শ পাউণ্ডের চাকরি থাকা বাধ্যতামূলক ও ইংলিশ ইসল এ১ শিক্ষা অপরিহার্য করার পর বৃটিশ ছেলে মেয়েদের বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কমে গেছে। অন্যদিকে স্টুডেন্ট ভিসা এখন নেই বললেই চলে। তাছাড়া একসময় ১৪ বছর বৃটেনে বসবাস করলে হিউম্যান রাইটস আইনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করা যেতো এখন তা করা হয়েছে ২০ বছর। হোম অফিসের যেকোনো আবেদনের ক্ষেত্রে মূল ফি ৬৪৯ পাউন্ডের সাথে হেলথ ফি বাবদ আরো ৫শ পাউন্ড ধার্য করায় অনেকের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো অবস্থা হয়েছে।
অনেকেই বেশি ফি’র কারণে আবেদন করতে সাহস পাননা। কারণ একটি আবেদনে হোম অফিস ফি, হেলথ ফি ও সলিসিটর ফিসহ প্রায় ২ হাজার পাউন্ড খরচ করতে হয়। অথচ সফল হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে একেবারে কম। এদিকে ইমিগ্রান্ট আসা বন্ধ হয়ে পড়ায় অনেক ইমিগ্রেশন ফার্ম নানা ধরনের বেআইনী কাজে জড়িয়ে পড়েছে। হোয়াইটচ্যাপেল এলাকায় এমন অনেক ফার্ম রয়েছে যাদেরকে সলিসিটর রেগুলেটরি অথরিটি (এসআরএ) একাধিকবার ব্ল্যাকলিস্ট করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা ভিন্ন সলিসিটরের অধীনে ভিন্ন নামে কোম্পানী খুলে ব্যবসায়ী হিসেবে আভির্ভূত হয়েছেন।
আবার কিছুদিনের মধ্যে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছে। তাদের মূল কাজ অবৈধভাবে বসবাসরত অসহায় ইমিগ্রন্টদের লিগ্যেল করে দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। অবৈধ ইমিগ্রান্টদের অর্থ আত্মসাত করে তারা অনায়াসে পার পেয়ে যায়। অর্থ আত্মসাতের পর কিছু বললে উলটো পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের বিদায় করে দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। পূর্ব লন্ডনের ব্যালেন্স রোডের একটি ইমিগ্রেশন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান একজন গ্রাহককে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার পাউন্ড হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগী গ্রাহক জানান, তিনি হিউম্যান রাইট আইনে আবেদন করতে গিয়েছিলেন ওই ইমিগ্রেশন ফার্মে। তাঁর নিজের কোনো একাউন্ট না থাকায় ওই আইনী প্রতিষ্ঠান তাঁর কাছ থেকে সব ফি ক্যাশ নিয়ে নেয়। তিনি তাকে হোম অফিসের আবেদন ফি, মেডিকেল ফি ও আবেদন প্রসেসিং বাবদ মোট দেড় হাজার পাউণ্ড প্রদান করেন।
বিনিময়ে ওই আইনী প্রতিষ্ঠান কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে হোম অফিসের একটি অ্যাকনোলেজমেন্ট (প্রাপ্তি স্বীকার) লেটার দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর হোম অফিস থেকে আর কোনো চিঠি না পেয়ে তিনি সরাসরি হোম অফিসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন তার নামে কোনো আবেদনই দাখিল করা হয়নি। তখনই তিনি বুঝতে পারেন আবেদনের বিষয়টি সম্পুর্ণ ভূয়া, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বৃটেনে বৈধভাবে বসবাস না করার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এ কাজটি করা হয়েছে। তিনি পুলিশে অভিযোগ করতে পারেন নি। অবশেষে শালিশ বিচারে ওই প্রতারক আইনজীবী কিছু অর্থ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। ইমিগ্রেশন ব্যবসা লাটে উঠায় আরও অনেক সলিসিটর ফার্ম এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অসহায় মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। পূর্ব লন্ডনের একটি ব্যস্ততম সলিসিটর ফার্মের বিরুদ্ধে মেরিট-বিহীন কেইসে গ্রাহকদেরকে সাফল্যের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মোটা অংকের ফি আদায়, হয়রানী ও দীর্ঘসূত্রীতার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে অনেক ভ‚ক্তভোগীর অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রমাণাদী পাওয়া গেলে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। অতি সম্প্রতি পূর্ব লন্ডনের ক্যানন স্ট্রিটে ইউর রাইট সলিসিটরস ফার্ম গ্রাহকদের প্রায় মিলিয়ন পাউন্ড নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনাটি কমিউনিটিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সুখ্যাত আইনজীবী বলেন, হোয়াইটচ্যাপেলে দুই ধরনের আইনজীবী রয়েছেন। একটি গ্রুপ হচ্ছেন ইমিগ্রেশন প্রাক্টিশনার, অন্যরা হচ্ছেন ইমিগ্রেশন ব্যবসায়ী। ইমিগ্রেশন প্রাক্টিশনাররাই প্রকৃত আইনজীবী। আর অন্যরা ইমিগ্রেশন ব্যবসা করেন, ওয়ার্ক পারমিট বিক্রি করেন, বৈধ হওয়ার জন্য কাগজপত্র তৈরি করে দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ তাঁদের কাছে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়। ওরা প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। ভূক্তভোগীরা অবৈধ থাকার কারণে ভয়ে অভিযোগ করেন না।
এ ব্যাপারে মাইল এন্ড রোডের কিংডম সলিসিটর্স এর প্রিন্সিপাল ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে বলেন, আইন প্রাক্টিসের নামে যারা প্রতারণা করছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, মানুষকে সতর্ক করতে হবে। কোনো আইনী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রতারিত হলে লিগ্যেল অমবুজমেনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে ওই ফার্মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনী প্রতিষ্ঠান তাঁর গ্রাহককে অমবুজমেন সার্ভিসের ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার দিতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকেন। তিনি আরো বলেন, এ ক্ষেত্রে প্রতারিত ব্যক্তি অবৈধ অভিবাসী হলেও ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারণ লিগ্যেল অমবুজমেন শুধু আইনী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। প্রতারণার শিকার ব্যক্তি তাঁর ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসের কারণে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হবেন না।
তিনি এ ব্যাপারে যেকোনো আইনী পরামর্শের জন্য কমিউনিটির নির্ভরযোগ্য ও সুপরিচিত ফার্মগুলোর শরনাপন্ন হওয়ার আহবান জানান। বাংলাদেশ থেকে ইমিগ্রান্ট আসার হ্রার কমে যাওয়ায় ইমিগ্রেশন প্রাক্টিস ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরী আরো বলেন, যারা শুধু ইমিগ্রেশন প্রাক্টিস করে থাকেন তারাই আপাতত কঠিন সময় পার করছেন। তবে যারা ইমিগ্রেশনের পাশাপাশি লিটিগেশন, ফ্যামেলী ল’ ও চাইলড মেটারসহ অন্যান্য বিষয়ে কাজ করেন তাদের তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা।
উল্লেখ্য, পূর্ব লন্ডনের অলডগেইট ইস্ট থেকে মাইল এন্ড পর্যন্ত রোডে ছোট বড় মাঝারী অর্ধশতাধিক ইমিগ্রেশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই অত্যন্ত সুনামের সাথে গ্রাহকদের আইনী সেবা দিয়ে আসছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে কিছু অসৎ ইমিগ্রেশন এডভাইজার প্রতরণার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের হয়রানী করে থাকেন, যা প্রকৃত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য মানহানীকর। তাই এদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাসহ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী ওঠেছে।
সুত্র: ডেইলিসিলেট।