বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:৪৯
Home / অনুসন্ধান / বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি ও ভাঙ্গনের ইতিহাসঃ একটি পর্যালোচনা ( পর্ব-২)

বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি ও ভাঙ্গনের ইতিহাসঃ একটি পর্যালোচনা ( পর্ব-২)

হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ 01হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::

বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ইতিহাস, ভাঙ্গন ও বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা করলেই শুরুতে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নাম আসে। এতো ঘাত-প্রতিঘাত, ভাঙ্গন ও বার বার খণ্ড-বিখণ্ডের পরও আজ পর্যন্ত দলটি ঠিকে আছে। বর্তমানে দলটি তৃ-ধারায় ভবভক্ত হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খলিফায়ে মাদানী শায়েখ আব্দুল মুমিন এর নেতৃত্বাধীন “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ”, শায়খুল হাদীস আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের নেতৃত্বাধীন “বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” ও শায়খুল হাদীস আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরীর নেতৃত্বাধীন “জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ” নামে পৃথক তিনটি দল রয়েছে। তবে কিছুটা বৃহৎ পরিসরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও দেওবন্দ আন্দোলনের সিপাহশালার শাইখুলহিন্দ মাহমূদ হাসান রাহ. বৃটিশ কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯১৯ সালে শায়খুলহিন্দের গণমূখী আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লবের নীতি-আদর্শের বাহিরে মাওলানা আব্দুল বারী ফিরিঙ্গি মহল্লীর নেতৃত্বে উপমহাদেশের প্রথম শুধু আলেমদের সতন্ত্র ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠন “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” প্রতিষ্টিত হয়। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দই একমাত্র সংগঠন, যা সর্বপ্রথম ১৯২০সালের ১জানুয়ারি ভারতবর্ষের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দাবী করে। তবে সংগঠনটি শুরুতেই মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদের অরাজনৈতিক খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে হারিয়ে যায়। পরবর্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পূর্বে শায়খুল ইসলাম মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র নেতৃত্বে “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” স্বাধীনতার দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তবে দেশ ভাগের বিরোধ নিয়ে কিছুদিন পরই জমিয়ত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে ১৯৪৫সালে “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” নামে আলাদা সংগঠন প্রতিষ্টিত হয়।

১৯৪৭ সালের পূর্বে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পেছনেও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের অগ্রণী ভুমিকা ছিল। সংগঠনটির মিছিলে হাজার হাজার আলেম-উলামা অংশ নিতেন। আলেম সমাজকে দেশের মানুষ প্রাণভরে ভালবাসে বলেই জনসমর্থনের ক্ষেত্রে এ সংগঠন কম ছিল না। এটাকে হুযুরদের সংগঠন বলে সবাই চিনতো। কিন্তু এক সময় সংগঠনটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হয়ে গেলো। যারাই এ সংগঠন ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছেন, তাদেরও যুক্তি ছিল। অনেকেই বলেছেন যে, সঠিক একটি ইসলামি বিপ্লব সংগঠিত করতে হলে নিদৃষ্ট একক কোন গোষ্ঠী দ্বারা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র কওমী পন্থী লোকজন দিয়ে কাঙ্খিত বিজয় অর্জন সম্ভব নয়। একটি সফল ইসলামি বিপ্লবের জন্য সব শ্রেণীর মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আলেম-উলামা, দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র সমাজসহ সব শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামক সংগঠনটি সব শ্রেনী বা সব পেশার মানুষদের জড়ো করতে পারেনি এবং চেষ্টাও করেনি।

৪৭’র পর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের বিরোধের মাঝেই পূর্ব পাকিস্তনে আলেমরা প্রথমে শর্সিনার পীর সৈয়দ নেসার উদ্দীনের নেতৃত্ব, পরে তার বার্ধক্যের কারণে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বে “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” নামে দলটির কার্যক্রম শুরু হয়। তখন একটি বৃহত্তর ইসলামি আন্দোলনে রূপধারন করে। শুধুমাত্র আলেম সমাজ নিয়ে এ সংগঠনটির পথ চলা। তখন সংগঠনটির সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা ছিল, এক সময় দেশের প্রায় সকল শীর্ষ আলেমরা এই সংগঠনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। তবে সংগঠনটির দু’চারজন ব্যতিত প্রায় সকল নেতা-কর্মীই কওমী মাদ্রসা শিক্ষিত আলেম। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান সৃষ্টিকারী দলটি পূর্ব পাকিস্তানে আবার ভাঙ্গনের স্বীকার হয় ১৯৪৯সালে নেজামে ইসলামের ব্যনারে। জমিয়তে উলামার শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ মাওলানা আতহার আলী রাহ., মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন এবং মাওলানা আশরাফ আলীসহ জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ “নেজামে ইসলাম পার্টি” নামে কার্যক্রম শুরু করেন। নেজামে ইসলাম প্রথমে মূলত জমিয়তের নির্বাচনী একটি অঙ্গ প্রতিষ্টান বা সেল ছিল। নেজামে ইসলাম আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর জমিয়তের কার্যক্রম একেবারে স্থবির হয়ে যায়। মাওলানা আতহার আলীর ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই পুরো দেশের উলামায়ে কেরাম জমিয়ত ছেড়ে নেজামে ইসলামে যোগ দান করেন।

তবে ১৯৬৪ সালে সংগঠনটি সিলেট কেন্দ্রিক “পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত” নামে আবার ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করে। সিলেটের মাওলানা রিয়াসাত আলীকে সভাপতি ও মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথীকে সেক্রেটারী করে জমিয়ত আবার সিলেটে কিছুটা ঘুরে দাড়ায়। পরবর্তিতে ১৯৬৬সালে ঢাকার নবাব বাড়ীর “আহসান মঞ্জিলে” আলেমদের সমন্নয়ে “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” বৃহৎ পরিসরে নব উদ্দ্যোমে পথ চলা শুরু করে। পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তির উপস্তিতিতে মাওলানা আব্দুল করিম শায়েখে কৌড়িয়াকে সভাপতি, মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমীকে সেক্রেটারী করে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়।১৯৭১ সালে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখলেও স্বাধীনতার পরবর্তিতে সংগঠনটি আবার দুর্বল হয়ে পরে।

এর ঠিক দশ বছর পর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির ক্লান্তিলগ্নে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. “তওবার রাজনীতি”র ডাক দেন। তখন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ভিবিন্ন ইসলামি সংগঠনেরর নিস্ক্রীয় সকল সদস্য এবং অনেক প্রবীণ উলামা মাশায়েখ হাফেজ্জী হুযুরের ডাকে সাড়া দেন। সবাইকে নিয়ে হাফিজ্জি হুযুর রাহ. তখন “খেলাফত আন্দোলন” নামে নতুন সংগঠনের যাত্রা শুরু করেন। এতে করে তৃতীয়বারের মত জমিয়ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরবর্তিতে হাফেজ্জি হুযুরের বাধর্ক্য অবস্থায় খেলাফত আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়লে ১৯৮৪ সালে পুণরায় শায়খে কৌড়িয়াকে সভাপতি, মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমীকে সেক্রটারী করে “জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” গঠিত হয়। তবে আকাবিরে আসলাফের অনুসরণে জামায়াতে ইসলামীর ভ্রান্ত আকিদা ও নারী নেতৃত্বের সাথে জোট করা নিয়ে সংগঠনটির বিরোধীতা সক্রিয় অবস্থান ও জুড়ালো ভূমিকা ছিল। চারদলীয় জোট গঠনের সময় ইসলামি ঐক্যজোটের নারী নেতৃত্বের বিরোদ্ধে সংগঠনটি শক্ত অবস্থান নেয়। পরবর্তিতে সংসদীয় আসনের লোভে কিছু তরুণ নেতার চাপে দলটি চারদলীয় জোটে শরীক হয়। নারী নেতৃত্বের বিরোধ নিয়ে ফের ২০১০সালের ১৮মার্চ দলটি ভেঙ্গে যায়। মাওলানা আলিম উদ্দীন দুর্লভপুরীকে সভাপতি এবং মাওলানা সামছুদ্দিনকে মহাসচিব করে “জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ” নামে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রককাশ ঘটে। আবার গত কয়েক বছর পূর্বে জামায়াতের সাথে সখ্যতার বিরোধ নিয়ে মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের নেতৃত্বাধীন  “বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম” নামে আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে।

এসব কারণে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতিতে এ দলের অবস্থান ও পরিচিতি অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে। মূল সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের অনেক কিছু বর্তমান সময়ের সাথে অমিল রয়ে গেছে। এজন্য জেনারেল ধারার তরুণরা এ সংগঠনের ব্যানারে কাজ করতে আগ্রহী নন। এক সময় ছাত্র রাজনীতি হারাম ফতোয়া দিলেও বর্তমানে তা হালাল করে নিয়েছেন। তবে ছাত্রদের সিনিয়র নেতা হতে হবে “হুজুর বা মাওলানা”। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সভাপতি, জেলা বা থানা সভাপতি হতে হবে শিক্ষক সমাজ থেকে। ছাত্রদের সংগঠন ছাত্ররাই পরিচালনা করবে, এটাই হচ্ছে নিয়ম। কিন্তু জমিয়ত এই নিয়মের আওতায় নয়। জানিনা হয়তো আরো দশবছর পরে তারা বুঝতে পারবেন যে, আসলেই ছাত্রদের কাজ ছাত্ররাই পরিচালনা করবে। এছাড়া কয়েক বছর ধরে সংগঠনটি অঘোষিত নিয়ম চালু করেছে যে, প্রতন্ত গ্রামে পড়ে থাকা অখ্যাত খলিফায়ে মাদানীকে দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি করা হয়। ফলে সংগঠনটির অভ্যন্তরিন নিয়ন্ত্রন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ভেতরগত নানান বিরোধ চারদিকে ছড়িয়ে সংগঠনটির মূল স্রোতকেও নির্জীব করে দিয়েছে। অন্যদিকে এক যুগের বেশি সময় ধরে চির বিরোধ জামাত-বিএনপির সাথে সখ্যতা ও দীর্ঘ মেয়াদী জোট সংগঠনটির নীতি, পলিসি ও কাটামোকে, সর্বোপরি আর্দশকে ক্ষমতার মোহে দুর্বল করে দিয়েছে। গত কেন্দ্রীয় কাউন্সেলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ পদ-পদবীর লড়াইয়ে ফের ভাঙ্গনের কবলে পরেও আল্লাহর ফজলে তা কোনো রকমে ঠিকে আছে।

চলবে…

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

সিলেটের পবিত্র মাটি আবারও কলংকিত হলো রায়হানের রক্তে!

পুলিশ ফাড়িতে যুবক হত্যা: সিলেটজোড়ে চলছে রহস্য! এলাকাবাসীর প্রতিবাদ!! সিলেট নগরীতে রায়হান নামক এক যুবকের ...