বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:২৩
Home / অনুসন্ধান / ইসলামি শিক্ষা মানেই কি মাদরাসা শিক্ষা?
Madrasa Students Studying the Koran, Madrasa Imdadul Uloom, Dehradun, India.

ইসলামি শিক্ষা মানেই কি মাদরাসা শিক্ষা?

Madrasa Students Studying the Koran, Madrasa Imdadul Uloom, Dehradun, India.

হুসাইন ইমন ::

বর্তমানে আমরা ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে কি বুঝি? স্বভাবতই আমরা উত্তর দিব- মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা! এমনকি অধিকাংশ আলেম বলে থাকেন- ধর্মের জ্ঞানই আসল জ্ঞান, বাকি সব মূল্যহীন। এজন্য তারা কুরআন ও হাদীস উল্লেখ করে মন মতো ব্যাখ্যা প্রদান করে প্রমাণ করেন যে ইসলামি শিক্ষা মানে শুধুই ধর্মীয় শিক্ষা।

তাহলে আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে যে সমস্ত আয়াতে তার সৃষ্টি সম্পর্কে গবেষণা করতে, সৃষ্টির শৃঙ্খলা থেকে শিক্ষা নিতে, সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে বলেছেন সেগুলোর হুকুম কি হবে? এখানেই তাদের যুক্তির অসারতা প্রমাণ হয়ে যায়।

অতীত থেকেই কি এভাবেই চলে আসছে? উত্তর- না। তাহলে এই ধারনা আমাদের মাঝে চলে আসল কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে পিছনের দিকে।

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামলে (৭৫০-১২৫৮খ্রি) সিরিয়া বিজিত হলে গ্রিক দর্শন ও গণিত বিজ্ঞানের অনেক গ্রন্থ মুসলমানদের হাতে চলে আসে। তখন তারা সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুবাদ, গবেষণা, পর্যালোচনা শুরু করে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড ভুমিকা পালন করে আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘বাইতুল হিকমাহ’। ভারতবর্ষ মুসলমানদের হাতে আসলে এখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞানও যোগ হয় বাইতুল হিকমায় আর মিশরীয় সভ্যতার প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান তো ছিলোই। সব মিলিয়ে এ সমস্ত জ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন আবিস্কার ও উদ্ভাবন শুরু হয় পুরো মুসলিম সম্রাজ্যে।

যদিও গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনের অনেক ধারনার সাথে মুসলমানদের ধারনার বৈপরীত্য ছিলো তথাপিও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা চালু রেখেছিলো। আর এটা এমন এক সময় হয়েছিলো যখন সমগ্র ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে ছিলো, সব বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের চার্চ কর্তৃক অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছিলো অথবা দেশান্তরিত হতে বাধ্য করা হচ্ছিলো।

খলিফা হারুন-অর-রশিদ সমগ্র বিশ্ব থেকে গ্রন্থ সংগ্রহ করে এনে বিশ্বের সবচেয়ে বড গ্রন্থাগার হিসেবে বাইতুল হিকমাহকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সব গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন। যা পরবর্তীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে উঠে। সমগ্র বিশ্ব থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের মানসে জ্ঞানপিপাসু বাইতুল হিকমাহতে উপস্থিত হতো। পরবর্তীতে তার পুত্র খলিফা মামুন গ্রন্থের পাশাপাশি বিশ্বের সব বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বাগদাদে নিয়ে আসেন। সবাইকে অবাধ জ্ঞান চর্চা ও নিজ নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দান করেন। যার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ স্বাধন হয় এবং জন্ম নেয়- ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, আল-বেরুনী, আল-খাওয়া্রেজমী, আল-ফারাবী, আল-কিন্দি, জাবির ইবনুল হাইয়ান, ইমাম গাজ্জালিদের মত দার্শনিক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, গনিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানিদের।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ অগ্রযাত্রা অবশ্য বেশি দিন একাধারে চলেনি। শুরু হয়ে যায় খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্র মূলক ক্রুসেড যুদ্ধ (১০৯৫-১২৯১খ্রি), চলতে থাকে একের পর এক আক্রমণ। এরপর বাগদাদের দিকে ধেয়ে আসে নৃশংস বর্বরতার প্রতীক মঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খানের সেনাপতি হালাকু খাঁ বাগদাদে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের তাণ্ডব চালায় (১২৫৮খ্রি)। বাদ যায়নি বাইতুল হিকমাহ, এই মূর্খ বর্বররা সমস্ত গ্রন্থভাণ্ডার জ্বালিয়ে দেয় এবং তাইগ্রীস নদীতে নিয়ে ফেলে দেয়। সেই সময় তাইগ্রীস নদীর স্রোত বন্ধ হয়ে যায় এবং গ্রন্থের লিখিত কালি দ্বারা নদীর পানি কালো হয়ে যায়। অবশ্য মাত্র ১০ শতাংশের মত গ্রন্থ নাসিরুদ্দীন তূসী ইউরুপের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

যার ফলশ্রুতিতে দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যায়। ইউরোপীয়রা গ্রহন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক ধারা আর আরবরা গ্রহন করে ইউরোপীয়দের চার্চ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার আদলে ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা।

হালাকু খাঁ হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা, বর্বরতার মাধ্যমে বাগদাদ ধ্বংস হওয়ায় যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান ভাণ্ডার মুসলমানদের থেকে হারিয়ে যায় এবং জ্ঞানী শিক্ষকদের হত্যার মাধ্যমে জাতিকে একেবারে অন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর এই ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক গড়ে উঠে অনেকটা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, তুরস্কের ইস্তানবুল কেন্দ্রীক গড়ে উঠে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে এক ব্যবস্থা আর খোরাসানের সমরকন্দ কেন্দ্রীক ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা।

এই উপমহাদেশে যে ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা মূলত সমরকান্দীয় একটি ধারা। যার মূল কিতাবগুলো সব ফারসি ভাষায়, আরবি ভাষার সাথে এর যোগাযোগ খুবই অল্প। আর এই কারনে আমাদের দেশে ইসলামি শিক্ষা বলতে মূলত ধর্মীয় শিক্ষাকেই বুঝায় এবং এভাবেই – ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, আল-বেরুনী, আল-খাওয়া্রেজমী, আল-ফারাবী, আল-কিন্দি, জাবির ইবনুল হাইয়ান, ইমাম গাজ্জালিদের চেতনা হতে আমরা দূরে চলে এসেছি।

এই নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হল- কুরআন ও হাদিসের মূল চেতনাকে আমাদের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মাঝে হাজির করা, গোঁড়ামি পরিহার করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়া। তবেই আমাদের মাদরাসা শিক্ষা সত্যিকারের ইসলামি শিক্ষা হয়ে উঠবে। তবেই পাওয়া যাবে মুসলমানদের হারানো হৃত-গৌরব। তবেই মিলবে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত মুক্তি।

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...